হোর্হে লুইস বোর্হেসের সব ধরনের লেখার একটি সংকলন তৈরির জন্য নব্বই দশকের শুরু থেকেই আমি তৎপর হয়ে উঠেছিলাম। আর যেহেতু আমার লক্ষ্য ছিল, লেখাগুলো বহুজনকে দিয়ে অনুবাদ করিয়ে নেয়া, ফলে আমাদের নবীন থেকে প্রবীণ—সব অনুবাদকের সাথেই যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল এই কারণে। বোর্হেসের সব ধরনের লেখার পাশাপাশি তার সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টিও মাথায় এসেছিল, যেহেতু বোর্হেসের সাক্ষাৎকারও সাহিত্য ও পাণ্ডিত্যগুণে অসাধারণ। কিন্তু সেই সময় ঢাকায় লাতিন আমেরিকার লেখকদের বই বইয়ের দোকানগুলোতে মোটেই সহজলভ্য ছিল না। তাদের সাক্ষাৎকারের বই তো আরও দুরস্ত। সেই সময় পর্যন্ত ইংরেজিতে অনূদিত বোর্হেসের সবগুলো বই মনে হয় এককভাবেও কারো কাছে ছিল না। ফলে, বহু জনের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত লেখাগুলো আমাকে সংগ্রহ করতে হয়েছিল। বোর্হেসের সাক্ষাৎকার আমেরিকার দুএকটি পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করতে পারলেও, তখনও পর্যন্ত প্রকাশিত বহু সাক্ষাৎকার ছিল আমার আয়ত্তের বাইরে। তবে প্রবাসী বন্ধুদের সৌজন্যে তার সাক্ষাৎকারের দুএকটি বই সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু রবের্তো আলিফানোর ‘Twenty-four Conversations with Borges’ শীর্ষক বইটির নাম জেনেছি বা শুনেছি, কিন্তু চোখে দেখিনি তখনও পর্যন্ত। বন্ধু তাপস গায়েনকে বলেছিলাম তিনিও যেন বোর্হেসের একটি দুটি লেখা অনুবাদ করে এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হন। তাপস আমার কথায় রাজী হবেন—এটা ছিল অবধারিত। আর যদি হয় বোর্হেস তাহলে নিশ্চয়তা শতভাগ। হয়েওছিল তাই। সময়-বিষয়ক বোর্হেসের একটি সাক্ষাৎকার অনুবাদ করে পাঠিয়েছিলেন তিনি। আর ঘটনাক্রমে সেই সাক্ষাৎকারটি ছিল আলিফানো কর্তৃক গৃহীত। সাক্ষাৎকারটি পড়ে এতই ভালো লেগেছিল যে সেটি যে-বই থেকে অনুবাদ করা হয়েছে, সেই বইটি পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ঢাকায় আমার চেনা গ্রন্থকুবেরদের কাছে খুঁজছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে একদিন পেয়েও গেলাম সেটি বাবু ভাইয়ের সংগ্রহে। বাবু ভাই সাধারণত বই কাউকে ধার দেন না, কিন্তু আমি বোর্হেসের একটি সংকলন বাংলা ভাষায় প্রকাশ করছি জেনে তিনি নিজস্ব নিয়মে শৈথিল্য এনে ধার দিয়েছেন বইটি ফটোকপি করার জন্য।
আলিফানোর পরিচয় কেবল বোর্হেসের এই দিকটি উন্মোচনেই সীমিত নয়, তিনি বোর্হেসের সাহিত্যসচিব, ভ্রমণসঙ্গী, শ্রুতিলিপিকার এবং সহলেখকও। রবার্ট লুইস স্টিভেন্সন-এর গল্পগুচ্ছ এবং হেরমান হেস-এর কবিতাগুচ্ছের অনুবাদের ক্ষেত্রেও ছিলেন বোর্হেসের সহ-অনুবাদক। আর বোর্হেসের সাক্ষাতকারগৃহিতা হিসেবে তার অনন্য ভূমিকার কথা তো আগেই বলেছি।
