ওয়াশিংটন পোস্ট

ইউরোপীয় ইউনিয়নের শরণার্থী সঙ্কটের গভীরে

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রথম পাতাগত বছর ইসলামিক স্টেটের প্রতিহিংসার কবলে পড়া ইরাক থেকে পরিবার নিয়ে পালিয়ে গ্রিক দ্বীপ লেসবসে আসেন মানাফ হামামিন। ভেবেছিলেন ইউরোপের কোন দেশে, ব্রিটেন অথবা সুইডেনে শুরু করবেন জীবনের নতুন অধ্যায়। লেসবসের শরণার্থী শিবিরের এক কর্মকর্তা তাকে অন্য এক উপায় বাতলে দেন। তিনি বলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাহায্য নিয়ে তার পরিবারকে কঠিন যাত্রা থেকে বাঁচানো যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের পৌঁছে দিতে পারে লুক্সেমবার্গ।
তখন থেকেই অন্যভাবে ভাবতে শুরু করেন হামামিন। কেননা তার পরিবারে রয়েছে দুইটি অসমর্থ শিশু, যাদের একজনও হাঁটতে পারে না।
এই থেকে ইউরোপের শরণার্থী সংকটের চিত্র কিছুটা হলেও বুঝতে পারা যায়। ইউরোপের বিভিন্ন অংশে বণ্টনের মাধ্যমে এই সংকট সমাধানের যে পরিকল্পনা করা হয় তা দিয়ে অভূতপূর্ব এই শরণার্থী প্রবাহ সামলাতে পারতো ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
কিন্তু ইইউ নেতাদের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত পরিকল্পনা প্রণয়নের চার মাস পরও আলোচনার দীর্ঘসূত্রিতা ও সহযোগিতার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে। সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে দেড় লক্ষাধিক অভিবাসন প্রত্যাশীর সমস্ত আশা ভরসাও।
অভিবাসীদের অব্যাহত প্রবাহ ইইউ নেতাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতেই থাকে। উপরন্তু বেশ কিছু ইউরপীয়ান রাষ্ট্র তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় ভোগান্তিতে যোগ হয় নতুন মাত্রা।          

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসন কমিশনার দিমিত্রি অ্যাভরামোপোলাস বলেন, ‘অভিবাসী প্রবাহ আরও ধীর করতে হবে, ইউরোপীয় সংহতি এখন ঝুঁকির মুখে।’

এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ-ও বলেন অভিবাসন প্রত্যাশীদের বণ্টনের পরিকল্পনা হতাশাব্যাঞ্জক ফলাফল বয়ে এনেছে। এর জন্য অভিবাসী গ্রহণে অনিচ্ছুক দেশগুলোকে দোষারোপও করেন তিনি। তিনি জানান, যদিও ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলো প্রত্যেকে নিজেদের জিডিপি অনুযায়ীই কোটা বণ্টিত হয়েছে, কিন্তু হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়াসহ বেশ কিছু রাষ্ট্র এই বণ্টনের বৈধতা নিয়ে আদালত পর্যন্ত দরবার করেছে।

নববর্ষে জার্মানির কোলন নগরে সংঘবদ্ধ যৌন সহিংসতার ঘটনার পর স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো আবারও ঘোষণা করেন, তিনি কোনমতেই মুসলিম শরণার্থীদের নিজের দেশে স্থান দিতে চান না।তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না জার্মানির মত কোন ঘটনা স্লোভাকিয়াতেও ঘটুক।’

এদিকে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান গ্রিসের উত্তর সীমান্তে ‘ইউরোপীয় আত্মরক্ষা বলয়’ তৈরি করে শরণার্থী আগমন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব তোলেন।

ইইউয়ের অভিবাসন কমিশনার দিমিত্রি অ্যাভরামোপোলাস বলেন, ‘একটি সুসংহত পরিকল্পনা এই শরণার্থীবিদ্বেষ ও নেতিবাচক জনমতকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।’ তবে দেখা যাচ্ছে, জনমতই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হচ্ছে, ইউরোপীয় সহযোগিতা ও সংহতি কাজ করছে না। ইইউয়ের আবেদন গ্রাহ্য করছে না অনেক রাষ্ট্রই।

