কবিতা এবং চলচ্চিত্রের কথায় আমাদের মধ্যে এক ধরনের ইমেজ আসে। যা দিয়ে আমরা একটি থেকে আরেকটিকে আলাদা করি। কবিতায় এই ইমেজটা ভাব ও ভাষার আর চলচ্চিত্রে সেটা দৃশ্য ও শব্দের। কবিতার বেলায় যাকে বলতে পারি ভাব ও ভাষার ভেল্কি; আর চলচ্চিত্রের বেলায় দৃশ্য ও শব্দের ভেল্কি। ভাষার ভেল্কি সে তো যেনতেন ভেল্কিবাজের কাজ নয়। কাঁচামাল ছাড়াই সে ভেল্কি দেখিয়ে যাবে আচ্ছন্ন করে রাখবে! তখন এক ভাষার ভেল্কিবাজের কথা মনে করতে পারি–
‘‘Between my fingure and my thumb
The squat pen rests snug asa gun’’
– Seamus Heaney
আহা কী কথা! দুই আঙুলে কলম ধরে বন্দুকের ভেল্কি দেখাবেন উনি। এই আইরিশ তা দেখিয়েছেন বটে। সেটা ভাষা আর ভাবনার ভেল্কি, যাকে বলি কবিতা।
যদি Pen-এর জায়গায় Camera বসিয়ে দেই তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? ক্যামেরা মানে চলচ্চিত্রের কথা বলা হচ্ছে। এটাও তো ভেল্কির মতো হয়ে গেল। যদিও বলতে পারি কবিতা আর চলচ্চিত্র দুইটা দুই জিনিস কিংবা শ্লেষ মিশিয়ে বললে– কিসের সাথে কি পান্তা ভাতে ঘি। তারপরেও তারা মিলেমিশে যায়। যখন কবিতা সম্পর্কে বলি ভাব ও ভাষাগত ইমেজ তখন সেটার ভিজ্যুয়ালাইজেশনের জন্যে অনুভূতির দরকার পড়ে। কবিতার শব্দ, ছন্দ, বাক্য যে প্রবাহমানতা তৈরি করে সেটা অনুভূতির স্তরকে দখল করলে, সজাগ করলে মনের মধ্যে দৃশ্য তৈরি হয়। তখন চোখ বন্ধ করা কি খোলা সেটা কোন বিষয় থাকে না। অর্থাৎ ব্যাপারটা দাঁড়ায় মনের জানালা দিয়ে দেখা।
‘‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’
আধেকলীন হৃদয়ে ঘুরগামী–
ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’’’
– শক্তি চট্টোপাধ্যায়
এটা একটা কবিতা কিংবা বলতে পারি ভাষার ভেল্কি। এই ভাষার ভেল্কি একটা অনুভূতি তৈরি করে যা আমাদের আচ্ছন্ন করে আর তাই আমরা বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে কিংবা খোলা ময়দানে বসে চোখ বন্ধ করেই ‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া’র যে দৃশ্যগত ইমেজ সেটা ভিজ্যুয়ালাইজড করতে পারি। আর পুরো কবিতা যে-দৃশ্যচিত্র নির্মাণ করছে তাকে তো অনায়াসে বলা যায় মনের চোখ দিয়ে দেখা চলচ্চিত্র। এখানে তো একটা কাহিনি আছে। আর যে কাহিনি পরম্পরায় চলচ্চিত্রের দৃশ্যের পর দৃশ্য সজ্জিত হয়। আর তা দেখা হয় দু-চোখ দিয়ে। তবে দুটোরই উপলব্ধির জায়গাটা কিন্তু মগ্নচৈতন্যকেন্দ্রিক।
