মাহবুবুল হক : মননশীল ভুবনের উজ্জ্বল প্রতিভূ

উনিশ শতকের রেনেসাঁস এবং বিশ শতকের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন বাঙালিসমাজে যে আলো ফেলেছিল, সেই আলোকধারার ক্ষীণ যে আভাটি বাঙালিসমাজে এখনও যারা দীপ্তিমান রেখেছেন, মাহবুবুল হক তাদের অন্যতম। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙালিসমাজ প্রধানভাবে ছিল ভাব এবং ভক্তিপ্রবণ; পারলৌকিক জীবনবোধ এবং আধ্যাত্মিকতাই সেখানে মুখ্য ছিল। ধর্মের বাতাবরণে সামষ্টিকতায় সবকিছু এমনভাবে মোড়ানো ছিল যে, তাতে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ ছিল প্রায় রুদ্ধ। উনিশ শতকে ইউরোপীয় ভাবধারার প্রভাবে এ চিত্র বদলে যেতে থাকে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার, মধুসূদন প্রমুখ ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে যুক্তি, মানবতাবাদ, ইহজাগতিকতা, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রভৃতির উন্মেষ ঘটান। প্রথমদিকে হিন্দুসমাজে এর প্রভাব লক্ষ করা গেলেও পরবর্তীকালে মুসলমানসমাজও এতে জেগে ওঠে। বঙ্গদেশ তথা পূর্ববঙ্গে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি। বিশ শতকের চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তারা বুদ্ধিবৃত্তিক ও সংগ্রামী চেতনায় ক্রমে আত্মজাগ্রত হয়ে ভাষা-আন্দোলন এবং স্বাধিকার-সংগ্রামের পথ ধরে বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন আবাসভূমি তৈরির পথ প্রশস্ত করেন। শুধু তাই নয়, ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বাতাবরণ থেকে বের হয়ে চূড়ান্ত ধাপে আত্মজাগ্রত হয়ে তারা সৃষ্টি করেন একটি জাতিরাষ্ট্র। এর নেপথ্যে সংগ্রামী চেতনার পাশাপাশি কাজ করে বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাবোধ; ইতিহাস-ঐতিহ্য অন্বেষণ এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নব রূপায়ণ সবকিছুতেই এটি লক্ষ করা যায়। মাহবুবুল হকের চিন্তা ও মননশীলতা প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গেলে বাঙালিসমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার উন্মেষ ও বিকাশের এ পটভূমিটুকু সামনে রাখা আবশ্যক।

মাহবুবুল হকের জন্ম বিশ শতকের প্রথম ভাগের একেবারে শেষ দিকে, ১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর; দীর্ঘ দিনের পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত জাতি স্বাধীনভাবে শ্বাস নেওয়া শুরু করলেও সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং দেশভাগের দগদগে ক্ষত তখনও শুকায়নি। এদিকে যে স্বপ্ন নিয়ে পূর্ববঙ্গের মানুষ স্বাধীন পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল, পাকিস্তানি রাজনীতির নিয়ন্তাদের বৈরী আচরণে তা ক্রমে অবিশ্বাস ও সন্দেহ-সংশয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে তা অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে রূপ নেয়, যার ছোবল থেকে মুক্ত হতে এ অঞ্চলের মানুষ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা রক্ষার জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে হয়। বাঙালির সেই আত্মত্যাগ এবং রক্তশপথের পথ ধরে যে নবযাত্রা শুরু হয়, কিশোর মাহবুবুল হক সে পথের অন্যতম পথিক ছিলেন। শোষিত মানুষের মুক্তি আর সাম্যের ঝান্ডাবাহী প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের একজন কর্মী হিসেবে শুরু হয় তার দৃপ্ত পথযাত্রা। এই সঙ্গে বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলও বিকশিত হতে থাকে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তিনি ব্যাপকভাবে সক্রিয় হন। আনিসুজ্জামান তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক উদ্যোগের সঙ্গে আমার ছিল নাড়ির যোগ। রবীন্দ্র-জয়ন্তী-নজরুল-জয়ন্তী, একুশে ফেব্রুয়ারি-নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস-বিজয় দিবস—এসব পালনের জন্য যত কমিটি হচ্ছে, তাতে আমি থাকতাম। এই ধরনের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও পরিবেশনে আবুল মোমেন ও কামাল এ খানের বড় ভূমিকা থাকত। শামসুল হোসেইন ও মাহবুবুল হকও এসবের সঙ্গে জড়িত থাকতেন।’ পরবর্তীকালে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রভৃতি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কাজে সম্পৃক্ততার সূত্রে লাভ করেন আরও অনুকূল পরিবেশ। ফলে মননশীলতার চর্চাই তার কাছে হয়ে ওঠে মুখ্য। একে একে রচনা ও সম্পাদনা করেন ভাষা-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক অর্ধ-শতাধিক গ্রন্থ। বাংলা ভাষা, বানান, ব্যাকরণ; বাংলা সাহিত্য; অর্থাৎ বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে তিনি বিস্তর গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন। ম্যাক্সিম গোর্কির মা (১৯৭৯), আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (১৯৯১), বাংলা বানানের নিয়ম (১৯৯১), পাঠ্য বইয়ে বাংলা বানানের নিয়ম (১৯৯৪), বাংলা ভাষা : কয়েকটি প্রসঙ্গ (২০০৪), তিনজন আধুনিক কবি : সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য (২০০৫), লোকসংস্কৃতি : কয়েকটি প্রসঙ্গ (২০০৮), বাংলার লোকসাহিত্য : সমাজ ও সংস্কৃতি (২০১০), সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি, বইয়ের জগৎ : দৃষ্টিপাত ও আলোকপাত, বাংলা কবিতা : রঙে ও রেখায়, ভাষার লড়াই থেকে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ ফোকলোর ও অন্যান্য, বাংলা সাহিত্য : কয়েকটি প্রসঙ্গ (২০০৪), বাংলা সাহিত্য : নানা নিবন্ধ (২০১০), রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, বাংলা সাহিত্যের দিগ্‌বিদিক, কৃতীজন কৃতিকথা, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, নজরুল অভিধান, শেখ মুজিব তারিখ অভিধান— গ্রন্থের এমন তালিকা থেকে তার মননশীলতার বিস্তার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

