২০০৩-০৪ সালের সময়টা ছিল পাকিস্তান-আফগানিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও প্রতিবেশী ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে পরিচিত ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) উত্থানের স্বর্ণযুগ। বাংলাদেশ ঘিরে নিরবচ্ছিন্ন তৎপরতা ছিল তাদের। হরকাতুল জঙ্গি ও উলফা সদস্যরাও একে অপরের পরিচিত ছিল। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বাংলাদেশের বাইরে পাকিস্তানেও ঘনিষ্ঠ ছিল তারা। একই জায়গা থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহও ছিল তাদের।
সে সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে জঙ্গি ও চরমপন্থী এই দুটি সংগঠনের বিভিন্ন হামলার ধরন এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবহার দেখে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ২০০৩ সালে কুড়িলে উদ্ধার হওয়া সামরিক বাহিনীতে ব্যবহারযোগ্য ২০টি আর্জেস গ্রেনেডসহ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের চালানটি ঢাকার স্থানীয় সন্ত্রাসীদের পক্ষে এককভাবে আমদানি করা সম্ভব নয়। মামলা অভিযুক্ত সন্ত্রাসীদের আন্তর্জাতিক কোনও সন্ত্রাসবাদী চক্রের সঙ্গে অতীতে যোগাযোগ থাকার কোনও তথ্যও মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়নি। এ থেকে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, কুড়িলে উদ্ধার হওয়া আর্জেস গ্রেনেড, অস্ত্র ও বিস্ফোরকের চালানের সঙ্গে সে সময়ের সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা ও চরমপন্থী হুজি’র উভয়ের বা এদের যে কোনও একটির সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। ঢাকাকে হয়তো তারা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। তবে এর সঙ্গে ক্ষমতাধর ঊর্ধ্বতন কোনও পক্ষের যোগাযোগ থাকাও অস্বাভাবিক নয়। তবে এই গ্রেনেড ও অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনায় সিআইডির দেওয়া অভিযোগপত্রে এ বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই। গত ১৫ বছরে এ বিষয়ে বিশদ তদন্তের কোনও আদেশও দেননি আদালত কিংবা সরকার।
২০০৩ সালের ২৯ নভেম্বর কুড়িল বিশ্বরোডে সাইনবোর্ড লেখার দোকান ‘তুলির পরশ’ থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র, গ্রেনেড ও বিস্ফোরক উদ্ধার মামলার ছায়া তদন্তের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা দাবি করেন, গ্রেনেডসহ অস্ত্রের যে চালানটি ঢাকায় আনা হয়েছিল শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে। ওই সীমান্তের অপর পাশে ভারতের পাহাড় ঘেরা রাজ্য মেঘালয়।
তবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কারও নাম প্রকাশে রাজি হননি তিনি।
গ্রেনেডসহ আগ্নেয়াস্ত্রগুলো ঢাকায় এলো কেমন করে এমন প্রশ্নের জবাবে মামলার ছায়া তদন্তের সঙ্গে সেসময়ে জড়িত ওই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেনেড, বিস্ফোরকের গন্তব্য ছিল উলফা ও হুজি। কুড়িল ছিল মূলত ট্রানজিট পয়েন্ট। সময়মতো হুজি ও উলফার কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো গ্রেনেড ও বিস্ফোরকগুলো। কিন্তু তার আগেই পুলিশের নজরে এলে তাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
ছায়া তদন্তের সঙ্গে জড়িত আরেক কর্মকর্তার মন্তব্য, সিআইডির ওই সময়ের তদন্ত ছিল একপেশে এবং আরোপিত।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, যে গ্রেনেড ও অস্ত্রশস্ত্র কুড়িলে উদ্ধার হয়েছে সেগুলো আমদানি করা। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এমন ধরনের গ্রেনেড ব্যবহার করে না। আবার অস্ত্রগুলো এনে রাখা হয় কূটনীতিক এলাকা বারিধারার খুব কাছে। সেটাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিনা জানা জরুরি ছিল, কারণ, বিদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তার জন্য এটা স্পষ্ট হুমকি।
ফলে অবৈধভাবে দেশে আসা এসব অস্ত্র-বিস্ফোরকের উৎস সম্পর্কে জানা না গেলে, কারা এর সঙ্গে জড়িত অনুসন্ধান-তদন্তে তা বের না হলে ঝুঁকি থেকেই যাবে।
সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক গবেষক মো. নুর খান বলেন, ‘রাষ্ট্র কী চায়, তার ওপর কিন্তু তদন্ত এগোয়। তদন্তকারী কর্মকর্তারা কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ পারে তার ওপর নির্ভর করে একটা মামলার পরিণতি। কুড়িলে অস্ত্র- গ্রেনেড উদ্ধার মামলায় শুরুতে যতটুকু গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল এখন পর্যন্ত সেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যদি গুরুত্ব দেওয়া হতো তাহলে ইতোমধ্যে মামলার আসামিদেরকে (যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, গ্রেফতার ছিল) তাদের আবার জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ ছিল। এ ধরনের মামলায় প্রয়োজনে অন্য মামলার আলোকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেত। মামলার চার্জশিট হয়ে গেলেও এই ধরনের অন্য মামলাগুলোতে আসামিদের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখতে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেত। মানিক যেভাবে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন এখন, তৎকালীন বাস্তবতায় তার সম্পৃক্ততা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ কম। অপরাধীরা কিন্তু অনেক সময় ভোল পাল্টাতে অভ্যস্ত হয়। আমি বলবো না মানিক এটার সঙ্গে যুক্ত কী যুক্ত নয়। আমার কথা হচ্ছে এই ক্ষেত্রে মানিককে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে। এবং এই জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে যদি দেখা যায় মানিকের সংশ্লিষ্টতা তেমন নেই বরং তাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে তাহলে এটা নিয়ে আরও অধিকতর তদন্ত করা যেতে পারে। কারা তাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে সেই বিষয়গুলো বের করে আনা যেতে পারে। এটা আমরা সবাই জানি যে কুড়িলে এ কে ৪৭ রাইফেল, গ্রেনেড ও প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ পাওয়া গেছে–এক জায়গায় তিনটি জিনিস থাকা এবং উদ্ধার হওয়ার বিষয়ে একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা হলো নিকটবর্তী কোনও লক্ষ্যবস্তু ছিল। এটা কোনও সাধারণ অপরাধীর কাজ নয়। এবং এসব অস্ত্র-গ্রেনেড এমন সময় পাওয়া যায় যখন সারা পৃথিবীতেই এক ধরনের নতুন সন্ত্রাসী সংস্কৃতি, ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের উত্থান ঘটছিল। এটি এমন জায়গায় পাওয়া গিয়েছিল যে কাছে দূতাবাস ছিল। সবকিছু বিবেচনায় বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল যেটি দেওয়া হয়নি।’
আগামীকাল পড়ুন: বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা পেলেও রুবেলের ছবি নেই পুলিশের কাছে