দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস

ধর্ষণ নির্বিঘ্ন করতে যৌনদাসীদের গর্ভনিরোধক পদ্ধতি প্রয়োগে বাধ্য করে আইএস

বিকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষা মেটানোর প্রবাহে যেন বাধা না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে ‘যৌনদাসী’দের গর্ভনিরোধক পদ্ধতি প্রয়োগে বাধ্য করে সুন্নিপন্থী সশস্ত্র সংগঠন আইএস। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তথ্য। ইরাকে আইএস জঙ্গীদের বন্দিদশা থেকে পালিয়ে আসা ৩৫ জনেরও বেশি ইয়াজিদি নারীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। রবিবারের প্রধান শিরোনাম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যৌনদাসীদের সরবরাহ ঠিক রাখার লক্ষ্যেই এই ব্যবস্থা নিয়েছে আইএস। যৌনদাসীরা যেন গর্ভবতী হয়ে না পড়ে এবং তাদের যেন আইএস যোদ্ধাদের কাছে নিয়মিত পাঠানো যায় সেটা নিশ্চিত করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

noname

প্রতিবেদনে ১৬ বছরের এক কিশোরী ধর্ষণ আতঙ্কের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সারাদিন তালাবদ্ধ একটি ঘরে বন্দি। ঘরে আসবাব বলতে শুধু একটা খাট। দিনের আলো যতো কমে যেতো মেয়েটি ততই আতঙ্কিত হয়ে উঠত। তার জানা ছিল সন্ধ্যা নামলেই ঘরের তারা খুলে যাবে। প্রবেশ করবে সুন্নিপন্থী সশস্ত্র সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) যোদ্ধা। ঘরে ঢুকেই জোর করে খাইয়ে দেবে একটি ওষুধ। এরপর শুরু হবে ধর্ষণ।

শুধু ওই কিশোরী নয়, ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকার কয়েকশ ইয়াজিদি তরুণীকে এভাবেই যৌনদাসী করেছে রেখেছে আইএস। এদের কারও বয়স ১৬, কারও ১৮। রয়েছেন ২০-২৩ বছরের তরুণীরাও। প্রতিদিনই তাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়ানো হচ্ছে। বাধ্য করা হচ্ছে কনডম ছাড়াই যৌন সঙ্গমে। ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের দখলকৃত এলাকায় যৌনদাসী প্রথার রমরমা চলছে। 

সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মেয়েদেরই মূলত যৌনদাসী বানিয়েছে আইএস। কাদেরকে যৌনদাসী বানানো যাবে, তা নিয়ে নির্দেশিকাও জারি করা হয়েছে। নির্দেশিকার বলা হয়েছে, যাকে যৌনদাসী বানানো হচ্ছে, তার সঙ্গে যৌন সঙ্গম করার আগে পুরুষকে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে যে সেই নারী গর্ভবতী নন। এই নির্দেশিকা মেনে চলার জন্য গর্ভনিরোধক ওষুধ ও ইঞ্জেকশনের বেপরোয়া ব্যবহার শুরু করেছে আইএস। জঙ্গি শিবির থেকে পালিয়ে আসা ইয়াজিদি মেয়েদের সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য ওঠে এসেছে। মুক্তি পাওয়ার পর ইয়াজাদি নেতাদের মাধ্যমে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে এই মেয়েদের। তাদের উপযুক্ত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে সংস্থাগুলি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে আশ্রয় নিচ্ছেন ভয়ংকর যৌন দাসত্বের কবল থেকে পালিয়ে আসা ইয়াজিদি তরুণীরা।

ইয়াজিদি মেয়েদের কেনাবেচা আইএস শাসিত এলাকায় এখন অন্যতম  ব্যবসা। আইএসসের কবল থেকে পালিয়ে আসতে পারা ইয়াজিদি তরুণীরা জানান, একাধিক বার হাতবদল হয়েছে তাদের ‘মালিকানা’। এক আইএস যোদ্ধা বেশ কিছু দিন ধর্ষণ করার পর যখন ওই তরুণীর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, তখন সে তাকে বিক্রি করে দেয় অন্য কারও কাছে। এই হাতবদল চলতে থাকে কয়েক মাস পরপরই। আর যে কোনও নতুন মালিক তার যৌনদাসীর হাতে প্রথমেই ধরিয়ে গর্ভনিরোধক বড়ির একটা বাক্স। এক মাসের বড়ি থাকে ওই বাক্সে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ধর্ষণ শুরুর আগে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে যৌনদাসীকে ওই বড়ি খেতে বাধ্য করে আইএস যোদ্ধারা। ওষুধ খাওয়ার পর শুরু হয় অকথ্য যৌন নির্যাতন।

