দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট

ইইউ ত্যাগের পক্ষে ভোট দিলেন ব্রিটিশরা

গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) না থাকার পক্ষে রায় দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের ভোটাররা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের ৪৩ বছরের সম্পর্কের অবসান ঘটতে যাচ্ছে এ গণভোটের ফলাফলের মধ্য দিয়ে। এ বিষয়টি নিয়ে শনিবার শিরোনাম করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।

জনগণের রায়ে উল্লাস প্রকাশ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষের নেতারা দিনটিকে উল্লেখ করছেন যুক্তরাজ্যের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে। ঐতিহাসিক এই গণভোটে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের পাশাপাশি স্পেন উপকূলের অদূরের ব্রিটিশ শাসিত ক্ষুদ্র ভূখণ্ড জিব্রাল্টারের অধিবাসীরাও তাদের রায় দিয়েছেন। সব মিলিয়ে মোট ভোটার সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৬৫ লাখ। এরমধ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন ৭০ শতাংশ।

লন্ডনের বাইরে প্রত্যাশা অনুযায়ী ভোট পায়নি ‘রিমেইন’ বা ইইউতে থাকার পক্ষ। লন্ডন, স্কটল্যান্ড এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের ভোটাররা অবশ্য ‘রিমেইন’কেই সমর্থন জানিয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের মতো করে এ গণভোটে এলাকাগুলোর ভোট এককভাবে গণনা করা হয়নি। ভোট গণনার জন্য স্থানীয়ভাবে ৩৮২টি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এ গণনা কেন্দ্রগুলো ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ও জিব্রাল্টারের ৩৮০টি স্থানীয় সরকারের সবগুলোকেই প্রতিনিধিত্ব করছে।

TWP

এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক অবসানের পক্ষে ব্রিটিশ জনগণের রায়ের প্রভাব পড়েছে ইইউ-জোটভূক্ত অন্যান্য দেশেও। ‘লিভ’ পক্ষে রায় আসায় নড়েচড়ে উঠেছে জোটের অন্য সদস্য দেশগুলো। তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অস্থিরতা। এরইমধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা নিজ নিজ দেশে একই রকমের গণভোট আয়োজনের দাবি তুলেছেন। কেউ কেউ একে স্বাধীনতা বললেও কেউ কেউ আবার বলছেন, এটি ব্রিটিশ জনগণের ভুল সিদ্ধান্ত। অনেকে আবার মনে করছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যেন বাকি সদস্য দেশগুলো বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায় তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সবমিলে ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণা প্রতিবেদনেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদের মধ্যকার অস্থিরতার আভাস দেওয়া হয় গণভোটের আগেই।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা ইইউ হলো ২৮টি সদস্য রাষ্ট্রবিশিষ্ট (যুক্তরাজ্যসহ) একটি অর্থনৈতিক জোট। কেবল জোটই নয়, বলা চলে এটি মুক্ত-বাণিজ্য অঞ্চলের চেয়েও বেশি কিছু। ইইউ’র জিডিপি ১৮ হাজার বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি। প্রতিষ্ঠার পর গত অর্ধ শতকেরও বেশি সময় ধরে ইইউ স্বাতন্ত্র্য বাড়িয়েছে। আলাদা করে গড়ে তুলেছে ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি যুক্তরাজ্য ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটিতে যোগ দেয়। পরে এ কমিউনিটিই ইইউ নামে প্রতিষ্ঠা পায়। এবার সে ৪৩ বছরের সম্পর্ক অবসানের পক্ষে অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসার পক্ষে রায় দিয়েছে ব্রিটিশ জনগণ।

সে রায়কে স্বাগত জানিয়ে ফ্রান্সের ফ্রন্ট ন্যাশনাল দলের নেতা ম্যারিন লা পেন একটি টুইট করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘স্বাধীনতার জন্য জয় হলো। যেমনটা আমি কয়েক বছর ধরে চাইছি। এখন ফ্রান্সে ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশগুলোতে একইরকম করে গণভোট হওয়া প্রয়োজন।’

