মৃত্যুকল্প ও কল্পমৃত্যুর অমীমাংসিত সন্দর্ভ

[বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক কাজী আনিস আহমেদ-এর ৫১তম জন্মদিন আজ রোববার। তার লেখালেখির সূচনা কৈশোরেই, বাংলা ও ইরেজি ভাষায়। ‘চল্লিশ কদম’ উপন্যাসিকা প্রথম প্রকাশিত হয় আমেরিকার মিনেসোটা রিভিউ-এ, ২০০০ সালে। গল্পগ্রন্থ ‘গুড নাইট মি. কিসিঞ্জার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ বাংলাদেশে প্রকাশ করে ইউপিএল, ২০১২ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্রে দ্যা আননেমড প্রেস, ২০১৪ সালে। উপন্যাস ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন মাই হ্যান্ডস’ প্রকাশ করেছে ভিনটেজ/র‌্যানডম হাউজ, ২০১৩ সালে। তার সবগুলো বই কাগজ প্রকাশন থেকে বাংলায় অনূদিত হয়েছে। কাজী আনিস আহমেদের জন্ম এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা ঢাকাতেই, সেন্ট জোসেফ ও নটরডেম কলেজে। উচ্চতর শিক্ষা আমেরিকায়-ব্রাউন, ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে যথাক্রমে সাহিত্যে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও ডক্টরেট। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা ট্রিবিউন-বাংলা ট্রিবিউনের প্রকাশক।]

‘আমি যদি কোনোদিন চলে যাই এই আলো অন্ধকার ছেড়ে,
চলে যাই যদি আমি অন্য এক অন্ধকার-আলোর আকাশে,
পায়ের অক্ষর যদি মুছে যায় যদি এই ধুলোমাটিঘাসে,
ওগো পথ,-একজন চলে যাবে তবে শুধু,-...’
(জীবনানন্দ দাশ)
এভাবে তো প্রায় সকলেই ভাবে। ভাবে না? উদাস ধানখেতের ওপরের শূন্যতাকে দুলিয়ে যাওয়া বাতাস ছুঁয়ে গেলে বুকটা হু-হু করে বলে তখন কি দীর্ঘশ্বাস পড়ে না? পড়েই তো! তারপর নিজেকে সান্ত্বনা দেয়া, এই আলো-আঁধারির বেঁচে থাকা, এত যে সঞ্চয়, বিশ্বাস, ভালোবাসা, সাফল্য ফেলে অন্য কোনো অজানার কাছে চলে যাব-ভাবতে ভাবতে উদাস নীরবতা নিশ্চয়ই কারও পদচারণে ভেঙে যায়। ঘোর কাটে, আর মৃত্যুকল্পনার বিস্তৃত আকাশ মুছে যায়, মুছে যায় বাস্তবের পদক্ষেপে। এ তো গেল আমাদের মৃত্যুকল্পনা। মৃত্যুকল্প। কিন্তু যদি কল্পিত মৃত্যুর কথা বলি? যাকে মৃত্যুকল্প নয়, বলব কল্পমৃত্যু? 
