এটি তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘চিত্রা নদীর পারে’ চলচ্চিত্রের শেষাঙ্ক। ছবিটি যখন মুক্তি পায়, ১৯৯৮ সালে, সেই বছরই ছবিটি দেখেছিলাম, এবং ছবির অন্যান্য অংশ অতো ভালো করে মনে না থাকলেও উল্লিখিত অংশটি মনে গেঁথে গিয়েছিল। আজ প্রায় ১৮ বছর পর ছবিটি নিয়ে লিখতে বসার আগে আরো একবার ছবিটি দেখে নিই। কারণ সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কিছু লিখতে হবে এবং সেটা হতে হবে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট, তখন মনে পড়ে এই ছবিটির কথা। পুরো ছবিই সাম্প্রদায়িকতা ও সমন্বয়বাদের এক চমৎকার প্রদর্শনী, সেই সাথে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া মানুষ এখনো বড় হয়ে ওঠেনি, এখনো তারা ‘ছেলেমানুষ’, তানভীর মোকাম্মেল যেন ইঙ্গিত করলেন অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘খুকু ও খোকা’ ছড়াটির দিকে- ‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে/ খুকুর পরে রাগ করো।/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ ভারত ভেঙে ভাগ করো!/ তার বেলা?’
এই ‘বুড়ো খোকা’দের মতিভ্রম ঘটেছিল, তারা সমাজের প্রান্তিক মানুষদের মনে গেঁথে দিতে পেরেছিলেন যে, ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহমদ বলছেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে এটি ভারতের অভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী কোটি কোটি মুসলমানের নতুন আবাসভূমি হবে এবং এর ফলে ভারতের সাম্প্রদায়িক ও সংখ্যালঘু সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হয়ে যাবে’, কিন্তু এ ধারণা ছিল একেবারেই অবাস্তব। অধ্যাপক সালাহউদ্দীন যোগ করছেন, ‘পাকিস্তান আন্দোলন ছিল সাম্প্রদায়িক আন্দোলন; তবে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছিল নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।’
তবে ‘বুড়ো খোকা’দের এই ‘ছেলেমানুষী’ রূপকেই আটকে থাকেননি মোকাম্মেল, তিনি সাম্প্রদায়িকতার গভীরে প্রবেশ করতে চেয়েছেন। প্রবেশ করতে পেরেছেন বলেও বোধ করি। ছবিতে মিনুর বাবা শশীভূষণ সেনগুপ্ত (মমতাজউদ্দীন আহমেদ) আর খুলনা জেল ফেরত তার জ্যেষ্ঠ বন্ধু যতীনের (রামেন্দু মজুমদার) কথোপকথন থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। কেনো সাম্প্রদায়িক সমস্যা হচ্ছে সেটার একটি পরিষ্কার চিত্র মোকাম্মেল ফুটিয়ে তোলেন এই দৃশ্যে। যতীন কথায় কথায় যা বলেছেন, তার মর্মার্থ হল- পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ববঙ্গের মানুষের গণতন্ত্রের দাবি মেনে নিচ্ছে না, কারণ তারা এদেশের মানুষের জেগে ওঠাকে ভয় পায়। তাই বিষয়টিকে চাপা দিতে সংখ্যালঘু প্রসঙ্গ টানা হচ্ছে। যতীন বলছেন, ‘হিন্দু মুসলমান ব্যাপার না। একটা শ্রেণী জাগবে, একটার পতন হবে, এটাই ইতিহাসের নিয়তি।... পূর্ববঙ্গেও হিন্দু মধ্যবিত্ত ক্রমশ বিলিন হয়ে যাবে, আর মুসলিম মধ্যবিত্ত বিকশিত হবে। সেটাই ঘটছে।’
সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত এদেশের মানুষ একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে- রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সেই পরিবর্তন- এই পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় এখানকার মানুষ বুঝেছে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কল্পনা করা ছিল ‘সোনার পাথরবাটি’ মাত্র। ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহমদ বলছেন, “পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে বাঙালি মুসলমানদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যেই এই নতুন রাষ্ট্রের চরিত্র সম্বন্ধে মোহমুক্তি ঘটতে শুরু হলো। তারা উপলব্ধি করতে লাগল যে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী, যারা ছিল অধিকাংশই অবাঙালি, তারা ইসলাম ও জাতীয় সংহতির নামে এই বাংলাদেশকে তাদের অবাধ শোষণের ক্ষেত্রে পরিণত করেছে।”