ফ্রান্সের উগ্র ডানপন্থী রাজনীতিবিদ ম্যারিয়ন মারেচাল লা পেন টুইটারে লিখেছেন, ‘ফ্রম ব্রেক্সিট টু ফ্রেক্সিট। আমাদের দেশে গণতন্ত্র নিয়ে আসার এখনই সময়। ফরাসিদেরও একইরকম করে নিজেদের মতামত জানানোর অধিকার থাকতে হবে।’

নেদারল্যান্ডসের ফ্রিডম পার্টির নেতা গির্ট উইল্ডার্স উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, ‘ব্রিটিশদের জন্য হুররে! এবার আমাদের পালা। এবার ডাচ গণভোটের পালা।’

ফিনল্যান্ডের ইইউবিরোধী দলের নেতা টিমো সোইনি বলেন ‘জাতি তার রায় দিয়ে দিয়েছে। এ গণভোটের পর যুক্তরাজ্য আর ইইউ-এর মধ্যে পরবর্তী আলোচনার ব্যাপারে কথা হওয়া প্রয়োজন।’

সবাই যে ব্রেক্সিট ইস্যুটিকে ভালোভাবে নিয়েছেন তা নয়। অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। দিনদিকে ইউরোপ ও ব্রিটেনের জন্য কষ্টের দিন বলে আখ্যা দিয়েছেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্র্যাংক-ওয়াল্টার।

পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওইটোল্ড ওয়াজসিচিকোস্কিও এ খবরটিকে খারাপ সংবাদ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধারণায় যে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন এটি তারই চিহ্ন।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট মার্টিন শুলজ ব্রেক্সিট ইস্যুতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘ব্যাপারটিকে এবার গুরুত্ব সহকারে ও দায়িত্বসুলভাভাবে বিবেচনা করার সময় এসেছে। নিজের দেশের জন্য ডেভিড ক্যামেরনের যেমন দায়িত্ব আছে তেমনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যতের জন্যও আমাদের দায়িত্ব আছে। বাজারের স্টারলিং মুদ্রার কী অবস্থা সেটা আপনারাই দেখেছেন আমি চাই না ইউরো মুদ্রার সঙ্গেও একইরকম কিছু ঘটুক।’

ওয়াশিংটনে নিয়োজিত ফরাসি রাষ্ট্রদূত জেরার্দ আরাউদ বলেন, ‘ভেঙে পড়া থেকে ইইউকে বাঁচাতে এখন অন্য সদস্য দেশগুলোকে কাজ করতে হবে।’

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সবচেয়ে বড় দল ইপিপির নেতা ম্যানফ্রেড ওয়েবার ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতে রাজি নন। এ ব্যাপারে ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ইইউ ছাড়ার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত আলোচনা সর্বোচ্চ দুই বছরের মধ্যে শেষ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা থাকতে পারে না। লিভ মানেই লিভ হতে হবে।’

সম্প্রতি পিউ সেন্টারের গবেষনা প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্যাপারে এককভাবে ব্রিটিশ নাগরিকরাই প্রশ্ন তোলেননি। জোটের অন্তর্ভূক্ত অন্য দেশগুলোর মধ্যেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) প্রশ্নে বিরোধিতা বাড়ছে কিংবা বলা চলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জনপ্রিয়তা কমছে।

‘ইউরোস্কেপটিসিজম বিয়ন্ড ব্রেক্সিট’ নামের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপের দেশগুলোতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভাবমূর্তির উত্থান-পতন হচ্ছে। ২০১২ ও ২০১৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতিতে ধস নামার পর ইইউ’র জনপ্রিয়তা কমেছে। বর্তমান সময়ে আবারও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জনপ্রিয়তা নেমে এসেছে।

২০১৫ ও ২০১৬ সালে ছয়টি দেশের নাগরিকদের ওপর চালানো জরিপে দেখা গেছে ৫টি দেশে ইইউ-এর জনপ্রিয়তা কমেছে। ফ্রান্সে ১৭ শতাংশ, স্পেনে ১৬ শতাংশ,জার্মানিতে ৮ শতাংশ যুক্তরাজ্যে ৭ শতাংশ এবং ইতালিতে ৬ শতাশ জনপ্রিয়তা কমেছে। ফ্রান্সের ৩৮ শতাংশ মানুষ ইইউকে সমর্থন করেন। আর যুক্তরাজ্যে ইইউকে সমর্থন করেন ৪৪ শতাংশ মানুষ।

/এমপি/