সকল লোকের মাঝে ব'সে/ আমার নিজের মুদ্রাদোষে/ আমি একা হতেছি আলাদা?

noname

কবি সাহিত্যিকরা সাধারণত আড্ডাবাজ হন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশের ঢাকা শহরের বিউটি বোর্ডিং[১] ছিল লেখক-শিল্পী ও সাংবাদিকদের তীর্থস্থান। এখানে আড্ডা দেয়া অনেকেই (শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ) পরবর্তীকালে বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্যে অনন্য অবদান রেখেছেন। কলকাতায়ও নানা জায়গায় এবং নানা গ্রুপে সাহিত্যের আড্ডা হতো। কিন্তু সেসব লোকের মাঝে বসে ‘নিজের মুদ্রাদোষে’ জীবনানন্দ আলাদাই থেকেছেন। ভিড় এড়িয়ে গেছেন। নির্জনতাকেই ভালোবেসেছেন।

কলকাতার অলিগলিতে তার হাঁটার যে বিবরণ পাওয়া যায়, সেখানেও এটা স্পষ্ট যে, তিনি দল বেঁধে চলতেন না। বরিশালে থাকতে হাঁটতেন ছোটভাই অশোকানন্দকে সঙ্গে নিয়ে। আর কলকাতায় থিতু হওয়ার পরে মূলত একা। শেষদিকে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে তার সান্ধ্যকালীন হাঁটায় সঙ্গ দিতেন প্রতিবেশী সুবোধ রায়, কখনো সহকর্মী অজিতকুমার ঘোষ। তবে ফুটপাতে হাঁটার সময় এতটাই সাবধান থাকতেন যাতে পরিচিত কারো মুখোমুখি হতে না হয়। কী এক সঙ্কোচ তাকে ঘিরে থাকতো সব সময়। যেন কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো।

জীবনানন্দের কালে কলকাতা শহরকেন্দ্রিক বেশ কিছু সাহিত্যের আড্ডা হতো। কিন্তু সেসব আড্ডা তিনি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। এমনকি তিনি যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও সিটি কলেজে তার জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়েছেন—সেখানেই কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত কফি হাউজেও জীবনানন্দ খুব একটা আড্ডা দিয়েছেন, এমনটা জানা যায় না।

সৌম্যব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় কালি ও কলমের আড্ডার যে বিবরণ দিয়েছেন তা এ রকম, কলকাতা শহরের ১০/২ পটুয়াটোলা লেনের একচিলতে ঘরের আড্ডা চৌকাঠ পেরিয়ে বারান্দা উপচে বারপথে নামবে তাতে আর সন্দেহ কী! ভারতীয়’র কার্যালয়ের কিছু দূরে কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে ছিল কল্লোলের পাবলিশিং হাউজ। তবে আড্ডার আখড়াটি ছিল পটুয়াটোলা লেনের পত্রিকা দপ্তরে। প্রেমেন্দ্র মিত্র আবছা স্মৃতি ঘেঁটে এই ঘরের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘মেপে কখনো দেখিনি। তবে রাস্তার থেকে ক’ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছোট সরু রকটার পর যে মাঝারি মাপের বাইরের দরজা, তা দিয়ে ঢুকে যে ঘরটা পাওয়া যেতো তা লম্বায় হাত আষ্টেক আর চওড়ায় হাত পাঁচেকের বেশি নিশ্চয় হবে না। বাইরের দরজা দিয়ে ঢুকলে বাঁয়ে দেখা যেত একটা সতরঞ্চ ঢাকা চৌকি আর ডাইনে পুব-দক্ষিণ কোণে একটা ছোট পুরনো সেক্রেটারিয়েট টেবিল। আসবাবপত্রের মধ্যে এই দুটি ছাড়া সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওধারে একটা বইয়ের তাকই প্রাণ।’[২]

