ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরে বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বরাক উপত্যকায় ভাষার লড়াই নামে পরিচিত। ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষাকে রাজ্যেও অন্যতম ভাষা করার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন ১১ জন ভাষাসংগ্রামী। এ আন্দোলনের রয়েছে দীর্ঘ পটভূমি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অসম রাজ্যের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল বারাক উপত্যকায় রয়েছে করিমগঞ্জ, হাইল্যাকান্দি, বদরপুর, শিলচর প্রভৃতি বাঙালি-বসতিপূর্ণ স্থান। ঔপনিবেশিক শাসনামলে এ অঞ্চলের বাঙালিরাই আসাম প্রদেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখানে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত অভিশপ্ত লাইনপ্রথার বিরুদ্ধেও বাঙালি মুসলমানেরা আন্দোলন করেছে। মওলা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে সংঘটিত আসামের কৃষক আন্দোলন ইতিহাসে গৌরবের আসন লাভ করেছে। এ অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বারবার অসমিয়াদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাঙালিদের স্বকীয় সত্তা টিকিয়ে রাখতে নানা সংগ্রাম করতে হয়েছে।
১৮৭৪ সালে যখন বাংলার রাষ্ট্রসীমা থেকে শ্রীহট্টসহ কাছাড় জেলা বিচ্ছিন্ন করে আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন থেকেই এ সংগ্রাম আরও তীব্রতর হয়। এ সময় অসমিয়ারা সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত হয়ে বাঙালি অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে অসমিয়াকরণের প্রয়াস চালায়। স্কুলগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে অসমিয়া শেখানো হয়। এর ফলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে মাত্র চার বছরে ২৫টি বাংলা মাধ্যম স্কুলের ২৪৭টিই বন্ধ হয়ে যায়। এমন প্রতিকূলতার মধ্যেও বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব বাড়তেই থাকে। ১৯৫০ সালের দিকে উগ্রপন্থি অসমিয়ারা শুরু করে ‘বাঙাল খেদাও’ আন্দোলন। ইঙ্গ-মার্কিন মদদে অহমিয়া জাতীয়তাবাদ চাঙ্গা হয়। অহমিয়াকে শিক্ষার বাহন এবং সরকারি ভাষা করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। এর আগে ১৯৪৮ সালের আসামের গুয়াহাটি শহরে বাঙালিদের ওপর আগ্রাসন চালায়। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত আসাম বিধানসভায় বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দিতে বক্তব্য দেওয়ার বিধান ছিল। কিন্তু নতুন আইন পাস করে তা রহিত করা হয়। এরপরেও আইসভার অধ্যক্ষের অনুমতি নিয়ে বাংলায় বক্তব্য দেওয়া যেত। ১৯৫৪ সালে অসমিয়াকে সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও শেষ পর্যন্ত সে উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি।
আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বরাক উপত্যকার বিশাল জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়ে অসমিয়ার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবিতে সোচ্চার হয়। অন্য ভাষাভাষী মানুষেরাও বাঙালিদের আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। ভারতীয় কমিউনিস্ট পর্টি এ আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রূপ দিতে এগিয়ে আসে। আন্দোলনের দাবানল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদ, ধর্মঘট, সভা-সমিতির মাধ্যমে শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে এর ঢেউ। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাদেশিক সরকারের মদদে আন্দোলন দমনে সৃষ্টি করা হয় বিভীষিকাময় পরিবেশ; দাঙ্গা, হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির মাধ্যমে জনজীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয়। বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষার দাবি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ১৯৬০ সালের ১৮ থেকে ২০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় বরাক উপত্যকার বাঙালি নাথ-যুগী সম্প্রদায়ের ৩৬তম বার্ষিক অধিবেশন। এতে বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার মতো সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানানো হয়। এভাবে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ১৯৬১ সালের শুরু থেকে বাংলা ভাষা-আন্দোলন ক্রমশ প্রবল হতে থাকে। একের পর এক গড়ে ওঠে বাংলা ভাষা রক্ষা সমিতি। এসব সমিতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি’, ‘কাছাড় জেলা সংগ্রাম পরিষদ’, ‘ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ প্রভৃতি। সমিতিগুলো আসাম প্রাদেশিক পরিষদে পাশ হওয়া বিলের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে। বাঙালিদের দাবির পক্ষে জনভিত্তি দেখে জেলা কংগ্রেস কমিটিও একটি ‘ভাষা আন্দোলন সমিতি’ গড়ে তোলে এবং জনতার কাতারে শামিল হয়। ধীরে ধীরে সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনে যুক্ত হয়। সভা, সত্যাগ্রহ, মিছিল, পদযাত্রা, হরতাল প্রভৃতির মাধ্যমে আন্দোলন বেগবান করা হয়।
১৯৬১ সালের ১৫ জানুয়ারি শীলভদ্র যাজীকে সভাপতি করে করিমগঞ্জে সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এতে নতুন করে ঘোষণা করা হয় শিলচর সম্মেলনের প্রস্তাব। এ বছর ৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় আসাম গণ-সম্মেলন। এতে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠন করা হয় কাছাড় গণসংগ্রাম কমিটি। বাংলা ভাষাকে রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে আয়োজন করা হয় কাছাড় জেলা গণসম্মেলন। এতে একমাত্র দাবি ওঠে—‘বাংলাকে আসামের অন্যতম রাজ্য ভাষারূপে মানতে হবে।’ ১৪ এপ্রিল কাছাড় জেলার সর্বত্র শপথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঘোষিত হয় এ সংকল্প ‘জান দেব, জবান দেব না।’ এরপর পদযাত্রা, জনসভা প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত করার কাজ শুরু হয়। ১৯৬১ সালের ১ বৈশাখ, অর্থাৎ—বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন ‘সংকল্প দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। বাংলা ভাষার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ সমগ্র বারাক উপত্যকায় পক্ষকালব্যাপী পদযাত্রা কর্মসূচির ডাক দেয়।
১৯ এপ্রিল থেকে করিমগঞ্জের পদযাত্রীরা গ্রাম-পরিক্রমা শুরু করে। অরবিন্দ চৌধুরী, রথীন্দ্রনাথ সেন, বিধূভূষণ চৌধুরী, ননীগোপাল স্বামী, নির্মল দাসপুরকায়স্থ, স্বদেশরঞ্জন ভট্টাচার্য, অন্নদামোহন কর, রণেন্দ্রমোহন দাস, নলিনীকান্ত দাস, নৃপতিঞ্জন চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে পদযাত্রীদল লক্ষ্মীবাজার অভিমুখে রওয়ানা হয়ে করিমগঞ্জ, পাথারকান্দি, রাতাবাড়ি ও বদরপুর থানার বিভিন্ন অঞ্চলে পরিক্রমা করে এবং বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে ২রা মে করিমগঞ্জে ফিরে আসে। এ পদযাত্রার ফলে করিমগঞ্জ মহকুমার প্রায় প্রতিটি গ্রাম এবং জনপদে ভাষাসংগ্রামের ডাক পৌঁছে যায়। সৃষ্টি হয় ব্যাপক গণজোয়ার। পদযাত্রাশেষে ২ মে সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণে করিমগঞ্জে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। রথীন্দ্রনাথ সেনের পৌরোহিত্যে অনুষ্ঠিত ওই সভায় কতকগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়; যার মধ্যে ছিলো—১. ১৩ মে-র মধ্যে বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা না করা হলে ১৯ মে সর্বাত্মক ধর্মঘট ও পূর্ণ হরতাল পালন করা হবে; ২. বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে; ৩. ভাষার যথাযোগ্য না দেওয়ায় করিমগঞ্জে