শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতা

‘কেমন করে পারো এমন স্বাভাবিক আর স্বাদু আহার
সব জায়গায় মানিয়ে যাও কিছুই তোমার নিজস্ব নয়
কেমন করে পারো?
নষ্ট তুমি নষ্ট তোমার আলগা শোভা বুকের বাহার
সমস্ত ফল ঠোঁটে জ্বালাও সবার সঙ্গে সমান প্রণয়
কেমন করে পারো?’

‘নষ্ট আমি কিছুই আমার নিজস্ব নয়; ডালে-ডালে
পাতায়-পাতায় স্বাদু আহার বিষ অথবা বাঁচার আগুন
ধরে ব্যাপক মাটি—
দীর্ঘতর বট, এমন জটিলঝুরি সমকালীন,
সব জায়গায় থাকি, আমার
অন্য একটি পাখি কেবল আড়াল করে রাখি।’

[দ্বা সুপর্ণা/শঙ্খ ঘোষ]

শঙ্খ ঘোষের অনেক কবিতাই পাঠকের মুখে মুখে ফেরে, কোনও কোনও কবিতার পঙক্তি তো প্রবাদ-প্রবচনের পর্যায়েই পৌঁছে গেছে, কিন্তু ‘দ্বা সুপর্ণা’ কবিতাটির কথা কখনো কোনো অগ্রজ-অনুজের মুখে শুনিনি, বা এখনো কোনো আলোচনায় উদ্ধৃত হতে দেখিনি। অথচ, এই কবিতাটির যে বৈশিষ্ট্য তাতে এমন কথা বলাই যায় যে, এটি তার বিষয়গত কারণেই নানাভাবে আলোচনাযোগ্য ছিল। অবশ্য এমনও হতে পারে যে, কবিতাটির অনেক রসিক পাঠক আছেন, তারা লেখেন না বলেই হয়তো আমরা সেকথা জানতে পারি না।

    কিন্তু এরপরও একথা মনে হওয়ার কারণ আছে যে, যে-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কবি এই কবিতাটি লিখেছেন, তাঁর অনেক পাঠকই নানা কারণে সেই মূলাধারে পৌঁছতে পারছে না। যারা উপনিষদের মনস্বী পাঠক, কবিতাটি পড়ামাত্রই তাদের মনে হবে এর উৎস মুণ্ডক উপনিষদ-এর ৪৫ সংখ্যক শ্লোক; কিন্তু তারপরও একথা বলা যায় না না যে, এটি অবিকল ওই শ্লোকের আলোকেই রচিত, বরং একটি কবিতায় চিরায়ত প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ উপস্থাপনের যে সদর্থ বিবেচনা থাকে, তার নজির এ কবিতাটিতে পুরোপুরি বর্তমান। প্রথমে শ্লোকটি পড়ে দেখা যেতে পারে :

দ্বা সুপর্ণা সজুযা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।
তয়োরণঃ পিপ্পলং স্বাদ্দত্ত্যনশ্নন্নন্যোহবিচাকশীতি॥

অতুলচন্দ্র সেনকৃত সরলানুবাদ :
সর্বদা যুক্ত পরস্পর সখ্যভাবাপন্ন দুইটি শোভন-পক্ষ পক্ষী (জীবাত্মা ও পরমাত্মা একই দেহবৃক্ষকে আশ্রয়পূর্বক পরস্পর আলিঙ্গন করিয়া আছে। তাহাদের মধ্যে একজন (জীব) দেহ-বৃক্ষের বিচিত্র আস্বাদযুক্ত ফল (সুখ-দুঃখাত্মক কর্মফল) ভোজন করে, অপরটি কিছু ভক্ষণ না করিয়া কেবল দর্শন করে। 

ক্ষিতিমোহন সেন প্রবাসী পত্রিকায় লিখেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুর আগে মুণ্ডক উপনিষদ-এর দ্বা সুপর্ণা শ্লোকটি অনুবাদ করেছিলেন, কেন করেছিলেন জানি না, এখানে সেই অনূদিত শ্লোকটি উদ্ধৃত করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু তার খোঁজ এখন পাওয়া কঠিন। আমরা এখানে অতুলচন্দ্র সেনের অনুবাদটি পাশাপাশি রেখে পড়ে দেখতে পারি শঙ্খ ঘোষের পুরো কবিতাটি : 

‘কেমন করে পারো এমন স্বাভাবিক আর স্বাদু আহার
সব জায়গায় মানিয়ে যাও কিছুই তোমার নিজস্ব নয়
কেমন করে পারো?
নষ্ট তুমি নষ্ট তোমার আলগা শোভা বুকের বাহার
সমস্ত ফল ঠোঁটে জ্বালাও সবার সঙ্গে সমান প্রণয়
কেমন করে পারো?’