কল্লোলের আড্ডা জমকালো হয়ে উঠেছিল খুব অল্প সময়েই। এখানে যারা আসতেন তারা সকলেই কল্লোল ও পরস্পরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছিলেন। জীবনানন্দের ঘনিষ্ঠ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর মতো লোকেরা ছিলেন এই আড্ডার প্রাণ। কিন্তু জীবনানন্দ এখানে মাঝেমধ্যে এলেও আড্ডায় খুব একটা শামিল হয়েছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। সৌম্যব্রতও এই লেখায় কল্লোলে যেসব আড্ডাবাজের নাম উল্লেখ করেছেন, সেখানে জীবনানন্দ অনুপস্থিত। এই তালিকায় ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, দীনেশরঞ্জন দাশ, গোকুলচন্দ্র, সতীপ্রসাদ সেন, সুনীতি দেবী, যামিনী রায় প্রমুখ। এই আড্ডাতেই অবশ্য কাজী নজরুলকে দেখার কথা লিখেছিলেন জীবনানন্দ। যদিও তাদের মধ্যে কোনো কথাবার্তা হয়েছে বলে জানা যায় না।[৩]

কল্লোলের আড্ডার বিষয়ে বুদ্ধদেব বসু লিখছেন, ‘পাঁচ মিনিটের দূরত্বে থেকেও কল্লোল আপিসে তিনি (জীবনানন্দ দাশ) আসতেন না, কিংবা কদাচিৎ আসতেন; অন্তত আমি তাঁকে কখনো সেখানে দেখিনি। হ্যারিসন রোডে তাঁর বোর্ডিংয়ের তেতলা কিংবা চারতলায় অচিন্ত্যকুমারের সঙ্গে একবার আরোহণ করেছিলাম মনে পড়ে, আর একবার কলেজ স্ট্রিটের ভিড়ের মধ্যে আমরা কয়েকজন তাঁকে অনুসরণ করতে করতে বৌবাজারের মোড়ের কাছে এসে ধরে ফেলেছিলাম।’[৪]

যদিও জীবনানন্দ স্বয়ং ১৯৪৯ সালে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে একটি চিঠিতে লিখেছেন, কল্লোলের সেই ঘরটায় তিনি দু-চারবার নয়, দু’শোবার গিয়েছেন। এই চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন যে, কল্লোলের এই অফিসে তিনি সকালের দিকে যেতেন।[৫] এখানে বুদ্ধদেবের তথ্যের সঙ্গে গড়মিলের একটা কারণ হতে পারে এই যে, হয়তো ভিড়ভাট্টা আর বেশি লোকের সঙ্গ এড়াতে জীবনানন্দ কল্লোল অফিসে সকালে যেতেন। বুদ্ধদেবসহ বাকিরা আসতেন বিকালে। এ কারণে বুদ্ধদেবের সাথে এখানে তার দেখা হয়নি। আবদুল মান্নান সৈয়দ মনে করেন, জীবনানন্দ নির্জনতাকামী—অথচ সঙ্গকাতর বলেই সকালে যেতেন।[৬] এ সময় তিনি সওগাত অফিসেও যেতেন। পত্রিকার সম্পাদক নাসিরউদ্দীনের বরাতে বুদ্ধদেব (প্রাগুক্ত) জানাচ্ছেন, জীবনানন্দ এই অফিসে মাঝেমধ্যে যেতেন। এই পত্রিকায় তার একটি কবিতাও ছাপা হয়।

কলকাতা শহরের পি ১৩ (পরবর্তীকালে ৫৪) গণেশচন্দ্র এভিনিউয়ে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের পূর্বাশা পত্রিকার অফিস ঘিরেও ওই সময়ে একটা আড্ডা বসতো। জীবনানন্দ এর অদূরেই ১০ ক্রিক রোতে যখন স্বরাজ পত্রিকার অফিসে কাজ করেন, কাজ শেষে সঞ্জয়ের এই ডেরায় যেতেন। সোনালী দাস লিখছেন, পূর্বাশা বলতেই মনে আসে গণেশচন্দ্র এভিনিউয়ের আড্ডার কথা। বাংলাদেশের দিকপাল ব সাহিত্যিকরা সেখানে আসতেন। কেউ প্রত্যহ, কেউ মাঝেমধ্যে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ প্রমুখ। সরকারি চাকুরে অচিন্ত্যকুমার মফস্বলে থাকতেন। কলকাতায় এলে তিনিও এই আড্ডায় শামিল হতেন। তরুণ সাহিত্যিকদের মধ্যে আসতেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, রমাপদ রায় চৌধুরী প্রমুখ। তবে অন্য আড্ডার সঙ্গে পূর্বাশার আড্ডার একটা মৌলিক তফাৎ ছিল এই যে, এখানে যে বিষয় নিয়েই আলোচনা হোক না কেন, সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের একটা শাসন ও নিয়ন্ত্রণ থাকতো।

