‘আমি কোনও কারণ ছাড়াই মিথ্যা বলি’

প্রশ্ন: আমার বয়স ৩১ বছর। আমি কোনও কারণ ছাড়াই মিথ্যা বলি। বানিয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। এটা কেন হয়?

উত্তর: আপনার এমন আচরণের পেছনে বেশ কিছু মনস্তাত্ত্বিক কারণ থাকতে পারে। আসলে অহেতুক মিথ্যা বলা বা কল্পনা করে গল্প বানানোর প্রবণতা (যাকে প্যাথলজিক্যাল লায়িং বা মিথোম্যানিয়া বলা হয়) সাধারণত গভীর মানসিক বা আবেগীয় চাহিদা থেকে জন্ম নেয়। এখানে কিছু সম্ভাব্য কারণ ও ব্যাখ্যা দেওয়া হলো-

১. মনোযোগ বা স্বীকৃতি চাওয়া (Attention-Seeking) - আপনি হয়তো অবচেতনভাবে আশেপাশের মানুষের মনোযোগ, প্রশংসা বা বিশেষ পরিচয় পেতে চান। মিথ্যা গল্প তৈরি করে আপনি নিজেকে আরও আকর্ষণীয় বা বিশেষ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন, যা সাময়িকভাবে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে।

২. বাস্তবতা থেকে পালানো (Escapism)- যদি আপনার দৈনন্দিন জীবন একঘেয়ে, অসন্তুষ্টিজনক বা চাপপূর্ণ মনে হয়, তাহলে মিথ্যা বলা বা গল্প বানানো একটি কল্পনার জগৎ তৈরি করতে সাহায্য করে, যেখানে আপনি নিজেকে বেশি সক্ষম, সফল বা সুখী হিসেবে উপলব্ধি করতে পারেন।

৩. নিজের পরিচয় নিয়ে দ্বন্দ্ব (Identity Issues) - কখনও কখনও মানুষ নিজের আসল পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না বা আত্মসন্দেহে ভোগে। সেক্ষেত্রে মিথ্যা বলা নতুন একটি ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে সাহায্য করে, যা বাস্তবের চেয়ে বেশি পছন্দনীয় মনে হয়।

৪. অভ্যাসগত সমস্যা (Habitual Behavior)- বারবার মিথ্যা বলার ফলে এটি একটি অটোমেটিক আচরণে পরিণত হতে পারে। শুরুতে ছোটোখাটো মিথ্যা বলার পর ধীরে ধীরে এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

৫. মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয় (Psychological Factors)- কিছু ক্ষেত্রে এটি নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, বা অন্যান্য মানসিক অবস্থার সাথে যুক্ত হতে পারে। আবার কেউ কেউ শৈশবে অবহেলা বা ট্রমার শিকার হলে এমন আচরণ গড়ে তুলতে পারেন।

৬. ডোপামিনের প্রভাব (Dopamine Rush) - মিথ্যা গল্প বলার সময় রোমাঞ্চ বা উত্তেজনা অনুভব করা যায়, যা মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ ঘটায়। এটি একটি রিওয়ার্ড সাইকেল তৈরি করতে পারে, যেখানে মিথ্যা বলার মাধ্যমে আপনি আনন্দ পেতে থাকেন।

কী করবেন? সচেতনতা বাড়ানো: প্রথমে নিজের এই প্রবণতা সম্পর্কে সৎ হোন এবং কোন পরিস্থিতিতে বা কোনও উদ্দেশ্যে আপনি মিথ্যা বলেন তা খুঁজে বের করুন।

বিকল্প খোঁজা: সত্য বলার চেষ্টা করুন, এমনকী যদি তা সাধারণও মনে হয়। সততার সাথে নিজের ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলুন।

মনোবিদের সাহায্য নিন: যদি এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন মনে হয়, তাহলে একজন সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্ট-এর সাথে কথা বলুন। থেরাপি (যেমন CBT) এই ধরনের আচরণ পরিবর্তনে কার্যকরী হতে পারে।

আত্ম-মূল্যায়ন: নিজের ইমেজ বা আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করুন। মিথ্যার পরিবর্তে বাস্তব দক্ষতা বা গুণাবলী বিকাশের দিকে মনোযোগ দিন। মনে রাখবেন, মিথ্যা বলা একটি লক্ষণ হতে পারে, কিন্তু এটি আপনার সমগ্র ব্যক্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করে না। সঠিক সাহায্য ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই অভ্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব।

প্রশ্ন: আমার বয়স ৩৫ বছর। আমি একটা টক্সিক সম্পর্কে আছি। সম্পর্কটা আমার জন্য ঠিক নয় এটা বুঝেও বের হতে পারছি না। সে মানসিকভাবে আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। অনেক অপমান করে। কিন্তু কয়েকদিন কথা না বললে আত্নসম্মান খুইয়ে আমি নিজেই কথা বলি। আমার এর আগে একটা ডিভোর্স আছে, একটা সন্তানও আছে। আমি চাই না আরেকটা ভুল সিদ্ধান্তে আমার সন্তানের জীবনটাও নষ্ট হোক। কীভাবে সরে আসতে পারি?