হ্যাঁ। চিত্রকল্প আর কল্পচিত্রের সূক্ষ্ম বিভেদের মতো, ভেবে দেখলে মৃত্যুকল্প আর কল্পমৃত্যুর মধ্যেও বিস্তর চলাচল। চিত্রকল্পে যেমন একটা অদেখা চিত্রকে কল্পনা করতে করতে ক্রমশ বুননমায়ায় গড়ে ওঠে এক অন্য জগৎ, যে চিত্রকে কল্পনা করি, এমনটা ঘটবে কি না জানি না...আর অন্যদিকে কল্পচিত্র, কল্পনার সমস্তটা চিত্রিত হতে হতে ক্রমশ গ্রাস করে চেতনাকে, যখন আর অনুভবের সামান্যকে নিয়ে বিস্ময়ঘোর কাটে না, কল্পনার কোন অবচেতন এমন চিত্রিত ভুবন গড়তে চলেছে...চিত্রকল্পের এই কল্পিত চিত্রটির বাস্তব ভিত্তি-আশ্রয় নিয়ে তর্ক-প্রতর্ক সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে, তার বাস্তবায়নের দায় নেই, তা কেবল যেমন নান্দনিক সৌন্দর্য পরিস্ফুটনের মাধ্যম হিসেবেই কল্পিত, কল্পচিত্রের ক্ষেত্রে ততটা নয়। যেন কল্পচিত্রের বাস্তবতা এক অতিবাস্তবিক বাস্তব ভিত্তিতে রচিত। তার বাস্তবায়নের সম্ভাবনার দায়টুকু স্বীকার করেই যেন অবচেতন কল্পনার এমন চিত্রটি সূক্ষ্ম অনুভূতির স্পর্শে ক্রমে ক্রমে পূর্ণ হতে থাকে। তার বাস্তবায়নের অতিসম্ভাবনাই কল্পচিত্রকে চিত্রকল্প থেকে দূর স্বতন্ত্র করে রাখে। মৃত্যুকল্প আর কল্পমৃত্যুও খানিকটা সে রকম। খানিকটা কেন, বেশ অনেকটাই।
আমাদের মৃত্যুকল্পের অতিবাস্তব সম্ভাবনাকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করে, অনেকাংশে আপন অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বিশ্বাসের নানা চেতনশিখায় আলোকিত করে গড়ে তুলি। কালক্রমে কখনো সে কল্পনাকে নিয়ে মেতে উঠে তার রদবদল ঘটাই। ভাবি, যদি এমন না-হয়ে আর একটু অন্য রকম হতো আমাদের মৃত্যুকল্পনাটি। ভাবি, ভাবি আর উদাস দেখতে থাকি সে কল্পনার অতিরঞ্জিত নানান শাখা-প্রশাখাকে। তার সমস্তটা কেন, কণামাত্রও বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা থাকে না।
কিন্তু কে জানে, আমাদের চেতনার গভীরে, কোন অন্ধকারে ওত পেতে থাকা মৃত্যু নিজেই কল্পনা করতে করতে গ্রাস করে অবচেতনের সমস্তকে, আর চেতন-অবচেতন, বাস্তব-অবাস্তব-অতিবাস্তবের সব সীমানা ভেদ করে এক অসতর্ক মুহূর্তে আমাদের সমগ্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে আরম্ভ করবে সে। তখন বাস্তব কী, পরাবাস্তব কোথায়? আর অবাস্তবই-বা কী? মৃত্যুর কল্পিত বাস্তবতার সেই অনঘ-তিমির যদি বাস্তব হয়, যদি অবাস্তবের মৃত্যুকল্পের সামান্যকে চুরমার করে দিতে দিতে এক ঘোর সংশয়চিহ্নের মুখোমুখি হয়ে হয়রান হয়ে যেতে হয়, এই মৃত্যু যদি বাস্তব হয়, তবে কল্পনা কী? আর যদি এই মৃত্যু কল্পনাই হয়, তবে বাস্তব কোথায়-সেদিন, সেদিন যে ঘোর অসহায়তার উদ্বেগে আপনার, আমার, সবার হৃদ্ধ্বনির অতিবিস্তার গ্রাস করবে আমাদের হাহাকার, একবার সেই কল্পচিত্রটি নিজের সম্মুখে রেখে, আসুন আজ পুনরায় পাঠ করি কাজী আনিস আহমেদের ‘চল্লিশ কদম’।