যেমন, মনে যদি অন্যকোনো ভাবনা খেলা করে তাহলে কবিতা হয় না। কবিতার জগত আসলে এক বিশুদ্ধ জগত যেখানে কোনো খাদ থাকে না। আর এই রকম খাদহীন কোনো পরিবেশ যদি কবিমন না পায় তাহলে কবিতা বিকলাঙ্গ হয়। আর বিকলাঙ্গতা নিয়ে বেশিদূর যাওয়া যায় না। কবিতার ক্ষেত্রে তাহলে মনের অনুভূতির ব্যাপারটা একটা শক্ত সত্য হয়ে দাঁড়ায়।
সিনেমার ক্ষেত্রে একটা শব্দগত সম্বোধন শোনা যায় আর সেটা হলো– কাব্যিক সিনেমা কিংবা সিনেমার এই দৃশ্যটা কাব্যিক হয়েছে। প্রশ্ন জাগতে পারে আসলে কিসের ভিত্তিতে সিনেমা কাব্যিক হয়ে ওঠে কিংবা কী থাকলে সিনেমার দৃশ্যকে কাব্যিক বলা যাবে? এ-প্রসঙ্গে কিছু বলা যাক। ব্যক্তিগত আর বিমূর্ত অভিব্যক্তির প্রকাশ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চলচ্চিত্রের দৃশ্যের ক্ষেত্রে। এটা তখনই ঘটবে যখন বাস্তব চরিত্র এবং ঘটনা স্রষ্টার মনন আর অনুভূতির প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে। তাহলে বলা যায়, মনন আর অনুভূতি ছাড়া কবিতা হয় না। তাহলে সিনেমা কাব্যিক করতে গেলেও মনন আর অনুভূতির একটা সংযোগ ঘটাতে হবে। প্রতীক আর ধ্বনিকল্প সেক্ষেত্রে একটা বড়ো ফ্যাক্ট। কবিতায় ভাষাগত জায়গা থেকে প্রতীকের ব্যাপারটা আসে আর চলচ্চিত্রে এই ভাষাটাকেই একটা দৃশ্যগত তাৎপর্য দান করা হচ্ছে। প্রতীকের নিজের জগৎ কিংবা পরিধিটা ছোট কিন্তু তার মধ্যে যে ব্যঞ্জনা ধরতে চান নির্মাতা সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ-সকল ক্ষেত্রে বিমূর্ত অভিব্যক্তি উঠে আসে যেখানে কোনো ভাষা থাকে না কিন্তু ভাবনাকে আলোড়িত করার জন্যে একটা আচমকা ইঙ্গিত থাকে। আর এই ভাবনা সংক্রমিত হয় আমাদের যাপিত জীবনের নিরিখে। কারণ বিমূর্ত যে-অভিব্যক্তি তা পূর্বাপর কোনো ঘটনার সঙ্গে সংশ্লেষ রেখেই আসে আর সেটা এমনভাবে করা হয় যেন আমাদের অনুভূতির স্তরে স্তরে ফিল্টার হয়ে আসে। এটা যদি না হয় তাহলে আমরা যে ব্যঞ্জনার কথা বলছি তা সম্ভব হবে না। আর ব্যঞ্জনার অনুপস্থিতি দৃশ্যকে কাব্যময় কিংবা চলচ্চিত্রকে কাব্যিক করবে না। আমরা পথের পাঁচালী সিনেমাটাকে আলামতের জন্যে নিতে পারি। পথের পাঁচালী উপন্যাসে দুর্গার সোনার কৌটা চুরির উল্লেখ আছে। কিন্তু সিনেমায় সেটা একটা গলার মালা। সেটা একটা হলেই হলো চুরি করেছে এটা তো প্রথমে মিলেছে। কিন্তু এটারও একটা ব্যাপার আছে। হরিহর যখন পরিবার গুটিয়ে নিশ্চিন্দিপুরের পাট চুকাচ্ছে তখন অপু, দুর্গার সেই চুরি করা সোনার কৌটা পায়। আর সেটা হাতে নিয়ে বাড়ির বাইরে বাঁশবনের দিকে নিক্ষেপ করে এবং তা গড়িয়ে গড়িয়ে শুকনা বাঁশ আর পাতার মাঝে হারিয়ে যায়। এটা উল্লেখ আছে উপন্যাসে। এবার এই দৃশ্যটার