‘নষ্ট আমি কিছুই আমার নিজস্ব নয়; ডালে-ডালে
পাতায়-পাতায় স্বাদু আহার বিষ অথবা বাঁচার আগুন
ধরে ব্যাপক মাটি—
দীর্ঘতর বট, এমন জটিলঝুরি সমকালীন,
সব জায়গায় থাকি, আমার
অন্য একটি পাখি কেবল আড়াল করে রাখি।’

শুধু নামের কারণে নয়, বিষয়বস্তুর সঙ্গে উদ্ধৃত সরলানুবাদ মিলিয়ে দেখলেই মনে হয় ওই শ্লোকটিই হচ্ছে কবিতাটির উৎসস্থল। অবশ্য কবিতাটির যে মুদ্রিত রূপ এখানে লক্ষ করছি, তাতে বোঝা যায় এখানে কবি নিজেই সেই কথাটি বুঝিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী যে, এর মূল ভাবটুকু ওখান থেকেই নেওয়া, না হলে আর যাই হোক অন্তত এই শিরোনামটি তিনি কোনোভাবেই গ্রহণ করতেন না। এই কথার পক্ষে অন্য যুক্তি হলো : দুটি স্তবকই এখানে উল্লিখিত হয়েছে কথোপকথনের ভঙ্গিতে, উদ্ধৃতিচিহ্নের মাধ্যমে; আর, এখানে উপনিষদ-এর প্রসঙ্গটি হয়তো এজন্যেই সরাসরি নিয়ে আসেননি যে, তাঁর কাছে মনে হয়েছে শ্লোকটি পাঠকের অপরিচিত থাকার কথা নয়।

     সে যাই হোক, কবিতাটির উৎস সন্ধান করা এ লেখাটির উদ্দেশ্য নয়; উদ্দেশ্য হলো, একটি পরিচিত শ্লোকের বিষয়কে জরিয়া করে কবি যে এতে অন্য আরেকটি বিশেষ অর্থের ব্যঞ্জনা সঞ্চারিত করেছেন সেই বিষয়টির উল্লেখ করা। নিজে যখনই কবিতাটি পড়ি তখনই ওই শ্লোকটির কথা মনে পড়ে ঠিক, কিন্তু কখনও এই কথাটি মনে হয় না যে, কবিতাটি ওই শ্লোক-নির্দিষ্ট প্রবণতার আড়ালে পড়ে গেছে। এই ধরনের কবিতার ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কী হতে পারে?

    যাদের মনে এই শ্লোকপাঠের স্মৃতিটুকু প্রবল, তাদের কাছে প্রথম স্তবকটিকে জীবাত্মার উদ্দেশ্যে কারও/পরমাত্মার প্রশ্নমূলক ভাষ্য বলে মনে হতে পারে, আর দ্বিতীয় স্তবকটিকে মনে হতে পারে তারই কোনও জবাব। কিন্তু আমার কাছে কবিতাটি অন্য অর্থ নিয়ে উপস্থিত : প্রথম স্তবকটিকে মনে হচ্ছে, কোনও একনিষ্ঠ/একচারী প্রেমিকার জিজ্ঞাসা আর দ্বিতীয় স্তবকটিকে মনে হয় কোনও বহুচারী প্রেমিকের জবাব, এবং শ্লোক-বর্ণিত বিষয়-অনুষঙ্গগুলো এখানে ভাবপ্রকাশের মাধ্যম মাত্র, অন্য কিছু নয়।

    এখানে একনিষ্ঠ কেউ তার পাখিরূপী প্রেমিককে জিজ্ঞাসা করছে, কীভাবে সে এমন স্বাদু আহার (গ্রহণ) করতে পারে, কীভাবে সে সকল জায়গায় মানিয়ে যায়; হয়তো এ কারণেই পরের পঙক্তিতে তাকে সম্বোধন করা হয় ‘নষ্ট তুমি’ বলে, অর্থাৎ ‘নষ্ট তুমি, নষ্ট তোমার আলগা শোভা বুকের বাহার’, আর বলছে, সমস্ত ফল ঠোঁটে জ্বালাও সবার সঙ্গে সমান প্রণয়/কেমন করে পারো?’