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দেবযান’-এ যেমন, যতীন মৃত্যুর পরেও প্রথমে বুঝতে পারছে না, সে মৃত, ‘খাটের দিকে একবার চাইতেই বিস্ময়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খাটের ওপর তার মতো একটা দেহ নির্জীব অবস্থায় পড়ে। ঠিক তার মতো চোখ-মুখ-সবই তার।’ ‘চল্লিশ কদম’-এর শুরুটাও কতকটা সে রকম। শুধু ওইটুকুই সামঞ্জস্য। কেননা, ‘দেবযান’-এর প্রতিপাদ্য বিষয় বা কাহিনির আশ্রয় মৃত্যুপরবর্তী জীবন, আত্মার উপস্থিতি এবং তার অনশ্বরতা। কারণ, লেখক বিভূতিভূষণের বিশ্বাস ছিল মৃত্যুপরবর্তী জীবন বিষয়ে, তার মৃত্যুকল্পের সীমানা নির্ধারণ অন্যত্র করা যাবে। আনিস আহমেদের লেখার ‘বিষয়’ অবশ্যই তা নয়। শুধু শিকদার সাহেব যে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতে অপেক্ষা করছেন আসমস্ত বিশ্বাসকে বাজিয়ে দেখার জন্য, সত্যই তার মৃত্যু হলো কি না, তার সপক্ষে দাঁড় করাচ্ছেন এতকাল ধরে শুনে আসা রীতিকে, নিজের অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে তিনি উৎকর্ণ হয়ে কবরের নিদ্রিত নীরবতায় অপেক্ষা করছেন শেষ দাফনকারীর কবর ত্যাগের পর চল্লিশ কদম পদক্ষেপ শব্দ মহাশূন্যতায় বিলীন হতে না-হতেই মুনকার আর নাকির এসে যদি হাজির হয়, যদি তাকে জেরা করে লিখতে বসে তার আজীবনের ভালো-মন্দের, পাপ-পুণ্যের খতিয়ান, একমাত্র তবেই শিকদার বিশ্বাস করতে পারবেন তার মৃত্যু হয়েছে। 
এভাবেই ‘চল্লিশ কদম’ আরম্ভ হলো। আরম্ভ হলো মাটির নিচে অন্ধকারে একাকী উৎকণ্ঠার পদক্ষেপ গণনা। কাঠের পাদুকার যে শব্দ ধীরে ধীরে কবরের কাছ থেকে ক্রমে মুছে মুছে যাচ্ছে অপেক্ষাজীবনের সমস্তকে, সেই শব্দ নিয়েই কাহিনির আরম্ভ। এবং শেষও। অবশ্য প্রকৃতপ্রস্তাবে এই কাহিনির আরম্ভ বা সমাপ্তি নেই। এই কাহিনি যে চিরকালীন মানবজীবনের অপেক্ষার। এই কাহিনি বাস্তবের মুখোমুখি হতে না-পারা অবাস্তবের বাস্তবতা। নাকি কোনো অতিবাস্তবের বাস্তব হয়ে উঠতে না-পারার বাস্তবতা? মৃত্যুকল্পের মায়াময় আবহকে ছাড়িয়ে কালক্রমে চেতনার সমস্তটুকু জুড়ে কল্পমৃত্যুর বিস্তারের কাহিনি।   
অবশ্য কাহিনি বলতে যদি ওই পদক্ষেপের এক থেকে চল্লিশ অবধি গণনার মধ্যেকার অপেক্ষাপ্রহরে, সত্যিই মরে গেছি কি না ভাবতে ভাবতে জীবনের বিবিধ মাইলফলকের দিকে চোখ তুলে তাকানোর অবসরে যেসব খণ্ডচিত্র মনে আসে, যে সামান্য স্মৃতিরেখায় মনে পড়ে ‘যাকে ওরা মৃত্যু বলে’, তার সামান্য আগের মুহূর্ত দু-এক ঝলক, তবে হ্যাঁ, এই গ্রন্থের কাহিনি রয়েছে। শিকদার সাহেবের সেই কাহিনি আপাত-নিরিখে অবশ্যই মুনকার, নাকিরের সামনে পেশ করার সৎ-অসৎ কাজের ফিরিস্তি মনে করা নয়, বরং নাস্তিক্যময় সংশয়বাদের পথে চলতে চলতে জীবনের