রিকশাচালক থেকে নৃত্যশিল্পী, অতঃপর মানব পাচারের মূলহোতা

২০০১ সালে জীবিকার তাগিদে কুমিল্লা থেকে রাজধানীতে এসে রিকশা চালানো শুরু করেন কামরুল। এর তিন বছর পেরিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের ভ্যান চালাতেন তিনি। ২০১৬ সালের পর থেকে বিএফডিসিতে ঘোরাফেরার মাধ্যমে নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। তখন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে তার। ২০১৯ সালের পর থেকে ভারতে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। চক্রটির অন্যতম হোতা এই ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল ওরফে কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল। তাকে এবং মোল্লা রিপন, আসাদুজ্জামান সেলিম ও নাঈমুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। শনিবার (৩০ অক্টোবর) মিরপুর-১ নম্বরে র‌্যাব-৪ সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

জানা গেছে, মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকায় পৃথক দুটি চক্রের মূলহোতাসহ ১১ জন র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েছে। শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) দিনব্যাপী রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা ও বাড্ডা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। একইসঙ্গে পাচার হতে যাওয়া তরুণ-তরুণীসহ ২৩ জনকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব। অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গায় পরিচালিত অভিযানে একজন নারী উদ্ধার হয়েছেন। 

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার দাবি, নাচ শেখানো ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে নাচের অনুষ্ঠানে নেওয়ার কথা বলে তরুণ-তরুণীদের প্রলুব্ধ করতেন ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে আসতেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ভালো চাকরি এবং নাচের অনুষ্ঠানে নেওয়ার কথা বলে ভারতে পাচার করা হতো তাদের। চক্রটি এখন পর্যন্ত ভারতে প্রায় শতাধিক ব্যক্তিকে পাচার করেছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। ডিজে কামরুল চক্রে ১৫-২০ জন সদস্য রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।

পাচার হতে যাওয়া দুই নারীকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব

গতকাল গ্রেফতার হওয়া আরেক চক্রের মূলহোতা নূরনবী ভূঁইয়া রানা। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে পাচারের সঙ্গে জড়িত। তার সহযোগী আবুল বাশার, আল ইমরান, মনিরুজ্জামান, শহীদ শিকদার, প্রমোদ চন্দ্র দাস এবং টোকনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে বিপুলসংখ্যক পাসপোর্ট, বিদেশি মদ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাবের তথ্যানুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী নূরনবী ভূঁইয়া পাঁচ-সাত বছর ধরে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। ১৯৯৮ সালে ওমান থাকাকালীন পাচারকারী চক্রের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে তার। ওমান থেকে দেশে ফিরে তরুণ-তরুণীদের বিভিন্ন প্রলোভনে ফেলে পাচার করে আসছিলেন তিনি। তার চক্রে ১৫ জন সদস্য আছে। এখন পর্যন্ত ৩০-৩৫ জন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে অবৈধভাবে পাচার করেছে তারা। এছাড়া চাকরি দেওয়ার কথা বলে ২০০-২৫০ জনকে পাচার করা হয়েছে। বিভিন্ন চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করতো চক্রটি। ভালো বেতনের চাকরির আশ্বাসে অনেকেই ফাঁদে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। 

খন্দকার আল মঈন জানান, রাজধানীতে পাচারকারী চক্রের বেশ কয়েকটি ‘সেফ হাউস’-এর সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব। এর মধ্যে তিনটি ‘সেফ হাউস’ থেকে ২৩ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে চক্র দুটি এখন পর্যন্ত প্রায় চার শতাধিক ব্যক্তিকে পাচার করেছে। প্রলোভন দেখিয়ে চাকরি দেওয়ার নামে তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতো চক্রের সদস্যরা। পরবর্তী সময়ে বিদেশ নেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন সেফ হাউসে নিয়ে তাদের রাখা হতো। সেখানে পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালানো হতো। 

জানা গেছে, গ্রেফতার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেছে র‌্যাব। সংবাদ সম্মেলন শেষে উদ্ধার হওয়া ২৩ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।