কিন্তু বোর্হেসকেন্দ্রিক পরিচয়ের বাইরেও আলিফানোর আরও কিছু পরিচয় আছে যার হদিস আমাদের কাছে এখনও পর্যন্ত অজানাই রয়ে গেছে। ১৯৪৩ সালে জন্ম নেয়া আলিফানো শৈশবেই সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন আর্হেন্তিনার সবচেয়ে আলোচিত রাষ্ট্রপতি হুয়ান দোমিঙ্গ পেরনের। আর্হেন্তিনার এল কাসাদর নামক জায়গায় পেরনের সঙ্গে ফুটবল খেলার কৈশোরিক স্মৃতিও রয়েছে আলিফানোর। বহু বছর সাংবাদিকতার সূত্রে এই পেরনের মুখোমুখি হয়েছিলেন আবারও। পেরনের সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন। আর যখন প্রচার, প্রাপাগাণ্ডা এবং সবকিছুতেই পেরন-এর প্রতিমায় দেশের চেহারা আড়াল হয়ে যাচ্ছে তখন প্রবল ক্ষমতাবান সেই পেরনকে আলিফানো কথাচ্ছলে জানিয়ে দিলেন ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু এবং অপ্রয়োজনীয়। আলিফানো এসবের মধ্যে মুসোলিনিরই অনুসরণ লক্ষ্য করেছিলেন, যে-মুসোলিনি এক হাস্যকর দেবতায় রূপান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু পেরন এর কোনো জবাব না দিয়ে মৃদু হেসেছিলেন মাত্র। ফরাসি রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া মিতেরা, মেহিকোর রাষ্ট্রপ্রধান মিগেল দে লা মাদ্রিদ এবং সামরিক বাহিনীর বিশ্বাসঘাতকায় ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত চিলির রাষ্ট্রপতি সালবাদর আইয়্যেন্দের মতো ব্যক্তির সাথে কেবল পরিচয়ই নয়, তার সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন আলিফানো। আইয়্যেন্দের প্রতি তার আগ্রহ এবং পাবলো নেরুদার সাথে তার মাখামাখি আলিফানোকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছিলে। চিলির সামরিক বাহিনী সদ্যনিহত আইয়্যেন্দের প্রতি পক্ষপাত ও নেরুদার অন্তেস্টিক্রিয়ায় সন্দেহজনক উপস্থিতি লক্ষ্য করে তাকে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালিয়েছিল। পরে অবশ্য আর্হেন্তিনা ও বহির্বিশ্বের চাপে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আইয়্যেন্দেকে হত্যার ঘটনার আগে থেকেই আলিফানো চিলিতে সাংবাদিকতার সূত্রে গিয়েছিলেন। সেখানে পাবলো নেরুদার সাথে তিনি এতটাই ঘনিষ্ঠতা হয়ে যান যে নেরুদার কেবল প্রিয়ভাজনই নন, নেরুদার বন্ধু, ব্যক্তিগত সচিব এমনকি নেরুদার কোনো কোনো রচনার সহলেখক হয়ে ওঠেন। নেরুদার ইসলা নেগ্রার বাড়িতে তিনি কাটিয়েছেন মাসের পর মাস। আর যখন আলিফানোর মাথায় কবিতার নতুন বই প্রকাশের পরিকল্পনা এলো, তখন নেরুদাকেই অনুরোধ করলেন সে বইয়ের যুৎসই নাম দেয়ার জন্য। আর নেরুদা তৎক্ষণাৎ মুহূর্তের মধ্যে ভেবে জবাব দিলেন : “শিরোনাম? তোমার নামের শেষাংশই হবে শিরোনাম। ‘আলিফানো পদাবলি’, বইয়ের নাম এটাই হওয়া উচিত।” ( Titulo? Tu apelldo es el titulo. ‘Alfano Poesias’, Asi se debe llamar el libro.) আলিফানো সত্যি সত্যিই ২০০৪ সালে নেরুদার দেয়া নামেই তার ১৬তম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলেন। নেরুদা প্রথম সাক্ষাতেই আলিফানো নামের যে-বুৎপত্তি আর ইতিহাস মেলে ধরেছিলেন, সেখানে নানান বিষয়ে নেরুদার পাঠের এক বিস্তারও আমাদের