প্রায় সব অর্থে ব্যর্থ এক মানুষের অবিকল্প স্মৃতি-উদ্ভাসের সংকেত। যে মানুষ অনেক স্বপ্ন নিয়ে শুরু করা জীবনের সমস্ত পথ জুড়ে কেবল স্বপ্নভঙ্গের হাহাকারে নিজেকে ভুল বোঝাতে বোঝাতে বেঁচে থাকা এক উদ্দেশ্যহীনের জীবনকথা ছাড়া আর কী-বা মনে করবে? সে তো কবেই মরে গেছে, কতবার মরেছে; কতভাবে বিশ্বাসের অপমৃত্যু, স্বপ্নের অকালপ্রয়াণ নিয়ে আরও একটু ভালো থাকার চেষ্টায়, প্রতিবেশীদের নজর এড়াতে বাড়ির চারদিকে উঁচু পাঁচিল তোলা একাকিত্বের তাড়নায়, দীর্ঘ চব্বিশ বছর আলাদা কামরায় থাকা, স্ত্রী-সঙ্গের দূর নিজের বিশ্বাসের গলা টিপে হত্যা করতে করতে বাইরের সবার নজরে সুখী দাম্পত্যের নামভূমিকায় অভিনয় করে করে ক্লান্ত কেবল চেতনার অলক্ষ্যে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর ওত পেতে থাকার কল্পনা নিয়ে। আর এখন সেই অপেক্ষার বাস্তবতাকে অতিবাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করাতে যেটুকু অবসর, কাহিনির সেখানেই শুরু, সেখানেই শেষ।
স্বল্পপরিসরের এই কাহিনিটি অবশ্য সামান্য নয়। জামশেদপুরের অনুন্নত বসতি ছেড়ে শহরে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে শিকদারের শিল্প-সাহিত্যের প্রতি জন্মানো অনুরাগ আর ডসন সাহেবের সঙ্গে যে কোনো অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়লেন শিকদার, আর আজীবন সেই বন্ধন তাকে তাড়িয়ে বেড়াল। জীবনের সমস্ত ভালো-খারাপের মধ্যে ঢুকে পড়ল ওই দুটি অতীত অর্জন-ডসন আর তার কারণে গড়ে ওঠা শিল্প-সাহিত্যপ্রীতি। হবু শ্বশুরকে মোহিত করার মতো শিল্পবোধ তার ছিল না, ছিল শিল্পী হয়ে উঠতে না-পারার ব্যর্থতা এবং অবশ্যই, ওই আর পাঁচজনের মতো নিজেকে বোঝানোর অর্জন। 
না, তাই বলে শিকদার সাহিত্যশাস্ত্রীদের বিচারে খুব যে সৎ একজন মানুষ বা চরিত্র, তা নয়। অন্তত গল্পে তো তার আভাস সে রকমই। দলিল জাল করে কালোটাকা অর্জনে মোল্লার সহকারী হতে তিনি প্রথমে চাননি বটে, তবে আরও একটু ভালো থাকার, আরও স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনের হাতছানি তো তিনি সহজেই প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন। পারতেন সামান্য পসার আর লাল-নীল-সোনালি তরলে বিভাজিত রোগীদের অর্থনৈতিক ক্রমাবলম্বনে দাওয়াই বরাতের ছলনাটুকু নিয়ে, এ তল্লাটের নামজাদা ধাত্রীবিদ হয়ে, তরুণ বয়সের সঞ্চিত শিল্প-সাহিত্যের বোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে। হয়তো তার পাঁচিলঘেরা বড় বাড়ি হতো না, আব্বার বানানো বাড়ির সঙ্গে এই বিরাট অংশ, শানবাঁধানো উঠোন, আর মনখারাপের চৌকো সবুজ জমি, সেখানের তালগাছ হয়তো হতো না, বৈভবের এসব ছোটখাটো নিদর্শন নিয়ে সমাজচোখের দূরে চাপতে হতো না এত একাকিত্বের দীর্ঘশ্বাস। 
