জন্মদিনে

সুন্দর ও মহৎ

[কবি শামীম রেজার জন্মদিন আজ। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি শামীম রেজা ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ বরিশালের ঝালকাঠি জেলার বিষখালি নদীর কোলঘেঁষা থানা কাঠালিয়ার জয়খালি গ্রামে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ পাথরচিত্রে নদীকথা’(২০০১), ‘নালন্দা দূর বিশ্বের মেয়ে’(২০০৪), ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’(২০০৬), ‘ব্রহ্মাণ্ডের ইসকুল’(২০০৯), ‘হৃদয়লিপি’(২০১৪), ‘দেশহীন মানুষের দেশ’(২০১৮)। নাটক 'করোটির কথকথা', ছোটগল্প 'ঋতুসংহারে জীবনানন্দ', উপন্যাস ভারতবর্ষ’, প্রবন্ধ ‘সময় ও সময়ের চিত্রকল্পযখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরেকাব্যগ্রন্থের জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রবর্তিত কৃত্তিবাসপুরস্কার লাভ করেন ২০০৭ সালে।]


“যে স্মৃতিতে আলো নেই, সে স্মৃতি থাকে না হৃদয়।”

শামীম রেজা। তাঁর কবিতার সঙ্গে প্রথম আলাপ। কাব্যগ্রন্থ পড়ে বেশ ঘোর লেগে গিয়েছিল। কে এই কবি? যাঁর কবিতার নন্দনতত্ত্ব আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে হৃদয় ও শরীরকে! কবিতার নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আমাদের উপমহাদেশে আলোচনা বেশ কম। তার চেয়ে কবিতার বাক্য ধরে ধরে ছাত্রসুলভ আলোচনা যেন বেশি দেখা যায়। শামীম রেজার কাব্যে নান্দনিকতা একটি টেক্সচুয়াল কর্মের মধ্যে শৈল্পিক উপাদান বা অভিব্যক্তির উল্লেখকে অন্তর্ভুক্ত করে। তাঁর কবিতা আমার কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ শৈল্পিক অভিব্যক্তি, যা আমাকে রসতত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলে। কী সেই নান্দনিক ক্রিয়া যা শামীমের কবিতায় ফল্গুধারার মতো বয়ে চলে? তা হল সহৃদয় হৃদয়সংবাদী—তা কিন্তু নিছক ভাববাদী তত্ত্ব নয়। মানব জ্ঞানের উৎপত্তি কীভাবে হয় একথা বোঝাতে গিয়ে দার্শনিক কাণ্ট দুধরনের উপাদানের কথা বলেন—এক হল বস্তুগত ও অন্যটি হল ভাবগত। বুদ্ধি ও অনুভূতি মিলে সেই জ্ঞান তৈরি হয়। শামীমের কবিতাও যেন অভিজ্ঞতা ও বৌদ্ধিক ক্রিয়ার মিশেল। আচার্য অভিনবগুপ্ত কাব্যরসের সংজ্ঞা দিয়েছেন এইভাবে—তেন রস এব বস্তুত আত্মা…।

তত্ত্বকথা দূরে থাক। তাঁর কবিতায় আছে পুরাণ, যেমন বিশ্বের সব ছোটবড় বস্তুর (চেতন ও অচেতন) গায়ে লেগে আছে পৌরাণিক ধূলা। এই পুরাণের মধ্যে যেমন আছে প্রাক-ইতিহাস, তেমনই পূর্বজ কবিদের, লেখকদের আত্মার স্পর্শ। শামীম তাঁর কবিতায় সচেতন ও অচেতনভাবে প্রাক-ইসলামি মিথ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের ঋদ্ধ পুরাণকে খুব অক্লেশে ধারণ করে আছেন। উদাহরণ না দেওয়ার কথা ভাবলেও সে আর হয়ে উঠলো না।

“…আমার পরানি দক্ষিণদুয়ারি জুদি পর্বতে থাকে; যেথায় পাথর-বর্ষণ শেষে লুত জনপদ উল্টে গেছিল বাঁকে; উথলিয়া উঠিল উনুন, পরানি দেখিলো ইলাহা তাহার শুইয়া আছে অ্যাঙ্গোলার কফিক্ষেতে, ঘূর্ণিঝড়ের সমান্তরাল একটি লাটিম ঘোরে, ইলাহার চারিপাশে; ইলাহা তবু ঘুমায় বালিকার ক্লান্ত জলজ চোখে; ইলাহা, আরবের তেলকূপে বাঙালি শ্রমকির কাষ্ঠমাখা হাসি; ইলাহা, চানন নদীর জলে ভাইসা থাকা এক টুকরা চান; ইলাহা, না দেখা প্রেমিকার সাথে ঘুইরা বেড়ানো আমার সাম্পান; ইলাহা আমার পরানির মতো পড়শিবাড়ি থাকে, ধাঁধাময় এক সুরকাহিনীর গাঁয়; ধেয়ান সাগর পাড়ে জলপরীদের ঘরে—মনঘুড়ি উড়ায়; ইলাহা, আমার বাঙালকুমারী সবার অন্তরে বাস, জানি না কো তূণে গোপন রাইখা শিকার করবে হৃদয়ের কারুকাজ। যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে-৫০ বধূয়া আমার সান্ধ্যপাখির দলে, ধাঁধাময় পাহাড়ে থাকে, পথের বাঁশি হৃদয় মাঝে কাঁপে কোপাই নদীর বাঁকে।…” (যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে-৪০)