চমকিত করবে। সবাই জানেন নেরুদা লিখেছেন প্রধানত কবিতাই। বোর্হেসের মতো নানান বিষয়ে মননশীল প্রবন্ধ বলতে গেলে লেখেননি। কিন্তু বহু বিষয় তার আগ্রহ আর পাঠ যে ছিল তা কেবল আলাপে ও আড্ডায় বসলেই বোঝা যেত। আলিফানো সেরকম এক অভিজ্ঞতার কথা জানালেন তার নিজের বয়ানে। আলিফানোর সাথে প্রথম পরিচয়ের দিন স্ত্রী মাতিল্দেকে নেরুদা বললেন : “এই তরুণের নাম আলিফানো, এই নামটি এসেছে সামনিউম (Samnnium )-এর রাজধানী আলিফা থেকে, আলিফা হচ্ছে রোমান যুগে ওয়াইনের বিখ্যাত এক অঞ্চল। আলিফানো আলিফা-এর ইঙ্গিত দেয়।” তিনি এরপর আমাকে বলেন, “তাছাড়া, রোমানদের দ্বারা ব্যবহৃত পানপাত্রকে তোমার নামে ডাকা হতো, এবং ভার্জিলের ‘Georgics’ বইটিতে তোমার উল্লেখ আছে, তিনি বলছেন রোমানরা আলিফানো পানপাত্র দিয়ে পান করছে, ওয়াইনের অভিধানেও তোমার উল্লেখ আছে, দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি।” এই বিষয়ে বেশ জোর দিয়েই তিনি শেষ করলেন এভাবে : “আমার নাম যদি আলিফানো হতো, তাহলে আমি নিজের নাম পাবলো নেরুদা রাখতাম না। তোমার নামের শেষাংশটা কাব্যিক।” (Asi Pasan Los Años, P 141)
নেরুদাকথিত আর্হেন্তিনার এই ‘কাব্যিক’ ব্যক্তিত্বের বন্ধুবৃত্ত শিল্প ও সাহিত্যের জগদ্বিখ্যাত বহুজনে সমৃদ্ধ। অক্তাবিও পাস, হুলিও কোর্তাসার, মারিও বার্গাস যোসা, আদোল্ফো বিয়ই কাসারেস, বিক্তোরিয়া ওকাম্পো, নিকানোর পাররা, কামিলো হোসে সেলা, হুয়ান রুলফো, গার্সিয়া মার্কেস, গ্রাহাম গ্রিন, কার্লোস ফুয়েন্তেস, লুইস বুনুয়েল, কার্লোস সাউরা, পিয়ের পাওলো পাসোলিনি, মারিয়া কাল্লাস, মার্সেল্লো মাস্ত্রোইয়ান্নি, সোফিয়া লোরেন, ভিত্তরিও দি সিকা প্রমুখ। এদের কারোর কারোর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি।
এই সব ব্যক্তিত্বদের সাথে আলিফানোর যোগাযোগ, বন্ধুত্ব ও চেনাজানার মূল কারণ ছিল একদিকে তার সাংবাদিকতার পেশা অন্যদিকে তার সাহিত্যিক নেশা। এই দুই বৃত্তি তাকে ঘনিষ্ঠতা ও নৈকট্যের দিকে নিয়ে গেছে। চিলি, পেরু ও আর্হেন্তিনার প্রধান গণমাধ্যমগুলোয় তিনি কাজ করেছেন যৌবনের শুরু থেকেই। ‘Siete dias’, ‘Clarin’, ‘La Nacion’, ‘La Tercera de la Hora’, ‘La Opinion’ শীর্ষক পত্রিকাগুলো ছাড়াও একাধিক টেলিভিশন ও রেডিওতে কাজ করেছেন আলিফানো। বোর্হেসের সাক্ষাৎকার ছাড়াও, তার নেয়া জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বই হচ্ছে LA ENTREVISTA.: Un autor en busca de sus personajes: Gardel, Perón, Borges, Fellini, Neruda, Gassman, Buñuel, Troilo. লুইজি পিরাদেল্লোর Six Characters in Search of an Author নামক গ্রন্থের শিরোনামটিকে সৃষ্টিশীল বিনির্মাণ ঘটিয়ে আলিফানো তার বইটির নাম রেখেছেন ‘সাক্ষাৎকার : নিজেরই চরিত্রদের সন্ধানে এক লেখক।’ অর্থাৎ যাদের সাথে তিনি মোলাকাত করেছেন, যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তারা কীভাবে আলিফানোরই সৃষ্টি হয়ে উঠছেন, এ যেন তারই ইঙ্গিত।
২.