পূর্বাশার আড্ডায় নিয়মিত যেতেন জীবনানন্দের সুহৃদ রমাপতি বসু। বরিশালে থাকা অবস্থায় রমাপতির সঙ্গে জীবনানন্দের পত্রালাপে পরিচয়। তবে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ এই পূর্বাশায়। রমাপতি জানাচ্ছেন (আমার দেখা জীবনানন্দ) সেই স্মৃতিকথা। ‘পূর্বাশা কার্যালয়ে বসে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপ করছি। এমন সময় একজন খাঁটি বাঙালি ভদ্রলোক এলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্যর কাছে। পরনে ঢিলে হাতা পাঞ্জাবি ও ধুতি। অতি সজ্জন ও বিনয়ী বলে আমার মনে হলো। মুখে হাসি এনে নমস্কার জানিয়ে তিনি বললেন, আজই বরিশাল থেকে আসছি। সঞ্জয়বাবু অতি সজ্জন ও বিনয়ী ছিলেন। কাজেই উভয়ের মধ্যে এমন শিষ্টাচারপূর্ণ ও হার্দ্য আলাপ আলোচনা হতে লাগলো যে, তা দেখে আমি সত্যি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ভদ্রলোক বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট কবি। কিন্তু পরিচয় ছিল না বলে আমি তখন নিরব শ্রোতা। কিছুক্ষণ পর আমাকে দেখিয়ে সঞ্জয় ভট্টাচার্য ওই ভদ্রলোককে বললেন, এঁর সাথে পরিচয় নেই? ভদ্রলোক আমার দিকে কিছুক্ষণ এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন তিনি আমার মুখ দেখে আমার পরিচয়টা বার করার চেষ্টা করছেন। সঞ্জয় ভট্টাচার্য বললেন, ইনি জীবনানন্দ দাশ।

পূর্বাশার এই আড্ডা ছিল বেশ জমজমাট। জীবনানন্দ এখানে আসতেন মূলত সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে। কিন্তু সাহিত্যিক আড্ডায় অংশ নিতে নয়। এই একই ভবনের পাশের ফ্ল্যাটে ছিল চতুরঙ্গ পত্রিকার অফিস। সেখানেও লেখক সাহিত্যিক সাংবাদিকরা আসতেন। অনেক সময় পূর্বাশার আড্ডা উপচে পড়েছে চতুরঙ্গে, আবার চতুরঙ্গের আড্ডার ঢেউ চলে গেছে পূর্বাশায়।[৭] তবে এই আড্ডায়ও জীবনানন্দের খুব একটা অংশগ্রহণের প্রমাণ মেলে না।

জীবনানন্দের কালে কলকাতা শহরে শিল্প-সাহিত্যের আরেকটি বড় আড্ডা বসতো ২০২ রাসবিহারী এভিনিউয়ে বুদ্ধদেব বসুর বাসায়। যেটি ‘কবিতা ভবন’ নামেই পরিচিত। শুধু দেশ নয়, বিদেশের বহু লেখকও এই বাড়িতে আড্ডা দিয়েছেন। বলা হয়, এ বাড়ির দরজা সবার জন্য খোলা ছিল। এই বাড়ির অদূরেই ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডে থাকতেন জীবনানন্দ। মাঝেমধ্যে তিনি বুদ্ধদেবের কাছে আসতেন। তবে আড্ডায় বেশিক্ষণ থাকতেন না। কঙ্কাবতী দত্ত লিখেছেন, শুধু সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশের মতো বাংলা ভাষার কবি লেখকরাই যে এখানে নতুন জীবনবোধ আবিষ্কার করেছিলেন তাই নয়, ইউরোপ আমেরিকার বুদ্ধিজীবীরাও সুদূর পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ থেকে কবিতা ভবনে এসেছিলেন নতুন চিন্তার খোঁজে।[৮]

বুদ্ধদেব বসু তার ‘আমার যৌবন’ গ্রন্থে লিখেছেন : কোনো সাহিত্যিক আড্ডায় আমরা তাকে (জীবনানন্দ) টানতে পারিনি। কল্লোলের, পরিচয়ের, কবিতার আডডা তিনি সযত্নে এড়িয়ে চলেছেন। চিঠি লিখতেন সংক্ষেপে, শুধু কাজের কথা। যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে, সম্পূর্ণভাবে নিজের মধ্যে গুটানো।...এমন নিভৃত মানুষ আমি আর দেখিনি।’

