চেকপোস্টে তল্লাশি বা জিজ্ঞাসাবাদের সময় কোনও নাগরিক বা সন্দেহভাজনের ছবি তোলা ও ভিডিও চিত্র ধারণ করায় দোষের কিছু দেখছে না পুলিশ। পরবর্তীতে সেটা আইনি প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলেও মনে করেন তারা। তবে আইনজীবীরা বলছেন, এই ছবি তোলা ও ভিডিও চিত্র ধারণ করার উদ্দেশ্য যদি হয় কাউকে অপদস্থ ও হেনস্থা করা, তাহলে সেটা হবে একটা অপরাধ।
চেকপোস্টে তল্লাশি কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় পুলিশের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ছবি তোলা বা ভিডিও করা উচিত কিনা জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা খারাপ কিছু না। এটা পুলিশের কাজের রেকর্ড। প্রয়োজনে যাতে কাজে লাগে সেজন্য করা হয়। পুলিশের কাজই তো তাদের কর্মকাণ্ডের বিষয়গুলো রেকর্ড করা এবং সেই রেকর্ড সংরক্ষণ করা। এটা পুলিশের কাজেরই একটা অংশ।’ মিসইউজ হতে পারে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পুলিশ যেখানে প্রকাশ্যে চেকপোস্টে ডিউটি করছে, সেই ডিউটির ছবি তুললে সেখানে মিসইউজের কী আছে। কাজ কর্মের যদি ছবি তোলে— সেখানে মিসইউজের কোনও সুযোগ নেই। এখানে গোপন তো কিছু নেই। কারও প্রাইভেসি তো নষ্ট করছে না।’
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এলিফ্যান্ট রোডের ঘটনার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক এই আইজিপি বলেন, ‘‘এক্ষেত্রে উভয়পক্ষেরই সহনশীলতার প্রয়োজন ছিল। প্রথম যখন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব দেখলেন তার গাড়ি আছে, সেটাতে স্টিকার আছে, গায়ে অ্যাপ্রোন আছে, তখন তিনি বলতে পারতেন, চলে যান। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব যখন তার আইডি কার্ড দেখতে চাইলেন, তখনই ওই ডাক্তার রিঅ্যাক্ট করলেন যে, আইডি কার্ড লাগবে কেন। আমার তো পরিচয় আছে। এরপর আবার ডাক্তার যে তুই তোকারি, হারামজাদা বলে বেশি কথা বলেছেন, ‘ডাক্তার হইতে পারোস নাই বলে পুলিশ হইছস’ এগুলো আবার অসংলগ্ন কথাবার্তা। সৌজন্যতার সীমা তিনি পেরিয়ে গেছেন। সিনিয়র হিসেবে তার এভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি।’’
চেকপোস্টে পুলিশ সদস্যদের ছবি তোলা কিংবা ভিডিও চিত্র ধারণ করার বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাক্ষ্য-প্রমাণ রাখতে তুলুক। সমস্যা নাই। কিন্তু তারা তো ভালো কিছুর ছবি তোলে না। তারা করেন যেটা দিয়ে অপদস্থ ও হেনস্থা করা যাবে সেটার।’
এলিফ্যান্ট রোডে ১৮ এপ্রিলের ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে এই আইনজীবী বলেন, ‘এখানে সেই চিকিৎসক ভদ্রমহিলার আইডি কার্ড নাই। সেটা না থাকলেও তার গায়ে অ্যাপ্রোন আছে। গাড়িতে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের স্টিকার ও কাগজপত্র সবই আছে। সেখানে আইডি কার্ডটা কেন জরুরি। তারা তো সেই কারণে পরিচয়পত্র চাচ্ছে না। তারা মুভমেন্ট পাস চাচ্ছে। এটা কী জিনিস। সরকার কি এমন কোনও সার্কুলার দিয়েছে যে, চলাচল করতে হলে মানুষের মুভমেন্ট পাস লাগবে? এমন কিছু চালু করা যায়— যেটা সংবিধানের পরিপন্থী? আইজিপি যেখানে নিজেই বলেছেন, এটা সহযোগিতার জন্য। সেটা তো আইনে রূপান্তর হতে পারে না। এটার জন্য কেউ ফোর্স করতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘ডাক্তার ভদ্রমহিলার সঙ্গে যে আচরণ করা হলো, সেখানে যে ভিডিও করা হলো, সেগুলোর একটি প্রচার করা হলো। পাবলিক, সাংবাদিক, পুলিশ— সবাই ভিডিও করেছে, ছবি তুলেছে। এখন এটা যার বিপক্ষে যাবে, যার মান-সম্মানহানি হবে, তিনি কিন্তু আইনের প্রতিকার পেতে পারেন। সাংবাদিকরা করেন অন্যায়টাকে তুলে ধরার জন্য। না-হলে ভদ্রমহিলার ওপর যে অন্যায়টা হয়েছে, সেটা মানুষ জানতো না। কোনও কর্তব্যরত চিকিৎসককে যদি চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে সেটাও অপরাধ।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংক্রামক ব্যাধি আইন-২০১৮ নামে দেশে একটা আইন আছে। যেটা ২০১৮ সালে করা হয়েছে। সেখানে বলা আছে— কেউ যদি সরকারের বিধিনিষেধ অমান্য করে সংক্রামক ছড়ায় এবং মুভমেন্ট করে তাহলে সেটা অপরাধ হবে। কোনও কর্তব্যরত চিকিৎসককে যদি চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে সেটাও অপরাধ হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী শামীম সরদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশ চাইলে পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়ার সাক্ষ্য-প্রমাণের জন্য ছবি তোলা কিংবা ভিডিও করতে পারে। তবে সেটা যদি কোনোভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলে যায়, তাহলে এটা একটি অপরাধ। কারণ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে নাগরিকের সম্মান রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব।’
একই প্রসঙ্গে মতামত জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ বিভাগের এআইজি সোহেল রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তল্লাশির সময় চেকপোস্টগুলোতে পাওয়া তথ্য সাক্ষী-প্রমাণ পরবর্তীতে আইনি প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই অপরাধ ও আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কিত তথ্যগুলো সংগ্রহে রাখার যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে।’