প্রত্যেক মানুষের যেমন একটা বাইরের আর গোপন অন্তর্জীবন থাকে, শিকদারেরও তেমনই ছিল। তার বাইরের বৈভব, সুন্দর সুখী দাম্পত্য, ডসনের সঙ্গে সৌহার্দ্য, গরিবগুর্বোদের উপশমের তৃপ্তি, সন্তান প্রসবের পসারের আড়ালে এক রহস্যাবৃত জীবনও রয়েছে। পৃথিবীর সব মানুষের, সব কাহিনির যেমন, জামশেদপুরে সমস্ত কাহিনিরও তেমনই দুটো ভাষ্য আছে। শিকদারের বিয়ের পরে পরে বউকে ইংরেজি শেখানোর হুজুগ, সেই শহরজীবনের বন্ধু ডসনের প্রত্নতাত্ত্বিক দলের সঙ্গে জামশেদপুরের মসজিদের ভাঙা খিলানে হিন্দু মন্দিরের কোনো অতীত জীবনের সংযোগের ক্ষীণ সম্ভাবনার কথা প্রচারে দেশময় বেধে যাওয়া ঝামেলার মধ্যে অসুস্থ ডসনের দেখভালের জন্য শিকদারের এগিয়ে আসা, সমস্ত জনপদে আন্ত্রিকের মড়কের মধ্যে ডসনকে নববিবাহিতা নূরজাহানের জিম্মায় রেখে শিকদারের ওষুধ আনতে শহরে যাত্রা আর সেই অবসরে সাহেবের সঙ্গে নূরজাহানের ইংরেজির অতিরিক্ত আরও আরও কত ভাষার সলিলে ভাসাভাসির ফলে একদিন শেষ রাত্রে বেগম শিকদারের সোনালি চুলের এক মেয়ের জন্ম দেয়ার পরদিন বাড়ির মাটিতে নরম কবরের গল্প...এ সমস্তের দ্বিবিধ অর্থ থেকে থাকবে। চিমনির ধোঁয়ার মতো মুখে মুখে শিকদারের ভূমিষ্ঠ সন্তানের মৃত্যু নিয়ে কথা উঠবে দুরকম। কথা উঠবে বাচ্চার কান্না শোনা, না-শোনা নিয়ে। শিকদারের এমন বিপদে ডসনের তড়িঘড়ি শহরে চলে যাওয়া, এসব নিয়ে ওই দুরকমের পরস্পরবিরোধী ধোঁয়াও উঠবে। আর তারপর দেখব, ‘এমনিতে সাধারণ ধোঁয়া হয় ধূসর, আজ তাদের রং হলো বিদঘুটে অসুখে ভোগা, সবুজ, কিংবা হয়তো বাদল মেঘই দিনের আলোকে আশ্চর্য সব রঙে প্রসারিত করে দিয়েছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী কিন্তু আকাশে উঠছে বলে মনে হচ্ছিল না, বরং তারা নিচু হয়ে বাড়িঘরের উপর ঝুলে রইল, আর সামান্য চিমনির ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে গেল, অন্য কোনো রান্নাঘরে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ার আগে।’ আগুনের সন্ধান তবু থামবে না। আর সমস্ত ঘটনার আড়ালে কেবল ধোঁয়ার মতো বিস্মৃত হতে থাকবে এই লেখার বিষয়টি, কল্পমৃত্যু ও বাস্তবতা।
আমার মনে হয়েছে, মৃত্যু ও বাস্তবতাই এই লেখার বিষয় (বিষয়>বি-সি{বন্ধন}+অ; ব্যুৎপত্তিগতভাবে যার অর্থ বন্ধন)। এখানে মৃত্যু কেবল মানবজীবনের শেষ নয়, জীবনব্যাপী তার ক্রমবিস্তার আর তার সেই কল্পিত বিস্তারপথ আমাদের সামান্যকে কীভাবে এনে ফেলেছে বাস্তবের মুখোমুখি-এটুকুই বেঁধে রেখেছে কাহিনির পূর্বাপর। আর তা করতে গিয়ে আনিস আহমেদ আশ্রয় (এখানে অবলম্বন করে) নিয়েছেন যে কাহিনির, যে জীবনের, যে নাস্তিক্যসংশয় ও অনন্ত অপেক্ষার, সেটুকুই শিকদারের কাহিনিকে অবলম্বন করে এগিয়ে চলেছে ছিন্ন-বিচ্ছিন্নভাবে, ঘটমানতার পূর্বাপর অনুসরণ না করেই। 
