দ্য গার্ডিয়ান

ব্রাসেলসে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ৩১



বেলজিয়ামের একটি বিমানবন্দর ও একটি মেট্রোরেলে মঙ্গলবার ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৩১ জন। আহতের সংখ্যা দুই শতাধিক। ভয়াবহ এ সন্ত্রাসী হামলার পর দেশটির রাজধানী ব্রাসেলসের সঙ্গে বিমান ও রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে ইউরোপ। হামলার দায় স্বীকার করে অনলাইনে বিবৃতি দিয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এর চেয়েও ভয়াবহ হামলা আসছে বলেও হুমকি দিয়েছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, বিবৃতিটি সঠিক হতে পারে। এ সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে বুধবার প্রধান শিরোনাম করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।

২২ মার্চ ২০১৬ মঙ্গলবার ব্রাসেলসের ব্যস্ততম জাভেনতেম বিমানবন্দর ও একটি মেট্রো স্টেশনে (পাতালরেল) এক ঘণ্টার ব্যবধানে এ জোড়া হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার পর বেলজিয়ামে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়। ইউরোপজুড়ে জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তাব্যবস্থা।

মঙ্গলবারের প্রথম হামলার ঘটনাটি ঘটে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো এবং ইউরোপের ২৮ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল ব্রাসেলসের ব্যস্ততম জাভেনতেম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। স্থানীয় সময় সকাল ৮টার দিকে (গ্রিনিচ সময় ৭টা) সেখানে পরপর দুটি বিস্ফোরণ ঘটে। দ্বিতীয় হামলার ঘটনাটি ঘটে এর এক ঘণ্টার মাথায়। এ হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল ম্যালবিক মেট্রো স্টেশন।

Guardian

জাভেনতেম বিমানবন্দরে বোমা দুটি বিস্ফোরিত হয় সেখানকার বহির্গমন হলে। আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হয়নি। সেটি পরে নিষ্ক্রিয় করে সেনাবাহিনী।

বেলজিয়ামের প্রসিকিউটর ফ্রেডরিক ভন লিউ বলেছেন, বিমানবন্দরে হামলায় সম্ভবত তিন জঙ্গি অংশ নেয়। এর মধ্যে দুজন আত্মঘাতী হামলা চালায়। এক হামলাকারীর মৃতদেহের কাছে পাওয়া গেছে একটি একে-৪৭ রাইফেল। তৃতীয় হামলাকারীকে ধরতে অভিযানে নেমেছে পুলিশ। সন্দেহভাজন এই তিন হামলাকারীর ছবি প্রকাশ করেছে দেশটির পুলিশ।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বোমা বিস্ফোরণের পর বিমানবন্দরে তারা রক্তের ভেতরে অনেক মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। অনেকের হাত-পা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উড়ে গেছে।

ব্রাসেলস ফায়ার সার্ভিসের মুখপাত্র পিয়রে মেইস বলেন, বিমানবন্দরে বোমা হামলায় কমপক্ষে ১৪ জন নিহত এবং ৯২ জন আহত হয়েছেন। বিমানবন্দরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) টুইটারে বলেছেন, বুধবার পর্যন্ত বিমানবন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।

দ্বিতীয় হামলাটি হয় ম্যালবিক মেট্রো স্টেশনে। এর কাছেই ইইউর প্রধান কার্যালয়। স্টেশন থেকে কর্মস্থলগামী মানুষজনকে নিয়ে কমিউটার ট্রেনগুলো তখন কেবল একের পর এক গন্তব্যে যাওয়া শুরু করেছিল। বিস্ফোরণের পর ব্রাসেলসের পুরো মেট্রো ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ব্রাসেলসের মেয়র ইভার মেইউর বলেছেন, স্টেশনে হামলায় ‘কমবেশি ২০ জন’ নিহত ও ১০৫ জন আহত হয়েছেন।

মেট্রো স্টেশনে এই সন্ত্রাসী হামলার পর ব্রাসেলসের যোগাযোগব্যবস্থা পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। বিমান ও রেল যোগাযোগের পাশাপাশি ব্রাসেলসের সড়ক যোগাযোগও স্থগিত করা হয়। পরে দুটি রেলস্টেশন খোলা হলেও প্রধান স্টেশনটি বন্ধ রয়েছে।

বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী চার্লস মিশেল রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে এই হামলাকে ‘অন্ধ, হিংসাত্মক ও কাপুরুষোচিত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ‘এটা বেদনার দিন; এটা একটি কালো দিন।’

বেলজিয়ামের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জান জামবোন হামলার ঘটনার পর দেশে সন্ত্রাসী হামলার সতর্কতা সর্বোচ্চ মান চারে উন্নীত করার ঘোষণা দেন। লোকজন যে যেখানে আছে, সেখানেই অবস্থান নিতে বলা হয়। এছাড়া দেশটির সব পারমাণবিক স্থাপনায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। হামলার ঘটনায় বেলজিয়ামে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে।

হামলার ঘটনার পর ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন রাজধানীতে সতর্ক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে লন্ডন, প্যারিস, ফ্রাঙ্কফুর্ট, আমস্টারডামসহ বড় শহরগুলোর বিমানবন্দর, সীমান্ত ও বন্দরগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি আটলান্টিকের ওপারে নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস, ওয়াশিংটনসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরের জনবহুল এলাকা ও রেলস্টেশনগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। বেলজিয়াম ভ্রমণে নিজ দেশের নাগরিকদের সতর্ক করেছে যুক্তরাজ্য।

এর আগে ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে একযোগে কয়েকটি স্থানে আইএসের হামলায় নিহত হন ১৩০ জন। ওই হামলার অন্যতম সন্দেহভাজন সালাহ আবদেসালামকে গত ১৮ মার্চ ব্রাসেলস থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে গ্রেফতারের পর থেকেই সতর্ক অবস্থায় ছিল বেলজিয়ামের কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আবদেসালামকে গ্রেফতারের মাত্র চার দিনের মাথায় জোড়া হামলায় রক্তাক্ত হলো ব্রাসেলস।

এদিকে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর বেলজিয়ামের পাশে দাঁড়িয়েছেন বিশ্বনেতারা। এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানসহ বিশ্বনেতারা।

বেলজিয়ামের শোকে সংহতি প্রকাশ করে নিউ ইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ভবনে এবং প্যারিসের আইফেল টাওয়ারে মঙ্গলবার রাতে বেলজিয়ামের পতাকার রঙে আলোকসজ্জা করা হয়।

জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এ হামলাকে ‘অত্যন্ত জঘণ্য’ বলে মন্তব্য করে বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও শান্তি অক্ষুন্ন রাখতে বেলজিয়াম ও ইউরোপ তাদের অঙ্গীকার রক্ষায় সঠিক পথেই কাজ করবে।

কিউবা সফররত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ হামলাকে ‘ভয়ানক’ বলে মন্তব্য করেছেন। ওবামা বলেছেন, ‘জাতীয়তা-বর্ণ-ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে আমাদের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিশ্বজুড়ে যারা মানুষের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে, আমরা তাদের পরাজিত করতে পারি; তাদের পরাজিত করবই।’

তিনি বলেন, ‘তারা যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করতে পারবে না। তারা কিছু সৃষ্টি করতে পারবে না। গোটা দুনিয়ার মুসলমানদের, কিংবা গোটা বিশ্বের মানুষদের দেওয়ার মতো কোনও বার্তা তাদের নেই। তারা কেবল মানুষের জন্য ভীতি তৈরি করতে পারে। তারা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে অসহনীয় করে তুলতে পারে, আমাদের বিভক্ত করতে পারে। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা করতে দেব, সন্ত্রাসীরা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারবে।’

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, আমরা কখনোই সন্ত্রাসকে বিজয়ী হতে দেব না।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, সন্ত্রাসের কোনো সীমানা নেই। সন্ত্রাসীরা বিশ্বময় মানুষের জন্য হুমকি। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এদের মোকাবেলা করতে হবে।

জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন, এ হত্যাযজ্ঞ হৃদয়বিদারক। সন্ত্রাস মোকাবেলায় আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ বলেছেন, ইউরোপ আক্রান্ত হয়েছে। সন্ত্রাস মোকাবেলায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপ লিওপোল্ড-এর কাছে এ ফোন করে এ ঘটনায় দেশটির জনগণের প্রতি সহমর্মিতা জানান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। তিনি বলেন, ব্রাসেলসে যারা সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে, তাদের মানবিক ও নৈতিক কোনো মূল্যবোধ নেই। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।

/এমপি/