মাহবুবুল হক তিরিশোত্তর কালের তিন আধুনিক কবি; সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার অভিসন্দর্ভটি পরিমার্জিত ও সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিষয়-নির্বাচন, বিশ্লেষণ-পদ্ধতি, ভাষাগত পরিমিতিমোধ সবদিক থেকেই তার প্রাতিস্বিকতার ছাপ স্পষ্ট। এই তিন কবির স্বকীয়তা চিহ্নিত করে মাহবুবুল হক তাদের কবিত্ব বিচার করেছেন এবং তাদের কবিতায় মার্কসীয় ও সাম্যচিন্তার যে প্রতিফলন—সে সম্পর্কে অনুপক্ষ বিশ্লেষণ করেছেন। দেশ-কালের স্বরূপ-অন্বেষণও তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তিনি লিখেছেন: ‘আমরা দেশকালগত পরিস্থিতির আলোকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই তিন কবির সাহিত্যকর্মের মূল্য নিরূপণের প্রয়োজন অনুভব করেছি। আর সেক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই গুরুত্ব দিয়েছি আলোচ্য কালপর্বে সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতায় যে পরিবর্তন ঘটে গেছে তার ব্যাপক প্রেক্ষাপট তুলে ধরার দিকে। বিশেষ করে এই কবিত্রয়ের কবিমানস ও কবিতায় যে প্রগতিচেতনার প্রকাশ ঘটেছে তা সম্যকভাবে অনুধাবনের ক্ষেত্রে এ দিকটির আলোচনা যথেষ্ট গুরুত্ববহ বলে মনে হয়েছে।’ সমর সেনের চোদ্দ বছরের কবিজীবন, তার কবিতার বিষয়-গভীরতা, তির্যক প্রকাশভঙ্গি, নাগরিকতাবোধ এবং দার্শনিকতা; সবই তুলে ধরেছেন মাহবুবুল হক। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মার্কসবাসে নিষ্ঠ হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত অন্য কোনো বিশ্বাসের ভূমিতে কবিসত্তার বিচরণের বিষয়টি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করেছেন। সুকান্তের দেশ-কালগত চিন্তা, শোষিতের প্রতি মমত্ব, শোষকের প্রতি ক্ষোভের যে প্রকাশ; তাতে কবিত্বের নিরীক্ষা অপেক্ষা বাগ্বিস্তারই প্রাধান্য পেয়েছে বলে তার ধারণা। এভাবে বাংলার মার্কসীয় রাজনীতির স্বর্ণযুগের তিন প্রধান কবির কবিসত্তা বিশ্লেষণে তার মননশীলতার অভিনিবেশ পাঠকের বোধের জগতকে ঋদ্ধ করে।

কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের সামগ্রিক দিক তুলে ধরে মাহবুবুল হক রচনা করেছেন নজরুল তারিখ অভিধান। নজরুলের জীবন ও সাহিত্য-সাধনার বিচিত্র দিক নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হলেও মাহবুবুল হকের এ বইটি ব্যতিক্রমী চিন্তার ফসল। পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলোতে অনেক ক্ষেত্রে নজরুল সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য থাকলেও তার এ গ্রন্থে সেটি লক্ষ করা যায় না। কবির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে ঘটনাপ্রবাহ ও কর্মের বিস্তার সবই সংক্ষিপ্ত ও পরিমিত ভাষ্যে তুলে এনেছেন মাহবুবুল হক। এক্ষেত্রে সাহায্য নিয়েছেন প্রামাণ্য ও আকর তথ্যের, যাতে সম্ভব হয়েছে নজরুল-জীবনী পুনর্গঠন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন : “বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত জন্মশতবর্ষ সংস্করণ নজরুল-রচনাবলী এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাডেমি থেকে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলাম রচনাসমগ্রে নজরুলের বেশ কয়েকটি গ্রন্থের প্রকাশকালের সন-তারিখগত বিভিন্নতা দেখা যায়। যেমন নজরুল-রচনাবলী-তে ‘রিক্তের বেদন’-এর প্রকাশকাল ১ মার্চ ১৯২২, রচনাসমগ্রে প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ১৯২২। নজরুল-রচনাবলী-তে ‘ব্যথার দান’-এর প্রকাশকাল ১২ জানুয়ারি ১৯২৫, রচনাসমগ্রে প্রকাশকাল ডিসেম্বর ১৯২৪। নজরুল-রচনাবলী-তে ‘রুদ্রমঙ্গল’-এর প্রকাশকাল ১৯২৭, রচনাসমগ্রে ১৯২৫-১৯২৬। সন-তারিখগত এ রকম পার্থক্য আরও আছে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাডেমি থেকে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলাম রচনাসমগ্রের ৭ম খণ্ডে নজরুলের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি দেয়া হয়েছে। এটিও তথ্যবিভ্রান্তি থেকে মুক্ত নয়। যেমন: ১) নজরুলের পিতার মৃত্যু ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ৭ চৈত্র অনুযায়ী হবে ২০ মার্চ ১৯০৮। কিন্তু লিপিবদ্ধ হয়েছে ৮ এপ্রিল (পৃ. ৬৪৯)। ২) নজরুলের তৃতীয় পুত্রের জন্মতারিখ বলা হয়েছে ৯ সেপ্টেম্বর। আসলে তা হবে ৯ অক্টোবর। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নজরুল-রচনাবলী প্রথম খণ্ডে সন-তারিখের ভুলসহ বিভিন্ন ভুল ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন ‘বিষের বাঁশি’ ১৬ শ্রাবণ প্রকাশিত হয় বলে গ্রন্থ-পরিচয়ে উল্লেখ আছে। সে হিসেবে খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশকাল হবে ১ আগস্ট, কিন্তু ছাপা হয়েছে ১০ আগস্ট। এ জাতীয় ভুলভ্রান্তি, নজরুল-জীবনীর প্রামাণিকতা, নির্ভরযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে সংশয়াচ্ছন্ন করে তোলে। নজরুল তারিখ-অভিধান-এ তাই প্রামাণ্য তারিখ যথাসম্ভব নির্দিষ্ট করে এ ধরনের বিভ্রান্তি নিরসনে প্রয়াসী হয়েছি।” বাস্তবেই নজরুল-জীবনের প্রামাণ্য তারিখ নিয়ে যে-সব বিভ্রান্তি ছিল, তা নিরসন করে মাহবুবুল হক এ গ্রন্থ রচনা করেছেন। একইভাবে বঙ্গবন্ধুর মহাজীবনের সন-তারিখগত পার্থক্য যাচাই-বাছাই করে তথ্যভ্রান্তি নিরসনের লক্ষ্যে রচনা করেছেন শেখ মুজিব তারিখ অভিধান গ্রন্থটি।

