সৌন্দর্যের সন্ধানে টাঙ্গুয়ার হাওরে

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা হাওড়ের জল

 

টলমলে নীল জল আকাশের রং চুরি করে নিত্য খেলা করে, পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে পরে সাদা মেঘের দল। সারি সারি গাছ প্রতিনিয়ত স্নান করে জলের বুকে পবিত্রতা আর স্নিগ্ধতার জানান দেয়। সূর্য একরাশ হাসি নিয়ে জেগে উঠে পাহাড়ের বুক চিড়ে। কল্পনা নয়, সত্যি এ যেন মর্তের মাঝে স্বর্গের হাতছানি। না এ চিত্র কোন বিদেশ বা হলিউডের সিনেমার নয় এদেশেরই একটি স্থানের, যার নাম টাঙ্গুয়ার হাওর।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ১৮ মৌজায়, ৫১টি জলমহালের সমন্বয়ে নয় হাজার ৭২৭ হেক্টর অঞ্চল নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওড় গড়ে উঠেছে। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বড় জলাভূমি। বর্ষাকালে হাওরটির আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার একর।

ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওড়। মেঘালয় পর্বত থেকে প্রায় ৩০টি ঝরনা এসে সরাসরি মিলেছে হাওরের পানিতে। সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলিতে সদা মুখরিত টাংগুয়ার হাওর। এটি মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম।

জীববৈচিত্র ও সৌন্দর্যের কারণে টাঙ্গুয়ার হাওরের সুনাম শুধু সুনামগঞ্জ বা বাংলাদেশেই নয়, দেশের বাইরেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। জীব বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ মিঠা পানির এ হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার অঞ্চল। প্রথমটি সুন্দরবন।

টাঙ্গুয়ার হাওড়ে সূর্যাস্ত

টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রবেশ মুখেই দেখা যায় সারি সারি হিজলগাছ। দেখে মনে হবে এই গাছগুলো হাওরে আগত অতিথিদের অভিবাদন জানানোর জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। মূল হাওরে প্রবেশ করলে হাওরের পানির নিচের দিকে তাকালে দেখা মিলবে হরেক রকম লতা-পাতা জাতীয় জলজ উদ্ভিদ। পানির নিচে সে এক অপরূপ সবুজের স্বর্গরাজ্য। টাঙ্গুয়ার হাওরে আরো আছে করচ, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলসি, নলখাগড়া, বল্লুয়া ও চাল্লিয়া জাতের উদ্ভিদ।

টাঙ্গুয়ার হাওর হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম একটি মিঠা পানির মাদার ফিশারিজ কেন্দ্র। স্থানীয়ভাবে ছয়কুড়ি কান্দা আর নয় কুড়ি বিল নামে পরিচিত এই বিশাল জলাভূমি শুধু পাখি নয়, মাছের জন্যও বিখ্যাত। একসময় টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ ছিল। এ হাওরের বিখ্যাত মাছের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় মহাশোলের কথা। মাছটির দুটি প্রজাতিই পাওয়া যেত এই হাওরে। এ ছাড়া রয়েছে গাং বাইম, কালবাউশ, তারা বাইম, বাইম, গুতুম, গুলশা, টেংরা, তিতনা, গইন্না, রুই, কাতল, চিতল, বোয়ালসহ আরো নানা প্রজাতির দেশি মাছ।

এই হাওরের জীববৈচিত্র্যের  মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি। এখানে প্রায় ৫১ প্রজাতির পাখি বিচরণ করে। এ ছাড়া ছয় প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, বেশ কয়েক প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির কিছু উভচর প্রাণী, ছয় প্রজাতির কচ্ছপ, সাত প্রজাতির গিরগিটিসহ নানাবিধ প্রাণীর বসবাস এই হাওরের জীববৈচিত্র্যকে করেছে ভরপুর।

আমাদের দেশীয় পাখিগুলো সারা বছরই খুনসুটি, জলকেলি আর খাবারের খোঁজে এক বিল থেকে আরেক বিলে ওড়াউড়ি করে মাতিয়ে রাখে এই হাওরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। শীত এলে আমাদের দেশি পাখির সাথে হরেক রকমের পরিযায়ী পাখিরা ভিড় করে টাঙ্গুয়ার হাওরে। তখন হাওরের শোভা বেড়ে যায় কয়েকশ গুণ।

 স্বাগত জানাবে হিজলের সারি

কীভাবে যাবেন:

সুনামগঞ্জ থেকে মোটর সাইকেল অথবা সিএনজিতে যেতে হবে তাহিরপুর। ভাড়া পরবে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। তাহিরপুর বাজার ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে সরাসরি টাঙ্গুয়ার হাওরে চলে যাওয়া যাবে। মোটর সাইকেল, সিএনজি ও নৌকার ভাড়া দরদাম  করে নিতে ভুলবেন না।

কোথায় থাকবেন:

টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে গেলে নৌকায় রাত্রি যাপন করাটা অনেক বেশি মজার। আপনি চাইলে থাকতে পারেন ওয়াচ টাওয়ারের পাশেই গোলাবাড়ীতে হাওড় বিলাস নামক রেস্ট হাউজে অথবা সরকারি ব্যবস্থাপনায় টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পের রেস্ট হাউজে, বেসরকারিভাবে নির্মিত খন্দকার আবাসিক হোটেলেও থাকতে পারবেন। আবার দিনে দিনে হাওর ঘুরে রাতটা তাহিরপুর পৌরসভার রেস্ট-হাউজে কাটিয়ে দিতে পারেন, তবে সেক্ষেত্রে আগে থেকে যোগাযোগ করে যেতে হবে।

ছবি: লেখক।

/এফএএন/