অবশ্য অনেক কিছুই, যা প্রথাগত, কাহিনির বুননে বা বিষয়ে-আশ্রয়ে, কোথাও অনুসরণ করেননি আনিস আহমেদ। বহু অসমাপ্ত প্রতর্ক, অস্পষ্ট ইঙ্গিত, অবাধ্য কাহিনিপথ বয়ন করতে করতে মানুষের সমাজের থেকে দূরে চলে যেতে থাকা বিচ্ছিন্ন একাকিত্বের প্রচলিতকেও অনুসরণ করেননি তিনি। পরকীয়ার সন্দেহ, অন্ধ দাইবুড়ির দোহাই দিয়ে চাপা দিতে চাওয়া সম্পর্কের নানা অলিগলি, প্রতিজীবনের অভ্যাস, চলমান বাংলার ঐতিহ্যের অবলুপ্তপ্রায় বহুলকে ঘিরে গড়ে উঠতে থাকা কাহিনির অভ্যাসকেও যথাসম্ভব এড়িয়ে তিনি বারংবার ফিরতে চেয়েছেন তাঁর কাহিনির বিষয়-আশ্রয়ে। 
এই যে মৃত্যুর কোটরে অন্ধকার অপেক্ষায় শুয়ে শুয়ে শিকদার ভাবছেন, তার বিশ্বাস সত্যি হবে কি না, সেই যে মধ্যযুগের শাস্ত্র ঘেঁটে ইয়াকুব মোল্লা, তার বহু কালোকারবারের সঙ্গী নিশ্চিন্ত করে বলেছেন, শেষ দাফনকারীর বিলীয়মান চল্লিশতম পদক্ষেপের কথা, এতকাল ভেবেছেন, ‘চল্লিশ সংখ্যাটাই বা এমন গুরুত্বপূর্ণ কেন? ঊনচল্লিশ পা যাওয়ার পরেই কি কোনোদিনও ফেরেশতাদের আবির্ভাব ঘটেনি? সবসময় চারপাশে এত লোক অক্কা পাচ্ছে যে, কী করে তারা এমন নিখুঁতভাবে তাদের কাজ সেরে ফেলতে পারে?’-এক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চিরবিশ্বাসের এক মহাসংঘাতক্ষণ তৈরি করেছেন লেখক, আর পড়তে পড়তে সংশয়ের এক বাতাবরণ, কী হয়, কী হয় ভাবতে ভাবতে পাঠকও এগিয়ে চলেছে এক বিস্ময়ের আকাশি পথে...সমস্ত গল্পজুড়েই এর টান টান বিস্তার। বারংবার মৃত্যুর ছায়া চেতনার অবকাশে উঁকি দিয়েছে, আর উঁকি দিয়েছে পায়ের অনুষঙ্গ, চপ্পল, খড়ম এবং সেই কবে প্রথমবার দেখা একটি মেয়ের ধবধবে সাদা পায়ের স্মৃতি। ডসনের কাঠের খড়ম পায়ে শানের ওপর নাচার ‘খটখটাখট’ শব্দ আজীবন রয়ে গেল শিকদারের মননে, যেমন রয়ে গেল সেই ফরসা পা, যার দিকে তাকিয়ে শিকদার সেই কবে, ‘ভেবেছিলেন, যদি সেই পায়ের মালকিন কোনো মরুভূমির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যায়, একটিও ধূলির কণা তাঁর জুতোর তলিতে লেপ্টে থাকবে না।’ মেয়েটিকে আঁকতে পারেনি শিকদার। ‘শুধু বেওকুফ এক পা-ই আটকে আছে তার মগজে।’...একইভাবে মগজে রয়ে গেল চব্বিশতম বিবাহবার্ষিকীতে বেগমের বুনে দেয়া একজোড়া চপ্পল আর তাদের সম্পর্কের হিমশীতল অন্তর্জীবনের বাইরে লোকদেখানো ‘খটখটাখট’ চলমানতা। এই শব্দটিই বরং বেশি বেজেছে, ডসনের নাচের সময়ের শব্দের চেয়ে, এমনকি শেষ দাফনকারী ডসনের প্রত্যাবর্তনের নরম মাটির ওপর দিয়ে বিলীন হতে থাকার রুদ্ধশ্বাস চলশব্দের চেয়েও বেশি বেজেছে পাঠকের কানে।