শরণার্থী পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে আরও একটি সমস্যা হচ্ছে, যদিও ইইউয়ের হস্তক্ষেপে অভিবাসীদের যাত্রা তুলনামূলকভাবে সহজ হচ্ছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে অভিবাসীদের মতামত আমলে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না তারা কোন দেশে গিয়ে থিতু হতে চান। যে সব দেশের মানুষ খুশীমনে তাদের স্বাগত জানাচ্ছেন না সে সব দেশের চেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ কোন দেশে যেতেই তারা বেশি আগ্রহী হচ্ছেন।

আবার শরণার্থীদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিলেও সংকটের সমাধান সম্ভব নয়, সুষম বণ্টনও সম্ভব নয়। জনপ্রিয় গন্তব্য সুইডেন আগে আগ্রহী হলেও পরে চাপ সামলাতে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জার্মানির চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মের্কেলও নিজের দল থেকেই প্রায় একই রকম চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে লুক্সেমবার্গের প্রধানমন্ত্রী জেভিয়ার ব্যাটেল বলেন, ‘এ তো বাজার করা নয়। কোথায় রাখলে তারা স্বচ্ছন্দে বাঁচতে পারবেন তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আমাদের, তাদের নয়।’

লুক্সেমবার্গ অভিবাসী গ্রহণে আগ্রহী প্রথম রাষ্ট্র।পার ক্যাপিটার দিক থেকেও দেশটি সমৃদ্ধতম। ইইউয়ের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও এই দেশেই অবস্থিত।

 এই সমৃদ্ধি সত্ত্বেও লুক্সেমবার্গে অভিবাসনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। ব্যাংকিং খাতের বাইরে তেমন কোন কর্মসংস্থান নেই, জীবনযাপনের ব্যয়ও বেশ উঁচুতে, এ ছাড়াও দেশটিতে প্রচলিত রয়েছে তিনটি ভাষা। ফলে এই দেশে বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে অজ্ঞানতা ও অনীহা দুইই বিদ্যমান।

গত দুই মাস ধরে স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে লুক্সেমবার্গে আছেন সিরিয়ার নাগরিক আব্দেল আল-হুসেইন। তিনি বলেন, ‘আমি তো ভাবতাম লুক্সেমবার্গ জার্মানির একটা অংশ। এখানে আসার কথা ভাবিনি  কখনও।’

হুসেইনের পরিবার এখন বাস করছেন একটি প্রাক্তন হাসপাতাল ভবনে। তার সন্তানরা স্থানীয় স্কুলে যাচ্ছে। তারা ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও লুক্সেমবার্গিশ ভাষা শিখছে। হুসেইনের স্ত্রী হাউদা আল-আলি সিরিয়ার যুদ্ধে গুরুতর জখম হওয়া একটি চোখের চিকিৎসাও পাচ্ছেন।

হাউদা বলেন, ‘আমরা এখানে ভালোই আছি। এখানকার মানুষ খুবই সহৃদয়। বিদেশে যাওয়ার কষ্ট কমিয়ে দিয়েছে লুক্সেমবার্গ।’

কিন্তু সকলের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে না। অনেক অভিবাসন প্রত্যাশীই গ্রিস বা ইটালিতে পৌঁছানোর পর কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য যথোপযোগী স্থান ও আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারে না।                  

লুক্সেমবার্গের প্রধানমন্ত্রী জেভিয়ার ব্যাটেল বলেন, ‘সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।এই সংকট মোকাবেলা করতে না পারলে এটা হবে আমাদের সম্মিলিত পরাজয়।’

হামামিনও তার দুই সন্তান নিয়ে এসেছেন লুক্সেমবার্গে। তিনি আশা করছেন এখানে তার সন্তানদের সুচিকিৎসা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, ‘এই দেশটি খুব সুন্দর। জার্মানি, ফ্রান্স বা বেলজিয়াম থেকে খুব দূরও নয়। নিয়ম, কানুনগুলোও ভালো। আশা করি সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন।’ সূত্র- ওয়াশিংটন পোস্ট

/ইউআর/