শামীম রেজার কবিতা অভিজ্ঞতার এক ঘনীভূত কল্পনাপ্রবণ সচেতনতা বা একটি নির্দিষ্ট আবেগপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার উদ্রেক করে যার পেছনে রয়েছে তাঁর কবিতার অর্থ, শব্দচয়ন এবং ছন্দ। তাঁর কবিতা এমন এক বিস্তীর্ণ বিষয়, যা মিথের ন্যায় প্রাচীন এবং ইতিহাসের মতো পুরনো, সেখানে ধর্ম উপস্থিত, বিদ্যমান মানুষের সহজ প্রবৃত্তি। তাঁর কবিতা ভাষা ব্যবহারের এক অনন্য উপায়। কিছু কবিতার কাল্পনিক শুরুতে মনে হয়, এটি ভাষা ব্যবহার করার একমাত্র উপায় ছিল, কবিতার গদ্যটি ছিল ডেরিভেটিভ এবং একটি কবিতা যেন অন্যটির তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী। শামীমের কবিতা এবং ভাষা উভয়ই বেশ ফ্যাশনেবল। কখনও মনে হয় তাঁর কাব্যদর্শন প্রাথমিক কৃষি সমাজে আচারের অন্তর্গত ছিল; বিশেষ করে ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’-র কবিতাগুচ্ছ পড়লে প্রতীত হয়, এ যেন ভাল ফসল নিশ্চিত করার জন্য আবৃত্তি করা যাদুমন্ত্রের আকারে উদ্ভূত হয়েছিল কোনও এককালে, রাত্রির গভীর যামে। জাদুবাস্তবতাকে অতিক্রম করতে পারে না শামীমের গদ্যও।

লেখা থেকে বেরিয়ে এলে শামীমকে দেখা যায় এক অনন্য মানুষ হিসাবে, সত্তা হিসাবে। তিনি একজন সফল অধ্যাপক, এবং তার আগে শামীম একজন তন্নিষ্ট পাঠক। তিনি কোনও বই যে ভাবে পাঠ করেন, তা বেশ ঈর্ষণীয়। কোনও টেক্সট সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে দেখেছি, শামীমের স্মৃতিশক্তিও ক্ষুরধার প্রকৃতির। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল, তাঁর ইনস্টিটিউটে গিয়ে কিছু ক্লাস নেওয়ার, সেই সুবাদে নানাবিধ আলোচনার সূত্রে জেনেছি ও বুঝেছি, কবি শামীম রেজা শুধু সফল কবিই নন, তিনি একজন নামজাদা অধ্যাপক ও গবেষক। আমি নিজে সাহিত্যের ছাত্র বা অধ্যাপক নই, কিন্তু শামীমের কাছে শিখেছি সাহিত্য তত্ত্বের নানান দিক। তাঁর কাছে জেনেছি, সাহিত্য তত্ত্ব বিশ্ব সাহিত্যকে ভীষণভাবে উপলব্ধি করতে সমর্থ করে। সাহিত্য তত্ত্বের লেন্সের মাধ্যমে যেকোনও ধরনের সাহিত্যকে আরও ভালভাবে বুঝতে, বিভিন্ন লেখকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও জানতে এবং সাধারণত লেখক এবং পাঠক উভয়ের জন্য সাহিত্যের মান উন্নত করার জন্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। সাহিত্য তত্ত্ব সাহিত্যকেও প্রভাবিত করতে পারে, নতুন অঞ্চলে বিকশিত হওয়ার জন্য পাঠ্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

সেই গুরুমারা বিদ্যে থেকে মনে হয়েছে, শামীমের সাহিত্য সম্পূর্ণ জাদুবাস্তব ঘরানার, যে জাদুবাস্তবতা পাশ্চাত্যের নয়, বরং তা অধিকতর মহাভারতীয়। এর জাদু হল সম্পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তীয় আর বাস্তব হল এই জগত। দর্শন তিন জিনিসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়—ভাষা, চিন্তন ও বাস্তব জগত। শামীমের কবিতায় জাদুবাস্তব দর্শন ফুটে উঠেছে ফুলের মতো। তা সুন্দর ও মহৎ।

ব্যক্তি শামীমের মতো বন্ধুবৎসল মানুষ এ সমাজে বিরল। সে সুন্দর ও মহৎ। কান্টের নন্দনতত্ত্বের ভাষায় 'the beautiful and the sublime'