রক্তকরবীর সমাজতাত্ত্বিক পাঠ

রক্তকরবী কি শুধুই একটি নাটক? অনেকেই বলেছেন, এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৃদয়ে লালন করা কোনো স্বপ্ন। কেউ কেউ এই নাটকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের শ্রেণিসংগ্রাম চেতনার ছায়া খুঁজেছেন। নানা প্রশ্ন, নানা যুক্তি নিয়ে রক্তকরবী নাটকটি রচনার পর থেকে সমসাময়িক সময় পর্যন্ত দারুণ আলোচিত ও জনপ্রিয়। উল্লেখ্য যে, নাটকটি ১৯২৪ সালে প্রথম প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ পায়। প্রশ্ন হলো সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত নাটকটি নিয়ে কেন এত আলোচনা?

প্রকৃতপক্ষে এ নাটক নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগ্রহও ছিল আলাদারকম। রক্তকরবী নাটকের পাণ্ডুলিপিতে তিনি বারবার ঘষামাজা করেছেন। দশ দশবার পরিবর্তনও করেছেন এ নাটকের খসড়ায়। নাটকটির নাম প্রথমে রেখেছিলেন যক্ষপুরি তারপর নন্দিনী এবং পরিশেষে রক্তকরবী নামে থিতু হয়। প্রতিবার তিনি নতুন চরিত্র সংযোজন করেছেন আবার কখনও নতুন গান সংযোজন বিয়োজনও করেছেন। এ নাটকের মূল চরিত্র নিয়েও ভেবেছেন অনেক। পাণ্ডুলিপির খসড়া থেকে দেখা যায়, তিনি নন্দিনীকে কখনো খঞ্জনা কখনো খঞ্জন কখনো সুনন্দা নাম দিয়েছেন।

১৯২৬ সালে নাটকটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় একশত বছর পার হলেও রক্তকরবী আজও যেমন জনপ্রিয় তেমনি এ নাটক নিয়ে প্রাজ্ঞজনের বিশ্লেষণের কোনো শেষ নেই। রক্তকরবী নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা হয়েছে। বিশ্লেষকদের একটি অংশ এ নাটকে রবীন্দ্রনাথে ঠাকুরের সমাজতান্ত্রিক চেতনার প্রভাব পড়েছে বলেও যুক্তি দেখিয়েছেন। তবে রূপকাশ্রয়ী এ নাটকটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রবীন্দ্র মানসে একটি স্বপ্ন খুব উজ্জ্বল যেখানে আঁধার ভেঙে এক উজ্জ্বল আলো সন্ধানের স্পৃহা অতি সুস্পষ্ট। কিন্তু সেই আঁধার ভাঙার জন্য যে বিপ্লব প্রয়োজন তার ধরনটা একেবারেই আলাদা।

নাটকের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায, যক্ষপুরী নামে পরিচিত একটি নগরে নানা রকম দ্বন্দ্বের উপস্থিতি। এখানে কোনো উৎপাদন নেই, নেই কোনো সৃষ্টি। আছে শুধু অমানবিক শ্রম। দিনের পর দিন যক্ষপুরীর শ্রমিকরা পাতাল থেকে সোনা তুলে আনছে। কেউ বা সোনা খোদাইয়ের কাজ করছে। সবার উপরে প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী রাজা। মাঝখানে আরো কয়েকজন পেশাজীবীর উপস্থিতি দেখা গেলেও বস্তুতপক্ষে কথা বলার ক্ষমতা কারো নেই। আপাতদৃষ্টিতে এ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করলে মার্কসীয় দর্শনের সাথে অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অনেকে সেরকম মেলানোর চেষ্টাও করেছেন। মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব, শোষণ, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা সবই আছে রক্তকরবীতে। তবে মুক্তির যে পথ রবীন্দ্রনাথ এখানে বাতলে দিয়েছেন সেখানে মার্কসীয় বিপ্লব থেকে একবারে আলাদা এক বিপ্লবের ঈঙ্গিত পাওয়া যায়। কার্ল মার্কস যে শ্রেণি সংগ্রামের কথা বলেছেন সেই শ্রেণির কথা এখানে স্পষ্ট থাকলেও বিপ্লবের ভাষাটি একবারেই অন্যরকম।

নাটকের মূল চরিত্র নন্দিনীকে উপস্থাপন করা হয়েছে পরিবর্তনকামী এক নারী হিসেবে। যক্ষপুরীর যে আঁধার সেই আঁধারে একটু আলোর পরশ নিয়ে আসতে তার নান্দনিক চেষ্টার কোনো অন্ত নেই। নান্দনিক বলছি একারণে যে, নন্দিনী বিপ্লবী নারী হলেও তার বিপ্লবের পথ কখনোই সহিংস নয়। বরং বিশু পাগলার গান, কিশোরের রক্তকরবী অনুষঙ্গ এসেছে বারবার যা নন্দিনীকে উপস্থাপন করেছে আলো অন্বেষী এক নান্দনিক নারী হিসেবে। নাটকে বারবার রাজা, শোষক, শ্রমিক, প্রতিবাদ বিষয়গুলো আপাতদৃষ্টিতে মার্কসের শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত্বের প্রাথমিক আভাষ দিলেও প্রকৃতপক্ষে সেই শ্রেণি সংগ্রাম আর নন্দিনীর বিপ্লব এক কিনা তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