বুদ্ধদেব অন্যত্র লিখেছেন, জীবনানন্দর স্বভাবে একটি দূরতিক্রম্য দূরত্ব ছিল—যে অতিলৌকিক আবহাওয়া তাঁর কবিতায়, তা-ই যেন মানুষটিকেও ঘিরে থাকতো সব সময়—তার ব্যবধান অতিক্রম করতে ব্যক্তিগত জীবনে আমি পারিনি, সমকালীন অন্য কোনো সাহিত্যিকও না। এই দূরত্ব তিনি শেষ পর্যন্ত অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন। সন্ধেবেলা লেকের দিকে তাকে বেড়াতে দেখতাম—আমি হয়তো পিছনে চলেছি, এগিয়ে গিয়ে কথা বললে তিনি খুশিও হতেন, অপ্রস্তুতও হতেন, আলাপ জমতো না; তাই আবার দেখতে পেলে আমি ইচ্ছে করে পিছিয়ে পড়েছি কখনো-কখনো, তাঁর নির্জনতা ব্যাহত করিনি।[৯]

শেষদিকে জীবনানন্দের সান্ধ্যভ্রমণের সঙ্গী সুবোধ রায়ও তার এই ঘুরকুনো বা আত্মগোটানো স্বভাবের সমালোচনা করেছেন। স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘হাজারবার বলেছি, আপনার মতো এমন ঘরকুনো, অসামাজিক লোক আমি আর দেখিনি। কত বড় কবি, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকারের চিঠি আপনার কাছে দেখেছি। কত অগণিত বন্ধু আপনার। অথচ কোথাও যায়-আসা নেই। মেলামেশা নেই—কী যে আপনার স্বভাব।’ স্ত্রী লাবণ্য দাশের বরাতে মি. রায় আরও লিখেছেন, ‘কত নামকরা লেখক মাথার দিব্যি দিয়ে সস্ত্রীক কতবার নিমন্ত্রণ করে গেছেন। উনি না নিজে যান, না যেতে দেন আমাকে।’[১০]

জীবনানন্দের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তাকে ‘নিঃসঙ্গ বিহঙ্গ’ বলে উল্লেখ করেছেন বাণী রায়। লিখেছেন, ‘তাঁর আত্মার একটি বিশেষ রূপ আমার চোখে পড়ল। আত্মগোপন। তিনি যে কবি, এই শোচনীয় ঘটনা বাইরের লোকের কাছে যেন তুলে ধরার নয়। সাহিত্য-আলোচনা ও মনুষ্য চরিত্র দর্শন কাম্য হলেও নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কবিতা নিয়ে কবিরূপে জনতার সম্মুখে উপস্থিত হবার বাসনা তাঁর ছিল না। তাই সভা ও সভার ফুলের মালা তাঁকে খুঁজে পায়নি। তিনি লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। কখনো কোনো সভায় নিজে যাওয়া যেত না তাঁকে।’[১১]

তার এই অন্তর্মুখী স্বভাবের সাক্ষ্য দিচ্ছেন সুহৃদ অমল দত্ত। যিনি একসময় নিরুক্ত পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং কিছুদিন জীবনানন্দের ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ির একাংশে ভাড়া থাকতেন : ‘কথাবার্তায় তাঁর চোখের চাউনি জিজ্ঞাসু ছিল না। খুব ঘনিষ্ঠ পরিচিতজন ছাড়া তিনি কারোর দিকেই সোজাসুজি তাকান না। পরিচয় না দিলে খুব অল্প লোককেই চিনতে পারতেন।’[১২]

