গালফ টাইমস

সৌদির কাছে খাশোগি’র কনস্যুলেট ত্যাগের প্রমাণ চান এরদোয়ান

প্রকাশ্য দিবালোকে একজন মানুষ সৌদি আরবের কনস্যুলেটে ঢুকলেন। এরপর থেকে তার আর কোনও খোঁজ মিলছে না। এরইমধ্যে খবর এসেছে তাকে খুনের পর লাশও সরিয়ে ফেলেছে কনস্যুলেট কর্তৃপক্ষ। তবে সৌদি যুবরাজের সমালোচক হিসেবে পরিচিত জামাল খাশোগি নামের ওই সাংবাদিককে হত্যার খবর অস্বীকার করছে রিয়াদ। তাদের দাবি, ওই সাংবাদিক তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি আরবের কনস্যুলেট থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। আর রিয়াদের এমন দাবি জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে তুর্কি পুলিশ। এমন বাস্তবতায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান বলেছেন, নিখোঁজ সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি কোথায় আছেন, তা সৌদি আরবকেই প্রমাণ করতে হবে। এ বিষয়টি নিয়ে সোমবার শিরোনাম করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গালফ টাইমস।

12৭ অক্টোবর আঙ্কারায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রথিতযশা এই আরব সাংবাদিককে ‘বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করেন এরদোয়ান। তিনি বলেন, জামাল খাশোগি’র এভাবে ‘হাওয়া’ হয়ে যাওয়া তুরস্কের জন্যে বিব্রতকর। এটা দুঃখজনক যে, এমন ঘটনা তার্কিতে ঘটেছে। তবে ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, তুরস্ক তা দুনিয়াকে জানিয়ে দেবে।

এরদোয়ান বলেন, সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ ও বেরুনোর, এমনকি ইস্তান্বুল বিমানবন্দরের সিসিটিভি ফুটেজও পরীক্ষা করে দেখছে তুর্কি পুলিশ।

এরদোয়ানের একজন উপদেষ্টা ইয়াসিন আকতায় বলেছেন, কোনও সমাধান ছাড়া তুরস্ক বিষয়টি ছেড়ে দেবে না।

এদিকে সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, জামাল খাশোগি (৫৯) যেদিন নিখোঁজ হন, সেদিনই সৌদি আরব থেকে দেশটির ১৫ জন কর্মকর্তা তুরস্কে পৌঁছান।

আল জাজিরার ইস্তাম্বুল প্রতিনিধি জামাল এলশায়াল সূত্রের বরাত দিয়ে জানান, সৌদি কর্মকর্তারা মঙ্গলবার (২ অক্টোবর ২০১৮) আলাদা দুইটি ফ্লাইটে ইস্তাম্বুল পৌঁছান। আনাদোলু এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই ১৫ সৌদি কর্মকর্তার সবাই এরইমধ্যে তুরস্ক ত্যাগ করেছে।

তুরস্কের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে জামাল খাশোগিকে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে খুন করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত। খুনের পর তার মরদেহ কনস্যুলেট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।’

সৌদি আরবের এ রাজনৈতিক ভাষ্যকার মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে লিখতেন। সেখানে নিজের লেখায় তিনি সৌদি জোটের কাতারবিরোধী অবরোধের কঠোর সমালোচনা করতেন। মানবাধিকার নিয়ে কথা বলায় কানাডার ওপর সৌদির চড়াও হওয়ারও সমালোচক ছিলেন জামাল খাশোগি। ইয়েমেনে সৌদি জোটের সামরিক আগ্রাসন এবং নিজ দেশে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর ধরপাকড়ের কঠোর সমালোচক ছিলেন এ অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার।

২ অক্টোবর দুপুর ১টার দিকে ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করেন জামাল খাশোগি। আগামী মাসে তুর্কি বংশোদ্ভূত হবু স্ত্রীকে বিয়ে করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহের জন্য তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। তার হবু স্ত্রী হাতিসেও সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু তাকে খাশোগির সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। খাশোগিকেও মোবাইল ফোন রেখে ভেতরে যেতে হয়েছে। অনেক দূতাবাস ও কনস্যুলেটে মোবাইল ফোন রেখে যাওয়ার রীতি অনুসরণ করা হয়। তবে দীর্ঘ সময় পরও খাশোগি সেখান থেকে বের না হওয়ায় তার বাগদত্তা তুর্কি পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন।

জামাল খাশোগির বাগদত্তা হাতিসে বলেন, জামাল খাশোগি সেদিন সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশের পর সেখান থেকে আর বের হননি। তবে, তার বিশ্বাস তার হবু স্বামী খুন হননি, তিনি বেঁচে আছেন।

টুইটারে দেওয়া এক পোস্টে হাতিসে বলেন, ‘জামাল খুন হয়নি। আমি বিশ্বাস করি না যে তাকে খুন করা হয়েছে।’

সাংবাদিক জামাল খাশোগির বিষয়টি পরিষ্কার করতে সৌদি আরবের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। একইসঙ্গে এ বিষয়ে বিশদ তদন্তের জন্য তুরস্কের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা। তুর্কি কর্তৃপক্ষও এরইমধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিশদ তদন্ত শুরু করেছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সৌদি আরব যদি কোনও স্বীকারোক্তি ছাড়াই তাকে আটকে রাখে তাহলে তার অন্তরীণ অবস্থা গুম হিসেবে প্রতীয়মান হবে।

সৌদি আরবের দাবি, মঙ্গলবারই কনস্যুলেট ত্যাগ করেছেন জামাল খাশোগি। তবে তারা এমন দাবির সপক্ষে প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় বিশদ তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় তুর্কি কর্তৃপক্ষ। তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল একে পার্টি ঘোষণা দিয়েছে, তারা এ ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে ছাড়বে। দলটি বলছে, এ ঘটনা তুরস্কের জন্য একটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের স্পর্শকাতর বিষয়।

তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানের সভাপতিত্বে দলীয় এক সম্মেলনে এ বিষয়ে কথা বলেন একে পার্টির মুখপাত্র ওমর সেলিক। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ওই নিখোঁজ সাংবাদিকের বিস্তারিত অবস্থা এবং এর জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করা হবে।

সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে খুনের বিষয়টি নিশ্চিত হলে তা তুরস্কের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলবে। এরইমধ্যে সৌদি জোটের কাতারবিরোধী অবরোধসহ নানা ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্কে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সৌদি জোটের ওই অবরোধকে ইসলামবিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তুরস্কে আসার আগে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতেন এই সাংবাদিক। সৌদি যুবরাজের কঠোর সমালোচক জামাল খাশোগি মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করতেন।

এক সময়ে সৌদি রাজপরিবারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা খাশোগি গত বছর দেশ ছেড়ে যান। এমবিএস নামে পরিচিত সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর ব্যাপক ধরপাকড় শুরুর পর দেশ ছাড়েন তিনি। গত মার্চে আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সৌদি আরবে বিতর্কের কোনও জায়গা নেই। সরকারের নীতিকে প্রশ্ন করলেই নাগরিকদের কারাগারে আটকে রাখা হচ্ছে।