   এই পর্যন্ত এসে কবিতাটি যদি শেষ হয়ে যেত তাহলে আর কবিতাটিকে নিয়ে আলোচনা করার দরকার পড়ত না, বড়োজোর এটিকে তথ্যসরবরাহকারীর মর্যাদা দিয়ে প্রসঙ্গটির ইতি টানা যেত। কিন্তু ঠিক এই জায়গায় এসেই কবিতাটি তার আসল ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির। প্রথমে উদ্দিষ্ট নিজেকে প্রশ্নকর্তার ‘নষ্ট’ অভিধাকে মেনে নিয়ে বলছে : ‘ডালে-ডালে/ পাতায়-পাতায় স্বাদু আহার বিষ অথবা বাঁচার আগুন/ধরে ব্যাপক মাটি—/দীর্ঘতর বট, এমন জটিলঝুরি সমকালীন,/সব জায়গায় থাকি, আমার/অন্য একটি পাখি কেবল আড়াল করে রাখি।’ নিশ্চিত করে বলা যাবে না এখানে জীবননাশক ‘বিষ’ শব্দটিকে কেন ‘স্বাদু আহার’ বলে বিশেষায়িত করা হলো, এরপরেই আছে ‘বাঁচার আগুন’; কেন? নিশ্চয়ই এর উল্লেখ ‘বিষ’-এর বিপরীতার্থক বলে, কিন্তু লক্ষ্যযোগ্য ব্যাপার হলো, এখানে সেটি ব্যবহৃত হয়েছে ‘অথবা’র পরে, এই ‘অথবা’টি অনেকটা বিপরীতার্থক দ্বন্দ্ব সমাসের মধ্যবর্তী সংযোজকের মতো ব্যবহৃত। এখানে উদ্দিষ্টকে উপনিষদের সূত্রে পরমাত্মারূপে ধরে নিলে, ‘বিষ অথবা বাঁচার আগুন’-এর তাৎপর্যে পরমাত্মাকে ‘জীবন-ধারণে-ক্লান্ত’ কারও রূপে কি কল্পনা করা যায়?

   কবির উদ্দেশ্য যাই থাক, এই ভাবনাকে অতিকল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, কারণ, বাউলকবি জালাল উদ্দিন খাঁও তাঁর গানে পরোক্ষভাবে পরমকে ‘বুড়া আদমি’ বলে সম্বোধন/কল্পনা করেছিলেন, সারামাগাও তাকে নিয়ে ঠাট্টামশকরা কম করেননি। এরপরেই আছে, ব্যাপক মাটি, দীর্ঘতর জটিলঝুরি সমকালীন, সব জায়গায় থাকি ইত্যাদি ইত্যাদি—এই সবকিছুই এসেছে পরমাত্মার রূপের অস্তিত্বের সর্বময় অবস্থান ও চিরকালিক বিস্তারকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। কবিতাটির শেষের বাক্য : ‘অন্য একটি পাখি কেবল আড়াল করে রাখি’, এর মাধ্যমে পরমাত্মার অতিলৌকিক রূপটি যেমন দেখি, তেমনই এর লৌকিক বাস্তবও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়। আমরা এই জায়গায় পদাবলির কৃষ্ণের কল্পনা করতে পারি, বা কোনো বহুচারী প্রেমিককেও ধরে নিতে পারি যে কি না ষোলো শ গোপিনী বা অনেকের সঙ্গে লীলা করতে অকুণ্ঠ। আর জীবাত্মার জায়গায় রাধার সেই বিরহ-দগ্ধ রূপটিকে কে না চেনে, সেই নারী ‘শ্রীকৃষ্ণ-বিচ্ছেদের অনলে’ যার অঙ্গ, যার মন নিরন্তর পুড়ে চলেছে...।

  এছাড়াও, এই সবকিছুর বাইরে এসে, এ কবিতার সূত্রে আমাদের সমাজের বর্ণচোরা মানুষের কথাও কি মনে পড়ে না?