বস্তুত জীবনানন্দের এই ‘আত্মগোপন’ গোপনীয় কোনো বিষয় ছিল না। নিজে নিজেকে জানতেন। সমাজ ও রাষ্ট্রকে জানতেন আরও বেশি। তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে বহু বছর এগিয়ে থাকা একজন কবি। ফলে তিনি আজ যা দেখছেন, অন্যেরা তা দেখেছে অর্ধ শতাব্দী পরে। ফলে অনেক লোকের মাঝে বসে সচেতনভাবেই তিনি নিজেকে আলাদা রেখেছেন। সবার মাঝে থেকেও নিজেকে আড়ালে রাখবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা তার ছিল। তার শেষদিককার সুহৃদ, ময়ূখ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত তরুণ স্নেহাকর ভট্টাচার্যর ভাষায়, ‘সবার থেকে আলাদা হবার পথের সব বাধা জয় করেছেন বলেই তো তাঁর নিজের বলার কথাটুকু আর কারুর নয়, একান্তভাবে তাঁরই; শুধু কথাটুকু নয়, ভঙ্গিটুকুও।’[১৩]

আরেকটু এগিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলছেন, ‘জীবনানন্দ একাকী নিজের মধ্যেই পথ খুঁজেছেন। কোনো মঞ্চে, কোনো শিবিরে, কোনো মিছিলে পা দেননি।...জীবনানন্দের ব্যক্তিত্ব অন্তর্মুখী, মন নির্জনতাপ্রিয়, পরিচিতদের কাছে লাজুক, নম্র, নির্বিবাদী কিন্তু নৈতিকতা ও স্পর্শকাতরতায় ভরা। তাঁর ব্যক্তিত্বের মূল কাঠামোর একাকিত্ব, তজ্জনিত অস্থিরতা ও মৃত্যুচিন্তা তাঁর জীবনদর্শনের একটি স্থায়ী ধ্রুবপদের মতন বারবার মুখ দেখিয়েছে।’[১৪]

কল্যাণকুমার বসু লিখছেন, ‘একাকী নিঃসঙ্গ কবি। তাঁর হাঁটাচলা দেখেও মনে হতো তিনি বড় নিঃসঙ্গ।...জীবনানন্দ নার্ভাস প্রকৃতির ছিলেন। চোখের দিকে তাকাতে পারতেন না। গলা নিচু ছিল, সেই কারণে ছেলেদের পড়াতে একটু অস্বস্তি বোধ করতেন। শেষদিকে আমার সঙ্গে একটা ব্যাপার নিয়ে তার বিচ্ছেদ ঘটে। যে কারণে হয়তো আমাকে এ ফুটপাতে দেখলেন, তো সঙ্গে সঙ্গে অন্য ফুটপাত ধরতেন।’[১৫]

সিরাজ সালেকীনের ভাষায়, জীবনানন্দ তার স্বভাবের কারণেই চির নিঃসঙ্গ। ভাবনাপ্রতিভায় বিশ্বাসী জীবনানন্দ আত্মিক উপলব্ধিতে স্বস্তি অনুভব করেছেন। কিন্তু প্রত্যক্ষ কোলাহলে বিপন্ন হয়েছেন সমবিপরীত মাত্রায়। এজন্যই সংঘে তিনি অনুপস্থিত, উপস্থিত হলেও স্বল্প সময়ের জন্য কিংবা বেশিরভাগ সময় রুদ্ধবাক।[১৬]

জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসের নায়কও প্রধানত তিনি। তার সমস্ত গল্প উপন্যাসের গল্পগুলো ঘুরেফিরে তার নিজের জীবনেরই কথা। সারা জীবন আড্ডা ও মজলিশ এড়িয়ে চলার বিষয়টিও তার গল্পে উপেক্ষিত থাকেনি। ‘মজলিশে’ শিরোনামে একটি গল্পের নায়ক থাকেন হ্যারিসন রোডে (৬৬ হ্যারিসন রোডে প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে জীবনানন্দ থেকেছেন জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময়)। তার এক ছাত্র ও সুহৃদ, নাম তিনকড়ি, এসেছেন একটি অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ করতে। তাদের কথোপকথন:

—কী হবে মজলিশে?

—গান হবে, সঙ্গত হাসি তামাশা, কথাবার্তা, ব্রিজ—এই আর কী!

তখন নায়কের প্রশ্ন : এতে কার কী লাভ?