শোষিত হওয়ার বোধ জেগে ওঠার সময়, সেই স্বপ্নভঙ্গের কালে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে পূর্ববঙ্গের মানুষ, তখন সুকৌশলে এই সংঘর্ষ তথা স্বাধীকারের আন্দোলনের উপর সাম্প্রদায়িকতার প্রলেপ লাগিয়ে দেয়া হয়। আর এই আবরণকে পুঁজি করে অনেকেই অবৈধ উপায়ে লাভবান হতে চেয়েছে। পার্থিব লাভালাভের সঙ্গেই সাম্প্রদায়িকতা জড়িত ওতপ্রোতভাবে, এর সঙ্গে ধর্মের যোগ তেমনটা নেই। ‘বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের চেতনার বিকাশ প্রসঙ্গে’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে এমনটাই দাবি করেন তানভীর মোকাম্মেল। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের সম্পর্ক সামান্যই। সাম্প্রদায়িকতাবোধ মূলত একটা ইহজাগতিক বোধ যার মূল উৎস নিজস্ব সম্প্রদায়ের জন্যে চাকুরি-বাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও আইনগত সুবিধাদি।’ এসব সুবিধাবাদের জন্য গোটা ভারতবর্ষই একসময় খুনের হোলিখেলায় মেতে উঠেছিল।
পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরির পেছনে দুটি শুভঙ্করের ফাঁকি ছিল বলে মনে করেন মোকাম্মেল। একটি হল পাকিস্তান তৈরির আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনার অভাব ছিল। অভাব এই কারণে, দেশভাগ যতটা না হয়েছে ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য, তারচেয়ে বেশি হয়েছে হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরকে অবিশ্বাস আর একে অপরের সঙ্গে দাঙ্গা ফ্যাসাদ করে। দাঙ্গার পেছনে লাভালাভের হিসাবের কথা তো আগেই বললাম। আর দ্বিতীয় ফাঁকিটি ছিল দ্বি-জাতি তত্ত্বের মূল ভিত্তিটাই। জাতি আর সম্প্রদায় দুটি ভিন্ন বস্তু। মোকাম্মেল বলছেন, “সম্প্রদায়গত যে ‘সাংস্কৃতিক’ পার্থক্য রয়েছে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের, তাকে ‘জাতীয়’ পার্থক্য বলে চালানো ছিল এক চরম ভণ্ডামি।” তো এই ফাঁকি পূর্ববঙ্গের মানুষের সামনে ধরা পড়ছিল দেশভাগের কয়েক বছরের মধ্যেই, বিশেষ করে যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা শুরু হচ্ছিল।
একদিকে এখানকার যে মুসলমান অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী, তারা বুঝতে পারল পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থেকে কলকাতার হিন্দু অভিজাত বা মধ্যবিত্তের মত জীবন কাটানো এখানে সম্ভব নয়। অন্যদিকে, মধ্যবিত্তেরই আরেকটি অংশ, নিম্নবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র এবং ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু যারা, তারা মনে করল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনের অবসান হলে তাদেরও দুর্দশা লাঘব হবে। কাজেই একটি বড় জনগোষ্ঠী একত্রিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বাইরেও কিছু লোক রয়ে গেল যারা একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করতে পারেনি। তারা এসময় সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে নিজেরা লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেছে। পাকিস্তানের পক্ষে আদর্শ ধারণ করার যুক্তি আসলে খোড়া যুক্তি। পেছনের কারণটা হল সংখ্যালঘুর বাড়িঘর, জমিজিরাত দখল করা। চলচ্চিত্রে আমরা দেখি কারো সম্পত্তি দখল করতে হলে সেই বাড়িতে ঢিল পড়তে শুরু করে। নয় তো সেই বাড়ির মেয়ে ধর্ষিত হয়।