এই যে দুটো প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ পা, ডসনের কাঠের খড়ম, বেগমের বুনে দেয়া চপ্পলের অতিরিক্ত সেই কোন অতীতে দেখা মেয়েটার ফরসা পায়ে গাড়ি থেকে নেমে আসা, যার পরনে সেদিন কী ছিল খেয়াল করা হয়নি, যার মুখও মনে পড়বে না আজ, এত বছরের ব্যবধানে, এবং অবশ্যই বেগমের সঙ্গে সম্পর্কের চুপচাপ বেড়ে যাওয়া দূরত্বজুড়ে লোকদেখানো কাছাকাছি আসার অসহ্য পদধ্বনি-সমস্ত লেখাটিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সে আচ্ছন্নতা আমাদের চেতনার সমগ্রকে বিস্তার করে বসে থাকা কল্পমৃত্যুর। ধীরে ধীরে যার পদক্ষেপ আমরা শুনতে পাব জীবনে।
জীবন যখন এল, তখন স্বভাবতই কৌতূহল হয়, কেমন ছিল শিকদারের জীবন? লেখক যতটা ধরেছেন এ লেখায়, তার অতিরিক্ত যেটুকু ধরেননি, সেই অব্যক্ত, অবচেতনের কোথাও কি তার বিষাদ ছিল জীবনের প্রতি মুহূর্তে? ডাক্তার হতে চেয়ে শহরযাত্রা, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ, বিদেশি শিল্পীদের আঁকা নগ্ন নারীশরীর দেখতে দেখতে সেই যে, শিকদার ডসনকে বলবেন, ‘...তোমার জানা উচিত, ইসলামে কারও তসবির বা প্রাণীর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ।’ আর ডসনের ‘আমি যে মুসলমান নই, তাতে আমার খুশিই লাগছে’, আর বলেও ‘ধর্মভীরু মনের সংশয় সত্ত্বেও’ শিল্পে আগ্রহী একটা মন ক্রমে রোগীদের স্পর্শ করতে করতে নিজেই এক স্পর্শ-অনুভূতিহীন জড়, রোগশরীরে পরিণত হয়ে ওঠার জীবন, সেই যে ফরসা পায়ের মেয়েটির স্মৃতিজুড়ে অব্যক্ত ‘তুমি কি কখনো মরুভূমিতে হেঁটে গিয়েছিলে নাকি?’ বলতে চাওয়ার আকুলতাভর্তি এত স্পষ্ট, এত জীবন্ত একটা অবর্ণনীয় পায়ের সৌন্দর্য, যাকে স্পর্শ করতে না-পারার ব্যর্থতায় ‘কেমন কান্না’ পেয়ে যাওয়ার খোয়াবনামা...সেই জীবনটুকু পাঠকের অনুভবের দুয়ারে ঠেলে দিলেন লেখক। কেবল লেখকের ভাষায়, ‘একমাত্র যেভাবে তিনি তাঁর পিছুটানের এই বিষম ভাবালুতা ঝেড়ে ফেলতে পারতেন, তা হলো যদি তিনি এখনকার বাস্তব জলজ্যান্ত কিছু আঁকড়ে ধরতে পারেন; কোনো ভাবনা (মোল্লা আর তার সাত বিঘে জমি), সত্যিকার কোনো শরীরী অনুভূতি (বুকের মধ্যে ওই ব্যথাটা), স্পষ্টগ্রাহ্য কোনো বস্তু (রুবাইয়াতের খোলা পাতা) অথবা কোনো জ্যান্ত মানুষ (বেতের চেয়ারে বসে থাকা তাঁর বিবি)।’-যেটুকু, আর ধানখেতের মধ্যে জেগে ওঠা শূন্যতার বিমূঢ় বিহ্বলতা নিয়ে যন্ত্রণায় চেতনহীন হয়ে পড়ার যাত্রাটুকুই জেগে রইল যেন সমগ্রতার আভাস নিয়ে।
শিকদার জেগে উঠলেন যখন, শুয়ে শুয়ে যখন অনুভব করছেন একটা জংধরা কোদাল দিয়ে কারা গর্ত খুঁড়ছে আর শিকদার নিজের গা থেকে ‘মৃদু ঝিমধরানো কর্পূরের গন্ধ ছড়িয়ে’ অপেক্ষা করতে করতে দেখছেন তার কবরের তৈয়ারি, বাঁশ দিয়ে সাজানো কবরের মুখে গড়ে তোলা শূন্যতার ছাদ, তখন নিশ্চয়ই পাঠকের বিস্ময় তার নিজের মৃত্যুকল্পনার সমগ্রকে পার হতে হতে এক পরাবাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে পাঠকালীন বাস্তবতাকে। যেন পাঠকও মনে মনে ভাবছেন, শিকদারের মতো, ‘হয়তো তাঁর