পুনর্বার নির্বাচন বয়কট করা হবে। তিনি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকেও সরকারি স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানান। সরকারপক্ষও বসে থাকেন না। খোদ প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উড়ে আসেন গুয়াহাটিতে। প্রাদেশিক সরকারের মতো কেন্দ্রীয় সরকারও নজর রাখে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের দিকে। বিমলা প্রসাদ চালিহা সরকার অসমিয়াকে রাজ্যভাষা হিসেবে চালু রাখার ধনুক-ভাঙা পণে অটল থাকে। দাবি না মেনে সরকার আন্দোলন দমনে মরিয়া হয়ে ওঠে। শুরু হয় গ্রেফতার ও দমন-পীড়ন।
১৯ মের কর্মসূচি সফল করতে ১৮ মে ছাত্রসমাজের আহ্বানে করিমগঞ্জে শোভাযাত্রা বের করা হয়। সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে সে শোভাযাত্রা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ১৮ মে রাতে গ্রেফতার করা হয় সংগ্রাম পরিষদের অনেক নেতাকে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন—রথীন্দ্রনাথ সেন, অনিল বর্মণ, নরেশ ভৌমিক, জীতেন্দ্রনাথ চৌধুরী, গোলাম ছবির খান, যজ্ঞেশ্বর দাস, শান্তিময় ভট্টাচার্য, নিশীথরঞ্জন দাস, বিজয় সেন (করিমগঞ্জ), প্রেমানন্দ মুখার্জি, গোপেশচন্দ্র নমঃশূদ্র (বিধায়ক) প্রমুখ। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণ আরও সংগঠিত হতে শুরু করে। বরাক উপত্যকার সর্বত্র ফুঁসে ওঠে। লাখো কণ্ঠে ধ্বনি ওঠে ‘মাতৃভাষা—জিন্দাবাদ।’ ভাষার লড়াইয়ের জন্য গোটা অঞ্চল একাট্টা হয়। ১৯ মে ভোরে দলে দলে কাছাড় জেলার রাজপথে নেমে আসে। সত্যাগ্রহীরা করিমগঞ্জ এবং শিলচর রেলস্টেশনে রেল চলাচল বন্ধ করে দেয়। বিমানঘাঁটির রানওয়েতে শুয়ে পড়ে। বন্ধ করে দেয় অফিসের কাজ। পুরো বরাক উপত্যকায় জনতার এমন ইস্পাতকঠিন ঐক্য এর আগে আর কোনো দিন দেখা যায়নি। শুরু হয় গণগ্রেফতার। শত শত সত্যাগ্রহী হাসতে হাসতে কারাবরণ করেন। শিলচর স্টেশনে সংগ্রামী জনতার ওপর দফায় দফায় চলে পুলিশের নির্যাতন-হামলা। উভয় পক্ষে শুরু হয় সংঘর্ষ। বেলা ২.৩৫টার দিকে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, পুলিশের একটি বন্দুক আন্দোলনকারীরা ছিনিয়ে নিয়েছে। কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহার সরকার আন্দোলনকারীদের স্তব্ধ করে দিতে পুলিশকে গুলিচালনার নির্দেশ দেন। শুরু হয় পুলিশের মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ। গুলিতে একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন কমলা ভট্টাচার্য, হীতেশ বিশ্বাস, কানাইলাল নিয়োগী, শচীন্দ্র পাল, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদ দাস, সুকোল পুরকায়স্থ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, তরণী দেবনাথ ও সুনীল সরকার; এই ১১ জন। আহত ও রক্তাক্ত হন আরও ৩০ জন। ১১ শহিদের মধ্যে ঘটনাস্থলে ৯ জন এবং পরে আরো দু-জন মৃত্যুবরণ করেন। এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় বলা হয় : ‘বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবিতে কাছাড় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে যে আন্দোলন শুরু হইয়াছে, আজ প্রথম দিনেই সশস্ত্র পুলিশ শিলচর শহরে শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের উপর বেপরোয়া গুলি চালাইয়া বালিকা ও শিশুসহ আটজনকে ঘটনাস্থলে নিহত করিয়াছে। শিলচর রেলওয়ে স্টেশন কম্পাউন্ডে এই বর্বর ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়। চারজন বালিকাসহ প্রায় ৩০ [জনের] শরীরের ঊর্ধ্বাশ গুরুতররূপে আহত হইয়াছে।’
