রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার ও পর্নোগ্রাফি আইনের মামলায় আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের দুই হোতা আল আমিন হোসেন ও মো. তরিকুল ইসলাম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আদালতকে।
শনিবার (২৬ জুন) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাসুদ-উর-রহমানের আদালত তাদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন। আদালতের সংশ্লিষ্ট থানার সাধারণ নিবন্ধন জিআর শাখা থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২২ জুন) ঢাকা মেট্রোপলিটন বেগম মাহমুদা আক্তারের অদালত চক্রের প্রধান সমন্বয়ক নদীসহ সাতজনের চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে সোমবার (২১ জুন) বিকালে হাতিরঝিল থানার একটি টিম নড়াইল ও যশোর জেলার সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে আসামিদের গ্রেফতার করে। ভারত থেকে পালিয়ে আসা ভুক্তভোগী তরুণী হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার ও পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা দায়ের করলে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
বড়বোন টোপ, ছোটবোন শিকার
অনটনের সংসারে চাকরি খুঁজছিলেন রাফিসা (ছদ্মনাম)। পড়েন পাচারকারীর ফাঁদে। তাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে পাচার করা হয় তার ছোটবোন রাইসা (ছদ্মনাম) ও তাদের খালাকেও। রাইসা পালিয়ে আসতে পারলেও বাকি দুজনের ভাগ্যে কী ঘটছে তা জানেন না।
হাতিরঝিল থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে রাইসা বলেন, ‘তার বাবা একজন টাইলস মিস্ত্রি। মা-বাবার সঙ্গে চার বোন থাকতেন রাজধানীর মাতুয়াইলে। ২০১৪ সালে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। পরের বছর মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। চার বোনের মধ্যে রাইসা দ্বিতীয়। সবাই থাকেন মায়ের সঙ্গে। সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম তাদের সৎ বাবা। নবম শ্রেণিতে থাকতেই পড়ালেখা বন্ধ হয় রাফিসার। খুঁজতে থাকেন চাকরি। এসময় ফেসবুকে পরিচয় হয় ভারত প্রবাসী নারী নদীর সঙ্গে। কথাবার্তার একপর্যায়ে চাকরির ব্যাপারেও কথা হয়।
স্বল্প টাকায় ভারতে বিউটি পার্লারে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন নদী। তার কথামতো বেনাপোল থানার ইসরাফিল হোসেন খোকন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন রাফিসা। গতবছর ২০ নভেম্বর রাতে ইসরাফিলের কথামতো বাসে করে যশোরে যান। এভাবেই প্রথমদফায় পাচারের শিকার হন তিনি।
এরপর ফোনে ছোটবোন রাইসাকে ফাঁদে ফেলেন নদী। রাইসা এজাহারে বলেন, ‘বোনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় তাদের। পরে জানানো হয়, তার বোন অসুস্থ। কিছুদিন পর নদী তাদের বাসায় এসে হাজির হন। তিনি জানান, রাফিসা অনেক অসুস্থ। ব্যাঙ্গালুরুতে একটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ভালো চিকিৎসা হচ্ছে। কিন্তু দেখাশোনার কেউ নেই। তখন রাইসার মা যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলে নদী তাকে যেতে বারণ করেন। তিনি রাইসাকে নিয়ে যেতে চান। নদী বলেন, বড় বোন সুস্থ হলে দুজনে মিলে পার্লারে কাজ করে ভালো আয় করতে পারবে।’
রাইসা বলেন, ‘মা প্রথমে রাজি না হলেও পরে বড় বোনের কথা ভেবে আমাকে ভারত পাঠাতে রাজি হয়। আমার সঙ্গে ছোট খালাকেও ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য নদীকে অনুরোধ করেন মা। তখন নদী আমাদের দুজনকে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে বলে আশ্বাস দেয়।’
গত ১৬ ডিসেম্বর তাদের দুজনকে বেনাপোল পাঠায় নদী। সেখানে সকাল ছয়টার দিকে খোকন তাদের দুজনকে আল-আমিন নামের একজনের বাসায় নিয়ে যায়। রাতে ওই বাসায় খোকনের সঙ্গে আসে বিনাশ শিকদার, আব্দুল হাই, আমিরুল ও সাইফুল নামে আরও চারজন। তাদের নিয়ে রাত ১১টার দিকে আলামিন, আব্দুল হাই, আমিরুল ও সাইফুল হেঁটে রওনা দেয়। ঘণ্টাখানেক পর রাইস ও তার খালা সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছালে বিজিবি আটক করে। তখন আলামিনসহ বাকিরা পালিয়ে স্থানীয় এক ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরদিন সকালে মেম্বার তাদের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিজিবির কাছ থেকে রাইসাদের ছাড়িয়ে নিয়ে আসে।