আশ্চর্য ও বহুবর্ণিল এই মানুষটিকে কোনোদিন স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাবো, এ ছিল আমার কল্পনারও বাইরে। নব্বই দশকের শুরুতে যার একটি বইয়ের ফটোকপি পেলেই মনে হতো হাতে স্বর্গ পাওয়ার মতো, সেই বইয়ের লেখককে রক্ত-মাংসের সচল মূর্তিতে দেখতে পাবো আর তারই সাথে তৈরি হবে এক ‘মৈত্রিঘনিম’ সম্পর্ক—এ ছিল আমার কাছে এক বিস্ময়। বোর্হেস-বিশেষজ্ঞ বন্ধু আলেহান্দ্রো বাক্কারোর সহৃদয় আমন্ত্রণে যদি বুয়েনোস আইরেসে যাওয়ার সুযোগ না হতো তাহলে আলিফানোকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিতই থাকতে হতো। আলিফানো মানে আলিফানো নয়, তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বহু ব্যক্তিত্বের এক শত জল ঝরনার ধ্বনি। আর এই ধ্বনি স্বপ্নময় (De sueños y caminantes, Sueño que sueña), কোমল গান্ধার। তার কবিতাগুলো স্বপ্নের তন্তু দিয়ে জীবনকে বুনে যাওয়ার এক শিল্পরূপ। স্বপ্নাচ্ছন্ন তার দুটি বইয়ের নামের দিকে তাকালেই আমাদের কাছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে : একটির নাম Of dreams and walkers আর অন্যটির নাম Dream that Dream. সন্দেহ নেই যে এই শিরোনামগুলোয় বোর্হেসের ছায়ার প্রলেপ রয়েছে, কিন্তু আলিফানোর নিজস্ব উন্মীলনও কবিতাগুলোয় স্পষ্ট। প্রভাব এবং মৌলিকতা নিয়ে বোর্হেসের যেমন কোনো উদ্বেগ ছিল না, আলিফানোরও এনিয়ে কোন উদ্বেগ নেই। সাহিত্যে এই দুয়ের উপস্থিতি যে পরস্পরের বন্ধনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তা পরহেজগার পাঠক মাত্রেই জানেন।
নৈশভোজের দাওয়াত থাকায় দীর্ঘ সময় ধরেই আমরা একসাথে লেখক সমিতির ওই অফিস ছিলাম। এটি যদিও অফিস বলছি আসলে গান গাওয়া বা বক্তৃতা দেয়ার জন্য উঁচু মঞ্চ যেমন আছে তেমনি আছে মোটামুটি ২৫/৩০ জন অতিথিকে আপ্যায়ন করার জন্য খাওয়ার টেবিল বসানো জায়গা। কক্ষের মাঝখানে খানিকটা নিচু একটা মেঝে রয়েছে। সেখানেও আরও ১০/১৫ জন টেবিল নিয়ে বসতে পারে। আমি, আলেহান্দ্রো ও রবের্তোসহ অনেকেই নিচু মেঝেতে একটি টেবিল ঘিরে বসেছি। আর্হেন্তিনিয় ওয়াইন আর খাবারের পাশাপাশি আড্ডায় মুখর এবং আনন্দময় সময় কেটেছিল। খাবারের আগে আগে ছিল সঙ্গীতের এক আয়োজন যাকে অপেরা বলা হয়। এই ধরনের সঙ্গীতের সাথে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। তিনজন টেনর-এর অসামান্য পারফর্মেন্স দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।
কিন্তু আলিফানোর সাথে ওই প্রথম সাক্ষাতে মুগ্ধতার প্রথম প্রহর আমাকে এতটাই তাতিয়ে রেখেছে যে তার সাথে আরও বহু বিষয়ে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলাম। আর সেই সুযোগ এলো বইমেলার অন্য আরেকটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার আগে। সেদিন ছিল আলোহান্দ্রোর বোর্হেস-বিষয়ক বই নিয়ে অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের আগে আগেই উপস্থিত হয়েছিলাম আমরা। যেহেতু আগেই উপস্থিত হয়েছি তাই মেলার স্টলগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই চোখে পড়লো SADE-এর স্টলে আলিফানো উপস্থিত। কাছে গিয়ে তাকে বললাম, আপনার বইগুলো আমি কিনতে চাই। কিন্তু জানি না কোন স্টলে গেলে পাওয়া যাবে। আপনি কি বলতে পারেন কোথায় গেলে পাবো? আলিফানো তার স্বভাবসুলভ মিষ্টতা আর স্মিতহাস্যে বললেন, “আমার পুরোনো কোনো বইয়ের সংস্করণ এখন পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।” তিনি সামান্য ঘুরে একটি বই দেখালেন যেটি তার দেয়া সাক্ষাৎকারের একটি বই, নাম ‘Asi Pasas Los Años.’ আমি সঙ্গে সঙ্গে বইটি কিনে তার স্বাক্ষর নেয়ার জন্য এগিয়ে দিলাম। কিন্তু তার অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো তিনি বিব্রত। তার হয়ত এরকম মনে হয়ে থাকতে পারে যে তিনি বলাতে আমি বইটি কিনতে বাধ্য হয়েছি, এটাই হয়ত তার মধ্যে অস্বস্তির জন্ম দিয়ে থাকতে পারে। তিনি বললেন, “এটা আমি আপনাকে উপহার দিতে চাই, কেনার দরকার নেই।” আমি তার বিব্রত অবস্থা কাটাবার জন্য বললাম, “আপনি যদি আপনার কোনো বই উপহার দিতে চান, পরে দেবেন। আমি এটা কিনে নিচ্ছি কারণ এটি আমি পছন্দ করেছি।” তিনি আমার নাছোড় অবস্থা দেখে মেনে নিলেন। বইটি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, “দয়া করে আপনার স্বাক্ষর দিন।” বলা হয়নি যে আলিফানো একই সঙ্গে চিত্রশিল্পী, যদিও এই শিল্পের গহিন যাত্রী তিনি ছিলেন না, কিন্তু অন্য শিল্পের সহযোগী হিসেবে আভা ছড়িয়ে রেখেছে। সেই আভারই এক রেখাময় রূপ ফুটে উঠলো যখন তিনি বইটিতে স্বাক্ষর এঁকে দিলেন : শুধু লেখা নয়, লেখাকে রেখায়, আর রেখাকে এক ভাষিক মন্ত্রণায় বাঙ্ময় করে তুললেন স্বাক্ষরের মাধ্যমে। আর জানি না, কী ভেবে তিনি তার কোটের পকেট থেকে জাদুকরের মতো ছোট্ট একটি বই বের করে সেটাতে একইভাবে রেখা ও লেখার যৌথ আদর বুলিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ‘Sueño que sueña’ নামক ক্ষুদ্রাকৃতির অলংকৃত ও মুদ্রণশোভিত বইটি হাতে পেয়ে আমি ভীষণ আনন্দিত, রীতিমতো অবাক তার কাছ থেকে এই অভাবনীয় উপহার পেয়ে। বিরল এই সৌভাগ্যে বিশ্বাস করতে পরছিলাম না বলে আমি হতবিহ্বল হয়ে তার দিকে তাকিয়ে শুধু বলতে পেরেছিলাম, “এটা কি আমার জন্য?” “অবশ্যই এটা তোমার জন্য। আমার ছোট্ট উপহার।” ছোট্ট উপহার? মনে মনে নিজেকেই বললাম, আলিফানোর কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া কোনো কিছুই ছোট্ট হতে পারে না। আর যখন পাতা উল্টে দেখলাম এই বইয়ে বোর্হেসের ভূমিকা তখন তো এটা আর কোনোভাবেই ছোট নয়। বইটি হাতে পেয়ে আমি রীতিমতো বিহ্বল। কীভাবে তাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাবো বুঝতে পারছিলাম না। প্রাপ্তি যখন বিশাল হয়ে যায় কৃতজ্ঞা জ্ঞাপনের অভিব্যক্তি তখন এতটাই সংকুচিত হয়ে আসে যে তখন স্রেফ ধন্যবাদ জানিয়ে সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আমি ওই ছোট্ট ধন্যবাদটুকুই তাকে জানিয়েছিলাম। কারণ ওই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে গেলে তা অতিবচনের প্রাচুর্যে কথার সারমর্ম আরও বেশি ক্ষুদ্র হয়ে যেত। আমি সেই অতিবচনের ঝুঁকি নিতে চাইনি।