বিবিসাহেবা তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে যে কোনো মুহূর্তে জাগিয়ে দেবেন,’ আর সত্যি যদি তা হয়, এবং আমার বিশ্বাস, তা হবেই, তবে, সেই মুহূর্তেই লেখকের নির্মিত বাস্তবটি, যা কিনা তথাকথিত অতিবাস্তবের মুখোমুখি হতে থাকা বাস্তবকে নির্মাণের চেষ্টায় এত বিষয়-আশ্রয়, মৃত্যুকল্প-কল্পমৃত্যুর চলাচলে ক্রমে বিপর্যস্ত হতে শুরু করেছিল, তা অবশেষে মুক্ত হতে পারবে এক অলীক নান্দনিক বোধের আকাশে।
আনিস আহমেদের গল্পে একজন মানুষের মৃত্যুর কথাই এসেছে। মৃত্যু বা কল্পমৃত্যু যা-ই হোক, বাস্তব বা অবাস্তব যা-ই হোক, মোদ্দা কথাটা হলো একটা জীবনের মৃত্যু। কিন্তু প্রত্যেক জীবনই তার সমগ্রকে নিয়ে, মানবসভ্যতার সমগ্র যাত্রাপথে এক-একটা ইতিহাসের অধ্যায় হয়ে থাকতে পারে, সে যত সামান্যই তার জীবন হোক না কেন! শিকদারের সামান্য জীবনও বহু ইতিহাসের সাক্ষ্য রেখে এগিয়েছে। তার জীবন সে গড়েছে নিজের খেয়ালে, অন্যের ভাষায়, অনেকের চাহিদায়, দোয়া-দরুদে। কেবল মৃত্যুকল্পনার ছায়া সে কখনো পড়তে দেয়নি নিজের জীবনে। হ্যাঁ, একটা কাহিনির ধোঁয়া উঠেছিল, তার শেষ রাতে জন্মানো শিশুর জন্ম-মৃত্যুর রহস্য নিয়ে, কিন্তু তার ছায়া কখনো আসতে দেননি তিনি। মৃত্যুর আগের দিন বর্ষার প্রথম ইলিশের স্বাদ আর পেঁয়াজকুচি ভাজা ছড়ানো খিচুড়ি খেতে খেতে রোগী দেখার চাপে ক্লান্ত হওয়ার আগেও মোল্লার সঙ্গে দখল করা জমির হিসাবে মেতেছেন। ভাবেননি, মৃত্যুই তার চেতনার দূরে আপন কল্পিত মায়াজাল গড়তে গড়তে বিস্তৃত হচ্ছে ক্রমে। তার ধানখেতের আলপথে বর্তিকাহীন চলার অন্ধকারে বাস্তবায়িত হবে মৃত্যুর কল্পিত আবরণ। সে শুনতেও পায়নি।
এখন কবরের অতলান্তে শুয়ে তার উৎকর্ণ অপেক্ষা-সিদ্ধান্তের সমস্তটুকু আসলে লেখক আমাদের হাতেই অর্পণ করে দিয়েছেন। শিকদারের সঙ্গে আমরাই গুনতে বসেছি শেষ দাফনকারীর পদশব্দ। চল্লিশ গুনতে চাইছি। আর গুনতে গুনতে হঠাৎ আমাদের অতিবাস্তবতার মায়ামোহ ভেঙে যাচ্ছে লেখার শেষ অবধি এসে। না, চল্লিশের আগেই লেখক থেমেছেন। এবার আমাদের, পাঠকের গণনার কাল শুরু। আমাদেরই শুনতে হবে বিশ্বাসের একাকিত্ব ভেঙে ওই বিশ্বস্ত বন্ধুটি যখন আমাদের ছেড়ে দূর, আরও দূর হয়ে যাচ্ছে, যাকে বিশ্বাস করে আজীবনের দাম্পত্যের মাঝে কাঠের মতো নীরস, ‘খটখটাখট’ শব্দ তোলা অসহায়তা পেয়েছেন শিকদার, আর আজ অপেক্ষা করছেন কীভাবে তার পায়ের শব্দে ভেঙে যাবে একজীবনের মৃত্যুঘোর। তার চল্লিশতম পদক্ষেপের পর শিকদারের নতুন জীবনের আরম্ভ। আজীবন যে বিশ্বাস, স্বপ্ন, কল্পনা তাকে তাড়িত করেনি, সেই মৃত্যু দিয়ে, মৃত্যু নিয়ে কল্পিত এক জীবন। সেখানে মৃত্যুকল্পের অবাস্তবতার চেয়ে কল্পমৃত্যুর বাস্তবতাই বিরাজমান। শিকদারের ওই কল্পমৃত্যুর চেতনায় জেগে ওঠা বাকি রয়ে গেল যে!