চলচ্চিত্রায়ন লক্ষ করি। অপুর হাত লেগে নারকেলের মালসা উপর থেকে পড়ে। আর তাতে দুর্গার চুরি করা গলার মালাটা তার চোখে পড়ে। গলার মালটা হাতে নিয়ে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর বাড়ির পাশে পানাপুকুরে সেটাকে ছুঁড়ে মারে। পানাপুকুরে সেটা পড়তেই এক হাত পরিমাণ একটা বৃত্ত তৈরি হয় যেখান থেকে পানা সরে গেছে। তারপর আবার ধীরে ধীরে পানা এগিয়ে আসতে থাকে। বৃত্তটা ভরাট হতে থাকে। এই যে-পানা ধীরে ধীরে আসছে এখানে একটা ছন্দ আছে। আবার এটার ব্যঞ্জনা আরও তাৎপর্যময়। যখন পানায় পুরো বৃত্তটা ভরাট হয়ে গেলো তখন যেন দুর্গাও মিশে গেলো। তখন আমরা বুঝতে পারি কিংবা যাপিত জীবনের সঙ্গে সংশ্লেষণ করে ভাবতে থাকি স্মৃতি এমন করেই ডুবে যায় আর তার ওপর প্রলেপ পড়ে সেটা চিরতরে হারিয়ে যায়। এখানে গলার মালাটা দুর্গার প্রতীক আর পানা দিয়ে ঢেকে যাওয়াটা দুর্গার চিরতরে চলে যাওয়ার প্রতীকে ধরা পড়েছে। এই দৃশ্যে কিন্তু কোনো সংলাপ নেই মানে ডায়লগ নেই। আর পুরো দৃশ্যটার হাহাকার একটা ব্যঞ্জনা তৈরি করে। তখন বলা যায় দৃশটা কাব্যিক। এখানে যদি উপন্যাসের সেই সোনার কৌটার ছুঁড়ে ফেলার দৃশ্যটা সরাসরি ধারণ করা হত তাহলে এই যে প্রতীক এবং ব্যঞ্জনা তা আসলে থাকত না। তখন দৃশ্যটার মধ্যে যে কাব্যময়তা সেটাও পাওয়া যেত না। এখানে চলচ্চিত্রের মধ্যে কবিতার একটা আবহ কিংবা উপস্থিতি লক্ষ করা গেলো। আবার কবিতার মধ্যেও চলচ্চিত্রের বিশেষ লক্ষণ পাওয়া যায়। অনেক কবিতায় সিনেমার মন্তাজ রীতি ব্যবহার লক্ষ করা যায়। প্রশ্ন জাগে মন্তাজ কী? ‘সম্পাদনায় একাধিক ইমেজ, শট বা দৃশ্যাংশ গ্রথিত করে যখন উপাদান অতিরিক্ত কোনো ভাবনা সৃষ্টি করা হয় তখন তাকে মন্তাজ বলে।’ অর্থাৎ মন্তাজ-এ খণ্ড খণ্ড চিত্রের বিভিন্ন অনুভূতি, দৃশ্য, গঠনরূপ মিলে একটা সৃজনশীল সংঘাতের মধ্য দিয়ে পরিলক্ষিত দৃশ্যের বাইরে অন্য একটি ভাবনা জাগ্রত করে। আর এই নতুন ভাবনার উপস্থিতিকে-ই সৃজনশীল সংঘাত হিসেবে বলা হচ্ছে। মন্তাজের ইমেজে সাজানো একটা কবিতার আলামত দেখা যাক।
‘‘বিবসনা বসুন্ধরা
সপ্তঋষির অন্ন জুড়ায়
গন্ধে বাতাস শিউরে ওঠে
আলোর দেশে ঝড় বয়ে যায়।
অনেক দূরে অরুন্ধতীর
ওষ্ঠ জ্বলে চোরের চুমায়
আর সমস্ত আকাশ জুড়ে
যুধিষ্ঠিরের কুকুর ঘুমায়।’’
– বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
এই কবিতায় অবক্ষয়ের মোটিফের যে উপস্থিতি তার একটা চরম প্রকাশ ঘটেছে মন্তাজ রীতির প্রয়োগের ফলে। এটা ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজের একটা প্রয়োগ।
২.