উত্তর: একটি বিষাক্ত সম্পর্ক (Toxic Relationship) থেকে বের হওয়া কঠিন, বিশেষত যখন একাকীত্বের ভয়, আবেগীয় নির্ভরতা বা আত্মসম্মান কমে গিয়ে থাকে। কিন্তু আপনি ইতিমধ্যে প্রথম ধাপটি পার করেছেন, এই সম্পর্কটি আপনার জন্য ক্ষতিকর তা স্বীকার করে নিয়েছেন। এখন ধাপে ধাপে সরে আসার জন্য কিছু পরামর্শ:

১. নিজের মানসিক অবস্থাকে প্রাধান্য দিন - এই সম্পর্কে থাকার শারীরিক ও মানসিক মূল্য (Stress, Anxiety, Self-doubt) লিখে ফেলুন। যখনই আপনি ফিরে যেতে চাইবেন, এই লিস্টটি দেখুন। -নিজেকে বলুন, ‘আমি এই অপমান, কষ্ট আর অনিশ্চয়তা পাওয়ার মতো অসহায় নই। আমার সন্তান ও নিজের জন্য লড়াই করা জরুরি।’

২. কন্টাক্ট ছিন্ন করতে প্রস্তুত হোন, ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়ান: প্রথমে বার্তা বা কথোপকথনের ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে দিন। যেমন: আগে দিনে ১০ বার কথা হতো, এখন ৩ বার করুন।

ব্লক/আনফলো করুন: যদি খুব কষ্ট দেয়, তাহলে তার সব মাধ্যম (ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া) ব্লক করে দিন। মনে রাখবেন, এটি আত্মরক্ষা, প্রতিশোধ নয়।

লেটার/মেসেজ লিখুন (কিন্তু সেন্ড করবেন না): আপনার সমস্ত ক্ষোভ, দুঃখ একটি ডায়েরিতে লিখে ফেলুন। এটি Emotions ক্যাথারসিস (মুক্তি) দেবে।

৩. সাপোর্ট সিস্টেম গড়ে তুলুন, বিশ্বস্ত কারো সাথে কথা বলুন: পরিবার, বন্ধু বা থেরাপিস্ট-যিনি আপনার পাশে থাকবেন। লজ্জা বা গ্লানি ফিল করবেন না। বিষাক্ত সম্পর্কে থাকা আপনার দোষ না।

সাপোর্ট গ্রুপ যোগ দিন: ফেসবুক বা স্থানীয় কমিউনিটিতে Toxic Relationship Survivors-এর গ্রুপ খুঁজে দেখুন। তাদের গল্প শুনলে আপনি একা নন তা বুঝবেন।

৪. আত্মসম্মান ফিরে পেতে কাজ করুন, সেলফ-কেয়ারের রুটিন: প্রতিদিন এমন একটি কাজ করুন যা আপনাকে গর্বিত করবে। যেমন: বই পড়া, হাঁটা, নতুন রেসিপি শেখা।

পজিটিভ অ্যাফার্মেশন: আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলুন: ‘আমি যোগ্য, আমি আমার ভালোবাসা ও শ্রমের মূল্য দিই। আমি শক্তিশালী।’

অতীতের সাফল্য মনে করুন: আপনার ডিভোর্সের পর আপনি কীভাবে সামলে উঠেছিলেন? সেই শক্তি আজও আছে!

৫. সন্তানকে কেন্দ্র করে ভাবুন - একটি বিষাক্ত সম্পর্কের প্রভাব শিশুর উপর দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে (Anxiety, Low Self-esteem)। আপনি যদি সুস্থ না থাকেন, তাহলে তাকে সাপোর্ট দিতে পারবেন না। তাকে বলুন: ‘আমরা দুজনেই একসাথে শক্তিশালী হবো।’ শিশুরা Resilient (লড়াইয়ের ক্ষমতা রাখে), কিন্তু তাদের জন্য আপনাকেই রোল মডেল হতে হবে।

৬. পেশাদার সাহায্য নিন - একজন কাউন্সেলর বা সাইকোলজিস্ট-এর সাথে কথা বলুন। তারা আপনাকে ট্রমা বন্ড (Trauma Bond) ভাঙতে এবং Boundary Setting শেখাতে সাহায্য করবেন। - যদি মানসিক নির্যাতনের মাত্রা বেশি হয় (Gaslighting, Threats), তাহলে লিগ্যাল হেল্প নিন (Domestic Violence Hotlines বা নারী সংগঠন)।

৭. ভবিষ্যতের জন্য প্ল্যান করুন, ফাইন্যান্সিয়াল ইন্ডিপেন্ডেন্সি: যদি অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল হন, তাহলে চাকরি বা স্কিল ডেভেলপমেন্টে ফোকাস করুন।

নতুন লক্ষ্য: একটি ছোট ট্রিপ, নতুন হবি বা কোর্সে ভর্তি হয়ে মনকে ইতিবাচক দিকে নিন।