যা করেছি না বুঝে করেছি, আদালতে মাওলানা গুনবী

ধর্মীয় ওয়াজের নামে উসকানিমূলক বক্তব্য দিতেন মুফতি মাহমুদুল হাসান গুনবী। এমনকি ইসলামের বিরোধিতাকারীদের হত্যার পক্ষেও ওয়াজ করেছেন তিনি। সবার কাছে অস্ত্র রাখার কথাও বলেছেন। নিজের দেওয়া এসব বক্তব্যে মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে বলে স্বীকার করেছেন তিনি। আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে গুনবী বলেছেন, না বুঝেই তিনি এসব করেছেন। তার এসব বক্তব্যে যুব সমাজ উগ্র হতে পারে।

চলতি বছরের ১৫ জুলাই রাজধানীর মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে মুফতি মাহমুদুল হাসান গুনবীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতারের পর  র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলেছেন, গুনবী ওরফে হাসান মানুষকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে জঙ্গিবাদে মোটিভেট করতেন। বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়ে ধর্মীয় বক্তব্যের আড়ালে জঙ্গিবাদের প্রচারণা এবং জঙ্গিদের রিক্রুট করতেন।

গ্রেফতারের পর গুনবীকে দুই দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি। ২৪ জুলাই তাকে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলামের আদালতে সোপর্দ করা হলে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

জবানবন্দিতে গুনবী বলেন, তিনি দাওয়াতুল ইসলাম নামক একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। এই সংগঠনের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত দিতেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিস্থিতির আলোকে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন, যা দ্বারা মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে। মূলত এগুলো না বুঝেই করেছেন বলে স্বীকারোক্তিতে উল্লেখ করেন তিনি।

জবানবন্দিতে গুনবী বলেছেন, আমি বিভিন্ন মাহফিলে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কথা বলেছি। বলেছি যারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে তারা কুফরি করছে। যারা ইসলামের বিরোধিতা করে তাদের হত্যার পক্ষে বলেছি। আমি সাহাবীদের জিহাদের বিষয়ে বলেছি। তাদের অস্ত্র রাখার ব্যাপারে কথা বলেছি। আমার বক্তব্যে যুব সমাজ উগ্র হতে পারে।

‘আমি আরও বলেছি যে ইসলাম শুধু শান্তির ধর্ম নয়। এতে যুদ্ধ বিগ্রহ আছে। তাই সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। সবার কাছে অস্ত্র রাখতে হবে। সেই অস্ত্র দিয়ে কাফেরকে হত্যা করতে হবে। আমি ওয়াজের ফলাফল চিন্তা না করেই অশান্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছি। কেউ যদি আমাদের জঙ্গি বলে বলুক, তাতে কিছু যায় আসে না’- জবানবন্দিতে বলেছেন মাহমুদুল হাসান গুনবী।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মুফতি মাহমুদুল হাসান গুনবী দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ওয়াজে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। তার এসব বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে। তার বক্তব্য শুনে অনেকেই উগ্রপন্থায় পা বাড়িয়েছে।

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, তারা বিভিন্ন সময়ে অনেক জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করেছেন। যাদের মধ্যে অনেকেই গুনবী, আমির হামজা, উসামাসহ বিভিন্ন বক্তার উগ্রবাদী বক্তব্য শুনে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হয়েছে বলে স্বীকার করেছে। তারা উদ্দেশ্যমূলক এবং এজেন্ডা নিয়ে উগ্রপন্থা ছড়াতো বলে জানান এ কর্মকর্তা।

অবশ্য ২০১৯ সালের মার্চে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা থেকে ১৫ জন ইসলামী বক্তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিল, যারা ওয়াজের নামে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ, গণতন্ত্রবিরোধী, দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী ও জঙ্গিবাদের পক্ষে বক্তব্য দিতেন।

‘এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা র‌্যাডিক্যালাইজড হয়ে উগ্রবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করা হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে। ওই তালিকায় অন্যদের সঙ্গে মুফতি মাহমুদুল হাসান গুনবীর নামও ছিল।

ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ধর্মীয় বক্তাকে গ্রেফতার করেছি, যারা নিয়মিত ওয়াজের নামে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতেন। গ্রেফতারের পর তারা স্বীকার করেছেন তাদের উদ্দেশ্য ছিল যারা উগ্রবাদের খাতায় প্রাথমিকভাবে নাম লিখিয়েছেন, তাদের আরও বেশি উগ্রবাদের পথে ধাবিত করা।’

উসকানিমূলক ওয়াজ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে

করোনা অতিমারির কারণে গত তিন বছর ধরে প্রকাশ্যে ধর্মীয় জমায়েত বা ওয়াজ মাহফিল বন্ধ রয়েছে। এ কারণে উসকানিমূলক বক্তব্য সংবলিত ওয়াজ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ছড়ানো হচ্ছে। অবশ্য আগেও সরাসরি বিভিন্ন মাঠে-ময়দানে উসকানিমূলক ওয়াজের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সেগুলোর ভিডিও প্রচার করা হতো।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, করোনা অতিমারির কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক ওয়াজ বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বক্তব্য প্রচার করছেন একশ্রেণির বক্তারা। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিদেশে বসেও এই কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের উদ্দেশ্য যুব সমাজকে প্রভাবিত করে জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত করা।

ওই সূত্র জানায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উম্মাহ নেটওয়ার্ক নামে একটি গ্রুপ রয়েছে, যারা সরাসরি জঙ্গিবাদে উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। তামীম আল আদনানী নামে এক ব্যক্তি বিদেশে বসে প্রতিনিয়ত উসকানিমূলক বক্তব্য ও ভিডিও বার্তার মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উসকানি দিয়ে আসছেন।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘কেউ যদি ওয়াজের নামে জঙ্গি তৎপরতা চালায় তাহলে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হয়। নরমাল বা সাধারণ ধর্মীয় ওয়াজে আমাদের ইন্টারফেয়ার নেই। যারা ধর্মীয় বক্তব্যের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উসকানি দিচ্ছে, আমরা হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স ও অনলাইন ইন্টেলিজেন্স প্রয়োগ তাদের শনাক্তে কাজ করছি।’