এবার একটু ভিন্ন জগতের সন্ধান করা যাক। এই জগৎ ভাবজগৎ, এই জগৎ ইন্দ্রিয়জগৎ। কবিতা যখন চোখ বন্ধ করে ভিজ্যুয়ালাইজ করা যাচ্ছে কিংবা অনুভূতি সঞ্চারণের জন্যে বাহ্যিক কোন অঙ্গ মুখ্য হয়ে উঠছে না তখন বলা যায় কবিতা ভাবজগতের বাসিন্দা। আর এই জগতে বৈষয়িক কোনো হিসাব-নিকাশ চলে না। কবিতা আসলে কি কিংবা কবিতার রহস্য কোথায়, এ-প্রসঙ্গে যদি বলা যায়– কবিতা হচ্ছে অনুভূতির লীলালাস্য আর দুটি চরণের মাঝে অক্ষরবিহীন যে ফাঁকা জায়গা সেখানেই থাকে কবিতার রহস্য বা ব্যাখ্যা। কবিতার রহস্য ব্যাপারটা একটু খোটকা লাগতে পারে। যেমন, কবিতা অনুভূতি সেটা না হয় অনুভব করা গেলো কিন্তু দুই চরণের মাঝে ফাঁকা স্থানে কবিতার রহস্য সেটা আসলে কী! এখানেই সন্ধান মেলে ভাবজগতের। কবিতার চরণে দৃশ্যমান যে শব্দগুলো পাওয়া যায় শুধু সেগুলো ধরলে কিংবা ব্যাখ্যা করলে কবিতার পুরো অর্থ দাঁড়ায় না। কবিতার একটা পুরো অর্থ দাঁড় করানোর জন্যে ভাবজগতের আশ্রয় নিতে হয়। যেমন :
‘আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’ এখানে ছাপা অক্ষরে বনলতা সেন সাধারণ এক নারী, যে কবিকে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল। কিন্তু এই ছাপার অক্ষর যখন ভাবজগতের বাসিন্দা হয় তখন বনলতা সেন হয়ে ওঠে শান্তির প্রতীক, হয়ে ওঠে কাল্পনিক প্রেমিকা, হয়ে ওঠে আপ্তমানবী। তখন আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে গান হয়ে আসে– দু-দন্ড শান্তি যে দেয়/ সেই তো বনলতা সেন। অর্থাৎ যেভাবে বলা যায়, শুভ্রতা মানে পবিত্রতা সেভাবে বনলতা সেন মানে শান্তি। এটা ভাবজগতের আচার। আবার এই বনলতা সেন ভাবজগৎ থেকে ইন্দ্রিয়জগতে ভর করলে বনলতা সেনের খোঁজে প্রেমিকরা বের হয়। তখন বনলতা সেন ভাবজগতেও থাকে আবার ইন্দ্রিয়জগতেও থাকে।
‘হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা’ ছাপার অক্ষরে নাবিকের কোনো নাম নাই, পরিচয় নাই। কিন্তু সন্ধানে পাওয়া যায়, এই হালভাঙা নাবিক ইথাকার রাজা অডিসিয়ুস। ভাবজগতে এর সন্ধান করলে দেখা মিলবে প্রতিটি গৃহত্যাগী কিংবা গৃহকাতর মানবের মনে একজন অডিসিয়ুসের বসত। কবিতার চরণে শব্দ দেখে যদি কবিতার ব্যাখ্যা করা যেতো তাহলে অডিসিয়ুসের সন্ধান পাওয়া যেতো না। তাহলে বলা যায়, ভাবজগতে বনলতা সেন, অডিসিয়ুস পূর্ণাঙ্গ কবিতা হয়ে উঠেছে।
এবার ইন্দ্রিয়জগতের প্রসঙ্গে আসা যাক। চলচ্চিত্র চোখ মেলে গ্রহণ করতে হয়। যখন বলা হয় উপভোগ্য কিংবা ‘এনজয়’ তখন ইন্দ্রিয়জগতের একটা ব্যাপার হয়ে ওঠে চলচ্চিত্র। তাহলে কি চলচ্চিত্রে কোনো রহস্য থাকে না, যেমন থাকে কবিতায়? কিংবা চলচ্চিত্রে, কবিতার মতো দুই চরণের মাঝে কি কোনো ফাঁকা জায়গা নাই যেখানে কোনো রহস্য থাকতে পারে? আরও খোলাসা করে বললে, চলচ্চিত্রে দৃশের পর যে দৃশ্য আসে সেখানে কি কোনো রহস্য থাকে কিংবা যাকে ব্যাখ্যার জন্যে ভাবজগতের আশ্রয় নিতে হয়? চলচ্চিত্রের কোনো দৃশ্যে