আমাদের অস্তিত্বের অংশ

বিষাদ আর শোকের বাইরে মৃত্যুর তো কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। মৃত্যু সত্যি বটে, কিন্তু খুবই নির্মম। 
মোহাম্মদ রফিক আমাদের কাছের মানুষ। প্রিয় মানুষ। তার মৃত্যুতে এক গভীর বেদনা টের পাচ্ছি; বুঝতে পারছি, একটা মৃত্যু কীভাবে নিজের মৃত্যুর মুখোশ পরে আসে, কীভাবে নিজের অস্তিত্বের ভঙ্গুর দশাটা আরও প্রকট করে তোলে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর আমাদের অনেক গন্তব্যের একটা ছিল মোহাম্মদ রফিকের বাসা এবং তাকে আমরা ভাবতাম তেমনই এক বটগাছ, যার ছায়ায় অবসর সময় খুব স্বচ্ছন্দে কাটানো যায়।
বেশ বড় একটা সময় আমরা কাটিয়েছি তার সঙ্গে, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দিয়ে কিংবা স্রেফ কথা বলে। তার লেখার মতোই, তার আড্ডা আমরা উপভোগ করতাম।
এখন মোহাম্মদ রফিকের উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি বড় কোনো ব্যাপার নয়। তার সঙ্গে আমাদের কাটানো যে সময়, তা আমাদের অস্তিত্বের অংশ হয়ে গেছে। 

মোহাম্মদ রফিকের কবিতার পাঠক আমি, তবে খুব ভক্ত-পাঠক নই। তবু তার কবিতা সবসময় পড়েছি- তার সেই ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ থেকে শুরু করে তার শেষ দিকের ‘রূপকথা কিংবদন্তী’, ‘নোনাঝাউ’ কিংবা ‘দোমাটির মুখ’ পর্যন্ত। তার কবিতায় আমাদের গ্রাম-বাংলা, আমাদের সংস্কৃতির বিষয়-আশয়, আমাদের নদী, মাটি, মাটিমাখা মানুষকে পাওয়া যায়। এ বিষয়গুলোর ভেতর দিয়েই তিনি তার কবিতা-যাপন করতেন।
বাঙালির কোনো পুরাণ কাহিনি নেই, যেমন আছে গ্রিকদের, চীনা কিংবা ভারতীয়দের। রফিক আমাদের সাহিত্য থেকে, রূপকথা এবং জনজীবন থেকে এর একটা বিকল্প নির্মাণের চেষ্টা করেছেন কবিতায়- কপিলা, গাওদিয়া, নীল কমল লাল কমল, কীর্তিনাশা, বিষখালি এসেছে একটা মিথিক তাৎপর্য নিয়ে।  

যে ধরনের কবিতা পাঠে আমরা অভ্যস্ত, কবিতার ভেতর যে আনন্দ আমরা পেতে চাই, মোহাম্মদ রফিকের কবিতা সেই আনন্দ দেয় না। তবে তার ‘খোলা কবিতা’ এদিক থেকে আলাদা। এই কবিতা যে সময়ে লেখা সেটা এক উত্তাল সময়। এটা পড়ার সময় প্রতিটি স্তবকে সামরিক শাসকের বুটের আওয়াজ পাওয়া যায়।
তার পরের দিককার কবিতা অনেক বেশি আশা এবং স্বপ্নভঙ্গের এবং ক্রমশ তার কবিতা হয়ে উঠেছে আরও বেশি ঊষর এবং রুক্ষ। 

‘খোলা কবিতা’ প্রকাশের সেই সময় সাহিত্যের লোকেরা এ বিষয়ে কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা জানি না, তবে তাদের তরফ থেকে বড় কোনো প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকলে সেটা নিশ্চয়ই জানা যেত। এটুকু বলতে পারি, একজন কবি হিসেবে তিনি কর্তৃত্ববাদী শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। এই দাঁড়ানোটা কেবল এক স্বৈরশাসকের কবিতা বাসনার বিরুদ্ধে নয়, এটা ছিল একজন ফ্যাসিস্ট শাসকের মারণ-রাজনীতির বিরুদ্ধে। এরশাদ যে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করেছিল তার বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছেন, একজন কবি হিসাবে, একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে- এই বিরোধীতাই কাম্য ছিল এবং সেটাই তিনি করেছেন। 

মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে আড্ডা সব সময় ছিল আনন্দের, আমার কাছে তার গদ্যও ঠিক ওই রকমই, বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে তার ‘ভালোবাসার জীবনানন্দ’, ‘দূরের দেশ নয় আয়ওয়া’ কিংবা ‘আত্মরক্ষার প্রতিবেদন’-এর গদ্য অসাধারণ। ক্যাম্পাসে তিনি যতদিন ছিলেন, আমরা তার খুব কাছাকাছি ছিলাম। যদিও ক্যাম্পাস ছেড়ে দেওয়ার পর দেখা হতো খুবই কম এবং এখন আর কোনোদিনই দেখা হবে না। এই দেখা না হওয়ার শূন্যতা নিশ্চয়ই পূরণ করতে থাকবে তার লেখা কবিতা এবং গদ্যসহ সমস্ত রচনা, যা তিনি আমৃত্যু লিখে গেছেন। 

শ্রুতিলিখন: ইমন