বরাক উপত্যকার ভাষা-আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে তরুণ চক্রবর্তী লিখেছেন : ‘বাঙালির আন্দোলনের তীব্রতার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে আসাম সরকারের দমন-পীড়ন। পুলিশ, আধা-সেনা নামিয়ে আন্দোলন দমানোর সব রকম চেষ্টা শুরু হয়। আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়—এই অজুহাতে জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। ১ মের আগে থেকেই নিরাপত্তা বাহিনীতে ছেয়ে যায় বরাক উপত্যকা। ১২ মে থেকেই সেনা কমান্ড পরিচালিত আসাম রাইফেলস জওয়ানোরা শুরু করেন ফ্লাগ মার্চ। ১৮ মে গ্রেফতার হন রথীন্দ্রনাথ সেন, নলিনীকান্ত দাশ, বিধুভূষণ চৌধুরীসহ ভাষা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারা। অবশেষে আসে ১৯ মের কালো দিন। সকাল থেকেই সত্যাগ্রহীরা অহিংসভাবে হরতাল পালন করছিলেন। তিন জেলাতেই পিকেটারদের গ্রেফতার করে পুলিশ। শিলচরের তারাপুর রেলস্টেশনেও শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিলো অবরোধ। ভারতীয় সময় বেলা ২টা ৩৫ মিনিট নাগাদ বিনা প্ররোচনায় নিরাপত্তাবক্ষীরা ১৭ রাউন্ড গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন নয়জন ভাষাসৈনিক। পরে আরও দুজনের মৃত্যু হয়। জখম হন আরও একজন।’
বরাক উপত্যকায় সংঘটিত ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্ত সম্পর্কে ‘ভাষা আন্দোলনে কাছাড়’ গ্রন্থে অলক রায় লিখেছেন : ‘করিমগঞ্জ রেল-স্টেশন। ভোরের ট্রেন আটকাতেই হয়। সত্যাগ্রহীরা রেল-লাইন আগলে বসল। কয়েকজন আবার রেল-লাইনের উপর উপুড় হয়ে শুয়েও পড়লো। রেলের চাকা যদি চলে ওদের উপর দিয়ে পিষে বেরিয়ে যায় যাক্ ক্ষতি নেই। আচমকা পুলিশ ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো উদ্যত লাঠি হাতে। পেটাতে লাগলো। কিন্তু সত্যাগ্রহীদের রেললাইন থেকে সরাতে পারলো না। সত্যাগ্রহীদের স্লোগানে চারদিক মুখর হয়ে উঠলো : মাতৃভাষা—জিন্দাবাদ। ‘জান দেবো, তবু জবান দেব না।’ এবারে আরো নৃশংস হয়ে উঠলো কংগ্রেস সরকারের পুলিশ বাহিনী। সঙ্গীণ উঁচু করে পড়ে আছে। সঙ্গীণ খোঁচায় সত্যাগ্রহীদের শরীর রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। মুখে তাদের মাতৃভাষা—জিন্দবাদ।’
বরাক উপত্যকার ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের ভাষা-আন্দোলনের তুলনা করা চলে। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় উভয় স্থানেই ভাষাসংগ্রামীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। আত্মাহুতির বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষার মর্যাদা। তবে পূর্ববঙ্গের মানুষের ভাষা-আন্দোলনে আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছিল, আসামের ভাষা-আন্দোলনে তেমনটি পরিলক্ষিত হয় না। বরাক উপত্যকাবাসী বাংলা ভাষাকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেই ক্ষান্ত হয়েছে, কিন্তু পূর্ববঙ্গের মানুষ থামেনি। ভাষা-আন্দোলন এবং একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতার ঝান্ডা উড়িয়ে তারা কঠিন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এবং শেষ পর্যন্ত এক সাগর রক্তের বিনিমিয়ে অর্জন করেছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এতদসত্ত্বেও বায়ান্নর দেখানো পথেই একষট্টিতেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা এবং অর্জিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। বায়ান্ন আর একষট্টি যেন একসূত্রে গাঁথা। তাই, তপোধীর ভট্টাচর্যের সঙ্গে একমত হয়ে আমরাও বলতে পারি, ‘শুধু বরাক উপত্যকার জন্য নয় উনিশে যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি নয় কেবল বাংলাদেশের। উনিশের চেতনা নয় মৃণালভোজী সম্প্রদায়ের জন্যও। ভালো বাঙালি হওয়ার জন্যই উনিশে মে আমাদের জীবনে নবীন যাত্রা রচনায় উদ্বুদ্ধ করুক, নিয়ে যাক রূপ থেকে রূপান্তরে, প্রবল থেকে প্রবলতর উদ্ভাসনে। ... চর্যাপদের যুগে আমাদের জাতীয় চেতনার যে অভিজ্ঞা নির্ণীত হয়েছিল, সেই প্রতিবাদী মনন ও বোধ পুনরুজ্জীবিত করে একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে মে। উনিশের চেতনা মানে অপরাজেয় মানবিক পরিসর পুনরাবিষ্কার।’