দর্শক যখন ‘ক্যাথারসিসে’ আক্রান্ত হয় তখন তো ইন্দ্রিয়জগতের উপভোগ্যতা ছাড়িয়ে ভাবজগৎ প্রভাব বিস্তারী হয়ে ওঠে। তখন কাল্পনিক, ভ্রান্ত, বাণিজ্যিক কোনো দৃশ্যেও মনের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জন্ম নেয়। চোখ দিয়ে দেখতে দেখতে যখন চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে তখন ইন্দ্রিয়জগত আর ভাবজগতের একটা সম্মিলন ঘটছে। আর এই সম্মিলনে ভাবজগতের যে রেশ সেটাই দর্শককে তাড়িত করে। চলচ্চিত্র শেষ হওয়ার পর যে দৃশ্য দর্শক মনকে নাড়া দেয় সেটাই তাকে তাড়িত করে ভাবজগতের দিকে। তখন চলচ্চিত্র শুধু ইন্দ্রিয়জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। জাপানি চলচ্চিত্র রাশোমন-এ মাসাগো নামের যে নারীটির জটিল মনস্তত্ত্ব তুলে ধরা হচ্ছে সেখানে নারীটির ধর্ষিত হওয়ার ব্যাপারটি ইন্দ্রিয়জগতের খোরাক হলেও ভাবজগতকে আচ্ছন্ন করছে নানান প্রশ্নের আদলে। তাহলে বিষয়টা এমন দাঁড়াচ্ছে যে, কবিতা কিংবা চলচ্চিত্রে কোনো বিষয় একইসঙ্গে ভাবজগত ও ইন্দ্রিয়জগতে প্রভাব ফেলে একটা মেলবন্ধন তৈরি করে। যার ফল হিসেবে কবিতায় মোটিফ খুঁজি, চলচ্চিত্রে মোটিফ খুঁজি। ভাবজগত আর ইন্দ্রিয়জগতের যে-প্রসঙ্গ কবিতা এবং চলচ্চিত্রে আসছে সেখানে প্রাচীন ভারতীয় আলঙ্কারিকদের সন্ধান করা যায়। আর এই আলঙ্কারিকরা হাজির হন ‘রস’ নিয়ে। কবিতার ‘বনলতা সেন’ ভাবজগতে বিচরণ করলে একধরনের ‘রস’ আবার ইন্দ্রিয়জগতে আরেকধরনের ‘রস’ নিয়ে হাজিরা দিচ্ছেন। আর চলচ্চিত্রে দর্শক যখন কোনো স্বাভাবিক দৃশ্য দেখছে তখন ইন্দ্রিয়জগতে একধরনের ‘রস’ আর যখন ক্যাথারসিসে আক্রান্ত হচ্ছে তখন ভাবজগতে আরেকধরনের রসের উপস্থিতি ঘটছে।
৩.
চলচ্চিত্র অনেকগুলো শিল্পের সমন্বয়ে গঠিত একটা শিল্পমাধ্যম। আর এই অনেকগুলো শিল্পের মধ্যে কবিতারও একটা প্রভাব আছে। তবে আমরা যখন চলচ্চিত্র উপভোগ করতে চাই তখন মাথায় নিয়ে বসি না যে কিসের সমন্বয়ে কোনটা সৃষ্টি হল। কিন্তু চলচ্চিত্র দেখার সময় একটা অনুভূতি লাভ করি যেটা মনের গহীনে খূব সূক্ষ্ণভাবে প্রতিধ্বনি তৈরি করে আর তার রেশ থেকে যায়। এই রেশটা চলচ্চিত্রের খণ্ড খণ্ড বিভিন্ন দৃশ্যকল্পের সমন্বয়ে একটা যোগাযোগ তৈরি করতে চায় আমাদের জীবনাভিজ্ঞতার সঙ্গে। তাই চলচ্চিত্রের কোনো রোমান্টিক দৃশ্যে আমরা কবিতার চরণ বিন্যাসের মিল খুঁজি আর কবিতার চরণে খুঁজি জীবনকে। চলচ্চিত্রের এক একটি দৃশ্যকল্পনা সাহিত্যের শব্দের সমান, সিনেমার সিকোয়েন্স হল সাহিত্যের বাক্যাংশের সদৃশ, কাট ব্যবহৃত হবে বাক্যের কমা চিহ্নের স্বরূপ এবং চিত্রকল্পের সাদৃশ্য কল্পিত হবে সাহিত্যের উপমা বা অলংকার প্রকাশের ক্ষেত্রে। তবে এটাই যে শেষ কথা তাও কিন্তু নয়।
লেখক পরিচিত : সহকারি অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : বিচ্ছেদের মৌসুম (২০১৫), ঘটন অঘটনের গল্প (২০১১)। প্রকাশিত কবিতার বই : জীবনানন্দের ট্রাঙ্ক (বইমেলা ২০১৬)।