নাটকে বিশু একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। সে গান, সংলাপ, নেতৃত্ব দিয়ে যক্ষপুরীতে পরিবর্তনের হাওয়া এনেছে। বিশু ফাগুলালের সংলাপে দেখা যায়-

বিশু : আমাদের কারিগররা বন্দীশালা ভেঙে ফেলেছে। তারা ঐ চলেছে লড়তে। আমি নন্দিনীকে খুঁজতে এলাম। সে কোথায়?

ফাগুলাল : সে গেছে সকলের আগে।

বিশু : কোথায়?

ফাগুলাল : শেষ মুক্তিতে। বিশু দেখতে পাচ্ছ ওখানে কে শুয়ে আছে?

বিশু : ও যে রঞ্জন।

ফাগুলাল : ধুলায় দেখেছ ওই রক্তের লেখা?

বিশু : বুঝেছি। ওই তাদের পরম মিলনের রক্তরেখা। এখন আমার সময় এলো একলা মহাযাত্রার। হয়তো গান শুনতে চাইবে! আমার পাগলি। আয়রে ভাই, এবার লড়াইয়ে চল।

ফাগুলালের সাথে বিশুর এ সংলাপে বোঝা যায় কোনো একটি সংগ্রামের ইঙ্গিত আছে এখানে। এখানে রক্তের দাগও আছে আবার নন্দিনীর গানও আছে। সহজ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এটি কার্ল মার্কস এর শ্রেণি সংগ্রামের ছায়া। কিন্তু একটু ভাবলেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে এখানে যে শ্রেণি সংগ্রামের কথা বলা হয়েছে তা মার্কস অথবা লেনিনের বিপ্লব থেকে একেবারেই আলাদা। এ নাটকে প্রাণ দেওয়া আছে, রক্ত দেওয়া আছে তবে তা শোষকের সাথে রক্তের যুদ্ধ নয়। কার্ল মার্কস যেমন বলেছেন Thesis Antithesis synthesis এর কথা। এ নাটকেও তেমনটি দেখা গেলেও Thesis Ges antithesis এর দ্বন্দ্ব কোনো সশস্ত্র বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হয়নি। বরং শোষকের চেতনার শুদ্ধি এনে তাকে মানুষের বন্ধু হিসেবে পেতে দেখা গেছে। আর সে বিপ্লবের অধিনায়ক নন্দিনী। নন্দিনীর রক্তকরবী, রঞ্জন, বিশু, কিশোর সবকিছুই যেন শৈল্পিক এক বিপ্লবের প্রকাশ ঘটিয়েছে।

রক্তকরবী যদি শুধু একটি নাটক না হয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা চেতনার প্রকাশ হয়ে থাকে তবে সে চিন্তায় সমাজতন্ত্রের প্রভাব দেখতে পাওয়া গেলেও মার্কসীয় বিপ্লব থেকে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে শোষক, শোষিত, মুক্তি সব বিষয়ই আনা হয়েছে। দ্বান্দ্বিক বিষয়টিও সুস্পষ্ট। তবে কার্ল মার্কস সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন যে অর্থনৈতিক মুক্তির, সেখানেই রক্তকরবী তার গতিপথ পালটে ফেলেছে। মুক্তির পথ হিসেবে দেখানো হয়েছে শোষক এবং শোষিত উভয়ের মধ্যে আলোর প্রদীপ জ্বালানো। সে আলোর আরেক রূপ নন্দিনী, সে আলোর উপমা রক্তকরবী ফুল এবং সে আলোর যোদ্ধা রঞ্জন বিশু কিংবা কিশোর। সুতরাং রক্তকরবী এক বিপ্লব যা শিল্প এবং সৃষ্টি দিয়ে রাজা নয়, রাজনীতির পরিবর্তন আনে। যা অর্থনৈতিক মুক্তির চেয়ে সৃজনের আলোর মুক্তির পথ দেখায়।

...

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

অজয় কুমার ঘোষ।। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী : সমাজ বাস্তবতা (২০০৩)

শ্রুতিনাথ চক্রবর্তী ।। রক্তকরবী : গানের ভিতর দিয়ে (২০০৫)

শম্ভু মিত্র ।। নাটক : রক্তকরবী (১৯৯২)

ড. সুখেন বিশ্বাস ।। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী : সহজ পাঠ (২০১১)