২০১১ সালের কথা। হঠাৎ আমার বাসায় একটি ফোন এলো। কোনো ভূমিকা ছাড়াই একজন বলা শুরু করলেন, ‘আপনার ফোন নম্বরের শেষ চার ডিজিটে আমি অভিভূত হয়েছি! ১৯৭১! বাহ!’
পরিচিত কণ্ঠস্বর। খুব চেনা লাগছে। কিন্তু ধরছে পারছি না। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বললেন, ‘আমি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। কেমন আছেন দুলাল?’
আমি চমকে উঠি! তিনি আমাকে খুঁজে বের করেছেন। বললেন, ‘পরশু একবেলা আজিজুল মালিকের বাসায় থাকবো। আপনার সময় হবে? আসবেন?’
শহিদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ভাগ্নে আজিজুল মালিক আমার পুরনো বন্ধু। টরন্টোর ড্যানফোর্থে আমাদের পত্রিকা অফিসের প্রায় পাশাপাশি তার বাসা। ফলে আমার অফিসে এবং তার বাসায় নিয়মিত আড্ডা হতো। তিনি দোকান থেকে মাছ কিনে গাড়ির পেছনে রেখে আড্ডা দিয়ে ভুলে যান মাছের কথা। দুই দিন পর গাড়ি থেকে পচা মাছের গন্ধ বের হত! আবার আমরা আড্ডা দেয়ার জন্য ড্রাইভ করে মন্ট্রিয়লেও চলে গিয়েছি। এরমর ঘটনার শেষ নেই। কাজেই আজিজুল মালিকের বাসায় আড্ডা মানে ভিন্ন আনন্দ! তাই রাজি হয়ে গেলাম।
সেদিন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আজিজুল মালিক এবং আমি অর্থাৎ আমাদের আলাপ-আলোচনা, আড্ডা ছিলো নানামুখি। মূলত ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে ২০১১ সাল পর্যন্ত ইতিহাস জড়ানো বিষয়গুলো আমরা দুজন আগ্রহে উপভোগ করছিলাম। আমার আর আজিজুল মালিকের প্রশ্নই ছিলো বেশি। সেদিন প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ-পণ্ডিত বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ভূমিকা ছিলো অনেকটা উত্তরদাতার মতো। সেখানে তার জন্য এমন কিছু বিব্রতকর প্রশ্নও ছিলো, যা তিনি মনখুলে জবাব দিয়েছিলেন। তা আজিজুল মালিকের কথায় আমি লিখে রাখি। যা এখনো অপ্রকাশিত।
কথা প্রসঙ্গে জানালাম, আমি কানাডায় ১৯৭১ সালের ভূমিকা এবং অবদান নিয়ে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেছি, কানাডার পার্লামেন্ট থেকে একাত্তর সালের পুরো অধিবেশন জোগাড় করেছি, যেখানে বাংলাদেশের কথা আছে। অনেকের সাক্ষাতকার নিয়েছি। তখন আজিজুল মালিক বললেন, ভ্যাঙ্কোভারের যুদ্ধশিশু মনোয়ারাকে নিয়ে আমার উপন্যাসের কথা।
দুই.
যেমন, ২০১২ সালে ১৫ আগস্টে অন্টারিও আওয়ামী লীগের জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠান হয় ড্যানফোর্থের বাংলাদেশ সেন্টারে। সেই অনুষ্ঠানে তিনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কথা বলেন। তার একটি বক্তব্য নিয়ে পরদিন ইত্তেফাকে সংবাদ পরিবেশন করি। যার শিরোনাম ছিলো, বঙ্গবন্ধুর নামে বাংলাদেশের ইতিহাসের দরজা খুলে দিয়েছেন।
সেদিন তিনি আরো বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্যই বাঙালি জাতি স্বাধীন দেশের নাগরিক থেকে আজ বিশ্ব-নাগরিক হতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধুকে জানতে ও বুঝতে হলে সম্প্রতি প্রকাশিত তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’সবারই পড়া দরকার। তাতে তার ত্যাগের মহীমা উপলব্ধি করা যাবে। তাছাড়া এই বইটিতে রয়েছে বাংলাদেশ প্রস্তুতের ইতিহাস থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জন্মকথা পর্যন্ত!
আরেকবার প্রথম বাংলাদেশ ফ্যাস্টিভাল ২০১৫-তে তিনি এসেছিলেন বিশেষ অতিথি হয়ে। সেখানে আরো ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী, কবি ইকবাল হাসান, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, শিল্পী সৈয়দ ইকবাল, রয়েল পাবলিকেশনের জামাল উদ্দিন, নায়ক ফেরদৌস, কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিত প্রমুখ। ফলে উৎসব পরিণত হয়েছিলো এক মিনি বাংলাদেশে। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান আরো উজ্জ্বল এবং আলোকিত হয়েছিলো। সেদিনও তিনি ছিলেন মধ্যমণি!
তিন.
এক রোববারে বোরহান ভাইয়ের আবারো ফোন এলো। তিনি বললেন, ‘বিকেলে আপনাদের বাংলা পাড়ায় যাবো। আপনার সময় হবে? তাহলে দুজন এক সঙ্গে চা খেতে পারতাম।’
তিনি এলেন। আমরা জেরাড আর ভিক্টোরিয়া পার্কের ইন্টারসেকশনের টিম হর্টনসে বসলাম। আমি মিডিয়াম ডবল ডবল কফি নিলাম আর বোরহান ভাই স্মল চা নিলেন।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর আমাকে প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশ ছেড়ে আপনি কীভাবে পরবাসে থাকেন? অস্থির লাগে না?’
—আমি তো আসা-যাওয়া করছি। কিন্তু স্থায়ী থাকা কঠিন।
—তা তো কিছুটা বটেই। তবে আমিও ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
—তাই? পারবেন! কত দিন হলো?
—বারো বছর।
—একযুগ।
—অনেকেই তো এক জীবনই কাটিয়ে দিয়েছেন প্রবাসে।
—হুম, ওয়ালীউল্লাহ, শহীদ কাদরী, দিলারা হাশেম, গাফফার চৌধুরী। অবশ্য মধুসূদন ফিরে গেছেন।
—আমিও যাবো। বঙ্গ ভাণ্ডারে…
—যাবার আগে আপনার সেই কাজটা শেষ করে যাবেন। সেই যে বলেছিলেন, ‘কানাডায় ১৯৭১’ লিখছেন। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা ঐতিহাসিক কাজ। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আপনি তো কানাডায় এসেও বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরীকে নিয়েও দারুণ একটা বই লিখে জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনার দেশপ্রেমে আমি মুগ্ধ! আপনার ফোন নম্বরেও, ১৯৭১!
আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো একজন পণ্ডিতের মুখে নিজের প্রশংসা আর স্বীকৃতির কথা শুনতে শুনতে থ মেরে গিয়েছিলাম। আজ ভোররাতে জাহিদ সোহাগের কাছে তার মৃত্যুর খবর পেয়ে আবার থ মেরে গেলাম!
মনে পড়লো টরন্টোয় আমাদের দিনগুলোর কথা! চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমাদের শীতল হয়ে যাওয়া টিম হর্টনসের চা আর কফি!