এজাহারে রাইসা আরও বলেন, ‘সেখান থেকে আবার আল-আমিনের বাসায় আমাদের নিয়ে আসা হয়। দুই দিন পর ভারতীয় সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সেদিন সীমান্তে কড়াকড়ি থাকায় আমরা ফিরে আসি। আমি ও আমার খালা ভারতে যেতে অনিচ্ছার কথা জানালে আলামিন ভারতে আমার বোনকে আশ্রয়দাতা তাসলিমা নামে একজনের সঙ্গে ইমোতে কথা বলিয়ে দেন। তিনি জানান, আমার বড় বোন অনেক অসুস্থ। আমাদের যেতেই হবে। এরপর যশোর সীমান্ত এলাকা থেকে খোকনের নির্দেশে আল-আমিন সাতক্ষীরার আনিস নামের একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেখানে যাওয়ার পর আলম নামের একজনের বাসায় আমাদের রাখা হয়।’
১৮ ডিসেম্বর রাত সাড়ে দশটার দিকে মেহেদি হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও সালাম নামের তিনজন লোক রাইসা ও তার খালাকে নিয়ে বের হন বলে এজাহারে উল্লেখ করেন রাইসা। তিনি বলেন, ‘প্রায় দুই-তিন ঘণ্টা হাঁটার পর একটি পাকা রাস্তায় পৌঁছালে রাস্তার ওপারে একজনকে দেখিয়ে বাবু বলেন তার কাছে যেতে।
প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর অজ্ঞাতনামা দুজনকে অনুসরণ করে একটি বাসায় পৌঁছান তারা। বাসাটির মালিক বকুল ওরফে ছোট খোকন নামের এক ব্যক্তি।
‘সেই বাসায় পলক মন্ডল নামে একজন আসে। ভারতে যাওয়ার আগে আমার এবং আমার খালার ছবি নেওয়া হয়। পলক মন্ডল আধার কার্ড দেয় আমাদের। পরদিন সকালে পলক আমাদের নিয়ে ব্যাঙ্গালুরুর দিকে রওনা হয়। তিনদিন পর আমাদের তাসলিমার বাসায় নিয়ে যায়। আমাকে বিউটি পার্লারের কাজের কথা বলে বেঙ্গালুরুর ইলেকট্রনিক সিটির একটি বাসায় ও আমার খালাকে কেরালার একটি হোটেলে পাঠানো হয়।’
রাইসা আরও বলেন, এরপর থেকে তাদের ওপর চলে অমানবিক যৌন নির্যাতন। শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনদিন পর তাকে তাসলিমার বাসায় ফেরত পাঠানো হলে সেখানেই বড় বোনের দেখা পান তিনি।
যেভাবে পালালেন রাইসা
রাইসা বলেন, তখন বুঝতে পারি বোনের অসুস্থতার নাটক করে আমাদের ভারতে পাচার করা হয়েছে। আমার বোন তাসলিমার সাথে তর্কে লিপ্ত হয় ও তার গায়ে হাত তোলে। তখন তাসলিমা হৃদয় বাবু ওরফে টিকটক হৃদয়কে ফোন করে। ৩০-৪০ মিনিটের মাথায় হৃদয় বাবুসহ কয়েকজন তাসলিমার বাসায় আসে। এরপর তারা সবাই আমার বড় বোনকেকে মারধর করে। তাসলিমার নির্দেশে আমাদের আনন্দপুর সার্কেলে হৃদয় বাবুর বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে আমার খালাসহ আরও কয়েকজন তরুণীকে দেখতে পাই।
সেখান থেকে চেন্নাই, কেরালা, বেঙ্গালুরুসহ বিভিন্ন হোটেল ও মাসাজ সেন্টারে পাঠানো হয় রাইসাকে। তিনি বলেন, নির্যাতনের একপর্যায়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে হৃদয় বাবুকে আমার প্রেগনেন্সি টেস্ট করার কথা বলেন তাসলিমা। রেজাল্ট পজিটিভ আসে। তাসলিমা ও হৃদয় বাবুসহ কয়েকজন আমাকে বাচ্চা নষ্ট করার কথা বলেন। তখন আমি তাদের হাতে-পায়ে ধরে আমাকে দেশে পাঠাতে বলি। ভেবেছিলাম সন্তানসম্ভবা হওয়ায় তারা আমাকে হোটেলে বা মাসাজ সেন্টারে পাঠাবে না। কিন্তু এরপরও তারা আমাকে জোরপূর্বক হোটেলে পাঠায়।
নির্যাতনের শিকার এই তরুণী এজাহারে আরও বলেন, ‘২০২১ সালের ২ মে বেঙ্গালুরুর একটি মাসাজ সেন্টারের জানালা ভেঙে আমি পালাই। সেখান থেকে ট্রেনে করে কলকাতায় এসে ৬ মে বাংলাদেশে আসি। দেশে ফিরে হাসপাতালে ভর্তি হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বলেন আমার পেটের বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আমার বড় বোন ও ছোট খালা জেরিন কোথায় আছে জানি না।’
পালিয়ে দেশে ফেরা এই তরুণীর করা মামলার আসামিরা হলেন- নদী, ইসরাফিল হোসেন খোকন, তরিকুল ইসলাম, আল আমিন হোসেন, আব্দুল হাই, সাইফুল ইসলাম, তাসলিমা, বিনাশ শিকদার, আমিরুল ইসলাম, মেম্বার, আনিস, আলম, মেহেদি হাসান বাবু, মহিউদ্দিন, সালাম, বকুল, পলক মন্ডল, রিফাদুল ইসলাম হৃদয়, সাগর, আখিল, রুবেল, সবুজ।