ছবিতে শশীভূষণের বিধবা ভাতিজি বাসন্তি ধর্ষিত হওয়ার পরই কিন্তু শশীভূষণ ভেঙে পড়েন। চারদিকে দেশত্যাগের হিড়িক আর সাম্প্রদায়িক হামলার আতঙ্ক তাকে আরো মুষড়ে দেয়। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি দেশ ছাড়েন না। চিত্রা নদীর পারেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এমন ডামাডোলের ভেতরেও শশীভূষণের মত আরেকজন উকিলকে দেখা যায়, তার নাম শামসুদ্দীন (আমিরুল হক চৌধুরী)। তিনিও শশীভূষণের মতই সমন্বয়বাদী (syncretic)। শশীর মৃত্যুর আগে তিনি শশীদের বাড়িতে প্রায়ই আসতেন। কথা বলার বিষয় থাকতো ঐ একটাই, দেশে হচ্ছেটা কী। শশীভূষণ বন্ধু শামসুদ্দীনকে জানাতেন, মুসলমান প্রতিবেশী তাকে ইঙ্গিতে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলছেন। এ নিয়ে আক্ষেপ করতেন শশীভূষণ। শামুসদ্দীন তখন বলতেন কি করে পরিচিত অনেক উকিল আইনের মারপ্যাঁচ দিয়ে বড় বড় বাড়ি দখল করে নিচ্ছে পানির দরে। তখন শশীভূষণ ঠাট্টা করে শামসুদ্দীনকে জিজ্ঞেস করেন, সস্তায় যেহেতু বাড়ি কিনে অনেকে বড়লোক হয়ে যাচ্ছে, তার কী অবস্থা।
উত্তরে শামসুদ্দীন বলেন, ‘না ভাই অন্যের জিনিসে আমার লোভ নেই, ওতে বরকত হয় না, নিজে যা পারি হালালভাবে উপার্জন করে নেই। জব্বার উকিল কি বলে জানো, আরে আমি নাকি হিন্দুঘেষা, এদেশে এখন দেখি হক কথা বললে ওই টাইটেলই জোটে।’ এই সংলাপ থেকেই বোঝা যায়, হিন্দুদের ওপর যা চলছিল তা সমর্থন করতেন না শামসুদ্দীন। এছাড়া শশীভূষণের সাথে তার বন্ধুত্ব, হামলা হতে পারে এমন শঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে শশীভূষণের মেয়ে ও বড় বোনকে তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ দেয়া ইত্যাদি থেকেও বোঝা যায় শামসুদ্দীন বহু ধর্মের মানুষের মিলেমিশে থাকাটাকেই সমর্থন করতেন। যেহেতু তার বৈষয়িক লোভ ছিল না, অন্তত হারাম উপায়ে উপার্জনের লক্ষ্য ছিল না, তাই সাম্প্রদায়িকতা নয়, মিলেমিশে থাকার পক্ষেই ছিলেন তিনি।
শামসুদ্দীনের বন্ধু শশীভূষণের চরিত্র থেকেও এই সমন্বয়বাদ পাওয়া যায়। যেমন একদিন বড় বোন অনুপ্রভাকে টিটকারি মেরে শশীভূষণ বলছিলেন, ‘মুসলমানের ফলানো ধানচাল তো দিব্বি খাচ্ছো, হাতের ছোঁয়া লাগলে অনাসৃষ্টি।’ হিন্দুদের জাতপাত, শুচি, অশুচির ধারণাকে তিনি উড়িয়ে দিতে চান, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা নিয়ে নয়, মিলেমিশে বাঁচতে চান তিনিও। গরীব মক্কেলরা টাকা দিতে পারে না, তাও তিনি নড়াইল ছেড়ে কলকাতা যাওয়ার কথা ভাবেন না। ভাবেন এখানে মিলেমিশেই থাকবেন, নিজের দেশে। অবশ্য নিজের ছেলেকে তিনি কলকাতা পাঠাতে বাধ্য হন, যখন সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে শশীভূষণের ছেলে বিদ্যুৎ এক মুসলমানের দ্বারা প্রহৃত হয়। ছেলেই জেদ ধরেছিল কলকাতা যাবে। অথচ এই বিদ্যুৎই একসময় হরদম খেলেছে মুসলমান বন্ধুদের সাথে।
মোকাম্মেলের এই চলচ্চিত্রে শিশুদের মধ্যেও মিলেমিশে থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। যেন বড়রা নয়, ছোটরাই অনেক বেশি করে জানে কী করে সমন্বয় করে সংসারে টিকে থাকতে হয়। সেজন্যই বোধহয় মোকাম্মেল বনের ভেতর চড়ুইভাতির বিষয়টি রূপক আকারে হাজির করেন। সেখানে বিদ্যুতের সাথে বাদল বাজার করতে যায়, আর মিনতির সাথে সালমা এক চুলোতে রান্না চড়ায়। এরপর তারা একসাথে এক নদীতে গোসলও করে। তাদের মধ্যে শুচি-অশুচির বোধ দানা বেধে বিষবৃক্ষ হয়ে ওঠে না। দুর্গাপূজার সময় হিন্দু বন্ধুদের সাথে মুসলমান শিশুরাও মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরিতে লেগে যায়। ছোটবেলা থেকে এভাবে সকলের সাথে মিলেমিশে বড় হওয়ার কারণে, আর শশীভূষণের মত অসাম্প্রদায়িক বাবার মেয়ে হওয়ার জন্য বড় হয়ে মিনতি জাতপাতের বিষয়কে হেসে উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করে।