আলেহোন্দ্রোর বোর্হেস বিষয়ক বই নিয়ে আলোচনার সময় ঘনিয়ে আসতেই আমরা দুজনেই সেমিনার কক্ষের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়ে অপেক্ষা করছি কখন শুরু হবে। অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনও কিছুটা বাকি হলেও আলিফানোর তুঙ্গস্পর্শী খ্যাতির কারণে অনেকেই তাকে ঘিরে আছে। কেউ কেউ তার সাথে ছবি তুলছেন, সৌজন্য বিনিময় করছেন। তার নিজের লেখা এবং বোর্হেস ও তার সম্পর্কবিষয়ক নানান রকম কৌতূহলের জবাব দিচ্ছেন ধৈর্যের সাথে। বোর্হেস এখন নেই, কিন্তু বোর্হেসের সঙ্গ পেয়েছেন, দশ বছর বোর্হেসের ব্যক্তিগত সচিব এখনও বেঁচে আছেন, ফলে বোর্হেস সম্পর্কে কৌতূহলীদের কাছে তিনি বোর্হেসকে ব্যক্তিগতভাবে জানার এক অফুরান উৎস। আর বোর্হেস যেহেতু আর্হেন্তিনার এক আইকনিক ব্যক্তিত্ব, ফলে রবের্তো তাদের কৌতূহল নিবারণের এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিরাজমান। ঠিক এই কারণেই যে-কোনো সাহিত্যিক সমাগমে রবের্তো হয়ে ওঠেন মনোযোগের এক কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব।
রবের্তোর সাথে আমার শেষ দেখা বুয়েনোস আইরেস ত্যাগ করার আগেরদিন। সেদিন হোসে লুইস সাপাতেরোর বই ‘No voy a traicionar a Borges’ নিয়ে আলোচনার অনুষ্ঠান ছিল মেলার এক সেমিনার কক্ষে। আলোচক ছিলেন আলেহান্দ্রো আর রবের্তো। আমি সেদিন কৌতূহল নিয়ে হোসে লুইস সাপাতেরোর বইটি নিয়ে আলোচনা শোনার জন্য গিয়েছিলাম। তবে গিয়েছিলাম ঘণ্টাখানেক আগেই। আগে যাওয়ার একটা মুখ্য কারণ ছিল রবের্তোর সাথে একটু সময় নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার নেয়া। SADE-এর বইয়ের স্টলে তার সাথে দেখা হবে—এমনটা আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম। দেখলাম তিনি সময়মতো সেখানে উপস্থিত। ওখান থেকে তাকে নিয়ে প্রবেশ করলাম মেলার উত্তরপ্রান্তে দোতলায় একটি ছোট্ট রেস্তোরাঁয়। দোতলায় যাওয়ার কারণ ওখানে ক্রেতাদের কোলাহল কম। যেহেতু তার সাক্ষাৎকার রেকর্ড করবো, তাই খানিকটা জনবিরল জায়গা দরকার ছিল। রবের্তোকে যেহেতু হোসে লুইস-এর বইয়ের আলোচনায় থাকতে হবে তাই সময় নষ্ট না করে তার সাথে বোর্হেসবিষয়ক কথাবার্তা তার অনুমতি নিয়ে রেকর্ড করতে শুরু করে দেই। সম্ভবত ৩০/৪০ মিনিট তিনি কথা বলেছিলেন। অনুষ্ঠান শুরুর তখন মাত্র ৫/৬ মিনিট বাকি আছে, তাই আলাপ শেষ করে সেমিনার কক্ষের দিকে আমরা এগিয়ে গেলাম। রবের্তোকে ছেড়ে দিয়ে আমি শ্রোতাদর্শকদের মধ্যে একটি আসনে বসে রইলাম তাদের আলোচনা শোনার জন্য।
অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়ে লেখাটিকে দীর্ঘ না করে রবের্তোর সাথে সবশেষ আড্ডার কথা দিয়ে শেষ করব। অনুষ্ঠান শেষে আলেহান্দ্রোর বাসায় আলোচকসহ আমার নৈশভোজের দাওয়াত ছিল। কিন্তু এই দাওয়াতের কথা আমাকে আগে জানানো হয়নি। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে আগে আলেহান্দ্রোর ব্যক্তিগত সচিব পাত্রিসিয়া আমাকে এসে বলল, তুমি কিন্তু হোটেলে চলে যেও না, আলেহান্দ্রো তোমাকে দাওয়াত করেছে নৈশভোজের। ভাবলাম, বেশ তো, আমার যেহেতু অন্য কিছু করার নেই, ফলে তিন মোগলের সাথে খানা খেতে আপত্তি থাকা উচিত নয়। তাছাড়া, আপত্তির কথাই বা উঠবে কেন! আলেহান্দ্রো আমাকে এই বইমেলায় নিমন্ত্রণকারী, তাছাড়া, হোসে লুইস ও রবের্তোর সাথে অন্নগ্রহণ ও আড্ডার লোভ—কোনোটাই উপেক্ষণীয় নয়।
গত একুশ সেপ্টেম্বর ছিল রবের্তো আলিফানোর ৮০তম জন্মদিন। বহুবর্ণিল এই ব্যক্তিত্বকে তার আশিতম জন্মদিনে আমার শুভেচ্ছা ও আলিঙ্গন। আপনি দীর্ঘজীবী হোন প্রিয় আলিফানো।