প্রায়োগিক বাংলা তথা বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে তার পঠন-পাঠন ও চিন্তার গভীর অভিনিবেশ ঘটেছে। বাংলা ভাষার প্রমিত ব্যাকরণ, প্রমিত বানান; এসব তার গবেষণার বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ রচনায় তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলা বানানের নিয়ম, খটকা বানান-অভিধান প্রভৃতি গ্রন্থ তার বানান-চিন্তার ফসল। বাংলা বানান নিয়ে বাঙালি লেখক-পাঠকদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি, সময়ের বহমানতায় বানানের যে রূপ-বদল, বানান-সম্পর্কে বাঙালির ঔদাসীন্য, অবহেলা ও হঠকারিতা; এসব বিষয় তাকে গভীরভাবে ভাবিত করে। যার নিরসনে তিনি বলেছেন : ‘শব্দের বানান শুদ্ধ করে লিখতে পা শিক্ষিত লোকের একটা প্রয়োজনীয় দক্ষতা। ... যে-কোনো লেখার বানান শুদ্ধ হওয়া চাই। তা না হলে রেখা যেমন যথাযোগ্য মানের বলে বিবেচিত হয় না তেমনি ভুল বানান অনেক ক্ষেত্রে লেখকের বক্তব্যকেও বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। তাই, শুদ্ধ বানান যে-কোনো লেখা ও লেখকের জন্য একটি অপরিহার্য গুণ। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, বানানের ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ নির্ভুলতা আয়ত্ত করা খুব সহজ নয়। আর সেজন্যেই আমাদের সবার প্রচেষ্টা হওয়া উচিত, যতটা সম্ভব বানান ভুল পরিহার করা। এটি তেমন কঠিন কাজ নয়। প্রয়োজনমতো সময় নিয়ে নিয়মিত প্রচেষ্টা চালিয়ে সহজে এ দক্ষতা অর্জন সম্ভব।’ বাংলা বানানের নিয়ম গ্রন্থে তিনি ভাষাতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণগত দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা বানানের সমস্যা দূরীকরণের প্রয়াস চালিয়েছেন। বিভিন্ন সময় বাংলা সংস্কারে যে-সব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং বাংলা বানানের নিয়মকানুন চালু করা হয়েছে, সেগুলোর মূলসূত্র অনুসরণ করে বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়ন করেছেন। খটকা বানান-অভিধান গ্রন্থে তিনি লেখালেখি ও মুদ্রণের কাজে বাংলা বানান নিয়ে সময় সময় যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়, তা নিরসনের পথ-নির্দেশ করেছেন। এক্ষেত্রে কোনো হুকুমদারি নয়; বরং ভাষাবিশেষজ্ঞ, বানানবিশারদ এবং অভিধানকারগণের অভিমত বিবেচনায় রেখে বানান-বিভ্রান্তি দূরীকরণে সচেষ্ট থেকেছেন।

লোকসংস্কৃতি, বাংলা ভাষা-সাহিত্য, রুশ ভাষার সাহিত্য প্রভৃতি নিয়ে তার কয়েকটি গ্রন্থ ও অনেক প্রবন্ধ রয়েছে। এসব লেখায় তার প্রজ্ঞা, ধীশক্তি, অনুসন্ধিৎসু মনীষার পরিচয় মেলে। শিশুতোষ গ্রন্থগুলোতে শিশুদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-মূল্যবোধ শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলার পাশাপাশি ভাষা বিষয়ে কৌতূহলী ও দক্ষ করে তোলার সযত্ন চেষ্টা চালিয়েছেন। বীরশ্রেষ্ঠদের কথা, ছড়ায় ছড়ায় বাংলা ব্যাকরণ, গল্পে গল্পে ভাষা আন্দোলন প্রভৃতি গ্রন্থের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্যও তিনি রচনা করেছেন ব্যাকরণ গ্রন্থ; যার মধ্যে রয়েছে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সহজপাঠ ব্যাকরণ ও নির্মিতি এবং অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিদ্যার্থী ব্যাকরণ ও নির্মিতি। শিশুদের প্রায়োগিক শিক্ষায় দক্ষ করতে এবং শোনা, বলা, পড়া ও লেখায় পারদর্শী করে তোলার চিন্তা মাথায় রেখে তার এ গ্রন্থগুলো রচিত।

মাহবুবুল হক সংস্কারমুক্ত মন ও প্রগতিশীল দৃষ্টির অধিকারী। বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের ধারায় তার মন-মনন পরিপুষ্ট। উনিশ শতকের রেনেসাঁস, বিশ শতকের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, পঞ্চাশের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং সত্তরের দশকের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারায় ধারায় নিজের মেধা-মননকে শানিত করে নিয়েছেন তিনি; যার প্রকাশ ঘটেছে তার লেখালেখি ও গবেষণায়। সার্বিক মূল্যায়নে বলা যায়, মাহবুবুল হকের মননশীলতা বহুমাত্রিক ও বিচিত্র এবং প্রজ্ঞার দীপ্তিতে ভাস্বর। দীর্ঘ-সাধনার পথ ধরে তা ক্রমে বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। রামমোহন-বিদ্যাসাগর বঙ্গ-মুল্লুকে মননশীলতার যে ধারার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে অগণিত মনীষার মেধা-মননে, তা ঋদ্ধ হয়েছে। মাহবুবুল হক সে ধারারই একজন উত্তরসাধক। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রভৃতি বিষয়ে তার যে অনুসন্ধিৎসা, তা তাকে স্মরণীয় করে রাখবে বহুকাল।