অবশ্য শুধু গর্ভনিরোধক বড়িতেই কিন্তু শেষ নয়। প্রতি মাসে হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হয় তরুণী গর্ভবতী হয়ে পড়েছে কি না। যৌনদাসী বিক্রি করে দেওয়ার সময়ও এই পরীক্ষা করানো হয়। ক্রেতা নিশ্চিত হয়ে নেন, যাকে তিনি কিনছেন, তিনি গর্ভবতী নন।

নাম প্রকাশ না করলেও ভয়ংকর দিনগুলোর কথা জানিয়েছেন পালিয়ে আসতে পারা অনেক মেয়ে। তাদের একজন জানান, কেনার আগে এক আইএস নেতা তাকে জিজ্ঞেস করেন, শেষ করে তার ঋতুস্রাব হয়েছিল। নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর সেই নেতা তাকে এমন ওষুধ খাইয়েছিল যে ওই তরুণী প্রবল রক্তপাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটু সুস্থ হওয়ার পরই এক সন্ধ্যায় সেই আইএস নেতা ওই তরুণীর ঘরে ঢুকে তাকে বিবস্ত্র হতে নির্দেশ দেন। তার পর তরুণীর উরুতে সে গর্ভনিরোধক ইঞ্জেকশন দেয়। ১৫০ মিলিলিটার তরল সিরিঞ্জ দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়ার পরই বিছিনায় ঠেলে ফেলে দেওয়া হয় তরুণীকে। শুরু হয় ধর্ষণ।

১৮ বছরের অপর এক তরুণী প্রথমে উত্তর ইরাকের তাল আফার শহরের আইএস গভর্নরের যৌনদাসী ছিলেন। তাকে গর্ভনিরোধক বড়ি খাওয়ানো ও ইঞ্জেকশন দেওয়া হত। পরে সেই গভর্নর এক কম বয়স্ক যোদ্ধার কাছে বেচে দেন ওই তরুণীকে। সেই যোদ্ধার মা মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল পরীক্ষা করানোর জন্য। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে মা তার ছেলেকে জানিয়েছিল, ইয়াজিদি তরুণীটি গর্ভবতী নয়। অর্থাৎ মা ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, এই তরুণীকে ধর্ষণ করতে কোনও বাধা নেই।

হাসপাতালে প্রত্যেক মাসে মূত্রের নমূনা পরীক্ষা করতে যাওয়ার দিনগুলোর কথা জানান অনেকেই।রিপোর্ট পজিটিভ হওয়ার অর্থ, তার গর্ভে ধর্ষকের সন্তান। রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ার অর্থ, আবার রোজ সন্ধে নামলেই ধর্ষিতা হতে হবে তাকে।

উল্লেখ্য, আইএসের হামলা থেকে আত্মরক্ষায় প্রায় পাঁচ লাখের মতো ইয়াজিদি নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে উত্তর ইরাকের কুর্দিস্তানের শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। আইএস জঙ্গীদের কাছে ধর্ষণের শিকার প্রায় ৭০০ ইয়াজিদি নারী ইরাকে জাতিসংঘ পরিচালিত একটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছেন। ওই ক্লিনিকের একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন, আইএসের হাতে বন্দি থাকার সময় এসব নারীদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ নারী গর্ভবতী হয়েছেন।

এই ক্লিনিকটির পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইরাকি স্বাস্থমন্ত্রণালয়ের দোহুক দপ্তরের প্রধান ড: নেজার ইসমেত তায়িব নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন, গর্ভবতী নারীর যে সংখ্যা তারা পেয়েছেন তার থেকে অনেক বেশি সংখ্যক পাওয়া যাবে বলে তারা ধারণা করেছিলেন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কয়েক হাজার নারী ও বালিকাকে অপহরণ ও ধর্ষণের জন্য আইএসকে অভিযুক্ত করেছে জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো। সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।

/এএ/বিএ/