তিনকড়ি এক আধ মুহূর্ত চক্ষুস্থির করে তাকিয়ে রইল। তারপর বললে—আপনি অবশ্যি সেই দলের লোক নন, তা আমি খুব ভালো করেই জানি।[১৭]

তবে গল্পের নায়ক কেন এসব আড্ডা এড়িয়ে চলেন, স্বগতোক্তির মতো তারও জবাব দিয়েছেন : ‘গাইতে পারি না, বাজাতে পারি না, ইয়ার্কিতেও এক হাত নেবার মতো কোনো প্রবৃত্তি মনের ভিতর খুঁজে পাই না।’ এই হলো জীবনানন্দের নায়ক। আড্ডা ও মজলিসে গিয়ে কার কী লাভ—আগে সে প্রশ্নই করেন। আড্ডায় গিয়ে কী বলবেন, তাও খুঁজে পান না। এমন লোক যে আড্ডায় গিয়েও অনেক লোকের মাঝে বসে একা হবেন, তা আর বিস্ময়ের কী! 

আবদুল মান্নান সৈয়দ এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, ‘সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকেও যিনি কিছুর মধ্যেই নন, সেই ভাবান্তরহীন কবি হলেন জীবনানন্দ দাশ। সমস্ত কিছুই তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন আর তারপর একের পর এক তাদের মুখগুলো ধূসর কুয়াশায় মুড়িয়ে দেন।[১৮] অন্যত্র (রচনাবলি, পৃষ্ঠা ৫৩২) লিখেছেন, ‘পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে এতটুকু সংযোগ ঘটাতেও তাঁর (জীবনানন্দ) যেন ছিল দ্বিধা; অথচ মানসিকভাবে তিনি ছিলেন জীবনের সঙ্গে তীব্রভাবে যুক্ত। কবি ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না তিনি। তাঁর জীবনই কবিতা, কবিতাই জীবন।...তাঁর উত্তেজনা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, অবিশ্বাস, দোলাচল নিয়ে জীবনানন্দ একাকী এবং জীবন যাপন করে গেছেন—ততদিন না ট্রামের আঘাত এসে তাঁকে নিয়ে গেছে এই জীবনের পারে।

টিকা ও উৎস নির্দেশ:

১. বিউটি বোর্ডিং : পুরান ঢাকার বাংলাবাজার সংলগ্ন, ১ শ্রীশদাস লেনে অবস্থিত একটি পুরনো ভবন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় এই বাড়ির মালিক ভারতে চলে যান। তখন এখানে গড়ে ওঠে একটি ছাপাখানা। তখন থেকেই বিউটি বোর্ডিং শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হয়ে যায়। একপর্যায়ে প্রেসের জায়গায় শুরু হয় আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁর ব্যবসা।

২. সৌম্যব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার সাহিত্য আড্ডা, পৃষ্ঠা ৭১

৩. আমার কথা, জীবনানন্দ রচনাবলি, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৩০

৪. বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে, কালের পুতুল, ১৯৫৯

৫. পত্রালাপ জীবনানন্দ, প্রভাতকুমার দাস সম্পাদিত, পৃষ্ঠা ১৭২

৬. আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলি, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৮২

৭. কলকাতার সাহিত্য আড্ডা, পৃষ্ঠা ১৩১

৮. কলকাতার সাহিত্য আড্ডা, পৃষ্ঠা ১৩৭

৯. বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, কবিতা, পৌষ ১৩৬১

১০. সুবোধ রায়, জীবনানন্দ স্মৃতি, মাসিক বসুমতি, অগ্রহায়ণ ১৩৬২

১১. বাণী রায়, নিঃসঙ্গ বিহঙ্গ, ময়ূখ, জীবনানন্দ স্মৃতিসংখা, পৌষ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৬১-৬২

১২. অমল দত্ত, স্মৃতিচিত্র, বিভাব (জীবনানন্দ স্মরণ সংখ্যা), পৃষ্ঠা ১৬০

১৩. স্নেহাকর ভট্টাচার্য, নির্জনতম কবি? বিভাব, পৃষ্ঠা ৫৫৮

১৪. বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর, বিভাব, পৃষ্ঠা ৫৯২

১৫. কল্যাণকুমার বসু, রবীন্দ্রনাথ অতুলপ্রসাদ জীবনানন্দ এবং একজন প্রবাসী বাঙালী, পৃষ্ঠা ৭৭

১৬. সিরাজ সালেকীন, জীবনানন্দ দাশ, পৃষ্ঠা ৪৩

১৭. জীবনানন্দ রচনাবলি, ঐতিহ্য, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭

১৮. সৈয়দ রচনাবলি, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৫৭

লেখক : জীবনানন্দ গবেষক