নদীতে একদিন পিসির সাথে মিনতি গোসল করছিল, এমন সময় একদল ছেলেমেয়ে ঝাপিয়ে পড়ে নদীর পানিতে। পিসির গায়ে স্পর্শ লাগলে তিনি বলে ওঠেন, ‘দিলে তো ছুঁয়ে, কী জাত না জাত!’ তখন মিনতি খুব একচোট হাসে। এই জাতপাতের বিষয়টি যে হাস্যকর- কী অনায়াসেই না তা বুঝিয়ে দেন নির্মাতা। শুধু তাই নয়, সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের আরো কার্যকরী সমাধানের দিকেও ইঙ্গিত করেন তিনি। হিন্দু মিনুর সঙ্গে তিনি মুসলমান বাদলের প্রেম ঘটিয়ে দেন। এমন মিশ্র সম্পর্ক যে সাম্প্রদায়িকতাকে হ্রাস করার ক্ষমতা রাখে সেটাও যেন আড়ালে বলে রাখতে চান মোকাম্মেল।
অবশ্য এসব ছাড়াও স্বাধীকার আন্দোলনের খণ্ড চিত্রও দেখি ছবিটিতে। এই আন্দোলনের পেছনে ছিল এক অসাম্প্রদায়িক নতুন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন। অধিকাংশ মানুষ তখন ভাবতে শুরু করল মুক্তিযুদ্ধ হলে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, ঠিক এই আকাঙ্ক্ষার কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশের একটি মূলনীতি হয়েছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, অর্থাৎ ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্র থাকবে নিরপেক্ষ, যদিও সেই শপথও বেশিদিন টেকেনি।
একাত্তরের সেই শপথ টেকা তো দূরের বিষয়, উল্টো সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে দিনের পর দিন, আর সেজন্যই সাতচল্লিশ পরবর্তী সরব দেশান্তরের মত না হলেও একাত্তর পরবর্তী সময়ে গোপনে দেশান্তরী হয়েছেন লাখ লাখ সংখ্যালঘু মানুষ। এখনো হচ্ছেন। এটা হয়েছে কারণ আমাদের সমাজে একদিকে সাম্প্রদায়িক স্বার্থ যেমন আছে, তেমনি আছে ধর্মকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার সংস্কৃতি, এই সংস্কৃতি পাকিস্তান আমলেও চর্চিত হয়েছে। এর আগেও চর্চিত হয়েছে পুরো ভারতবর্ষে। সংখ্যালঘুর ভাগ্য সবজায়গাতেই যেন একই। সেজন্যই বোধহয় মোকাম্মেরের ‘চিত্রা নদীর পারে’ চলচ্চিত্রের পাগল চরিত্রটি বলে, ‘যাচ্ছিস, না আসতেছিস? ঐ যাওয়া যা, আসাও তা!’ যারা যাচ্ছে, আর যারা আসছে, অর্থাৎ যারা দেশান্তরী হচ্ছে তারা একইরকম ভাগ্যের শিকার। একই সমস্যা মাথায় নিয়ে তারা দেশ ছেড়েছে, ছাড়ছে। মানুষ তো শখ করে নিজের ঘরবাড়ি, পরিচিত পরিবেশ ফেলে, অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়ায় না।
ইতিহাসের নানা পর্যায়েই মানুষের এই বাস্তুচ্যুত হওয়ার নজির রয়েছে এবং প্রতিবারই তারা সেটা করেছে বাধ্য হয়েই। ভারত উপমহাদেশে এই ঘটনা ঘটেছে বারবার। দেশত্যাগের এই নির্মমতার একটি ছোট উদাহরণ আমরা দেখতে পাই তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পারে’ ছবিতে। যেখানে আমরা দেখি, ষাটের দশকের শেষ ভাগে এসে মিনতিদেরও বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করতে হয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সাথে একটি ‘ছেলেমানুষী’ ছড়াকে সঙ্গী করে- “ওপেনটি বায়স্কোপ, নাইন টেন ট্রাইস্কোপ/ চুলটানা বিবিয়ানা, সাহেব বাবুর বৈঠক খানা/ লাট বলেছে যেতে, পান সুপারি খেতে/ পানের আগায় মরিচ বাটা, ইস্কাবনের ছবি আঁকা, ছোট ছোট যাদুমনি, যেতে হবে অনেকখানি, কলকাতা, কলকাতা, কলকাতা...”
দোহাই
১. তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত, কিনো আই প্রযোজিত, ‘চিত্রা নদীর পারে’ (১৯৯৮)। ডিভিডি, ঢাকা।
২. সালাহ্উদ্দীন আহমদ, ইতিহাস ঐতিহ্য জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র: নির্বাচিত প্রবন্ধ, প্রথমা (২০১৩), ঢাকা।
৩. তানভীর মোকাম্মেল, তানভীর মোকাম্মেলের প্রবন্ধ, আদম (২০১৫), কলকাতা।
৪. অন্নদাশঙ্কর রায়, অন্নদাশঙ্কর রায়ের শ্রেষ্ঠ ছড়া, চারদিক (২০০৪), ঢাকা।