মহানির্বাণ

১৯৪১-এর ৩০ জুলাই, অবশেষে কবিকে অপারেশন টেবিলে যেতেই হলো। সেদিন সকালেই অশক্ত শরীরে মুখে মুখে রচনা করলেন, "তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/বিচিত্র ছলনাজালে, হে ছলনাময়ী", রানি মহলানবিশ লিখে রাখলেন। সকাল সাড়ে ন-টা নাগাদ আরও তিন লাইন যুক্ত করলেন— "অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/সে পায় তোমার হাতে/শান্তির অক্ষয় অধিকার।" রবীন্দ্রনাথ তাকে বললেন, কিছু গোলমাল আছে, পরে ঠিক করে দেবেন। কিন্তু এই সুযোগ তিনি আর পেলেন না। সকাল এগারোটা নাগাদ তার অপারেশন হয়। এরপর ক্রমশ আরও খারাপ হয়ে ওঠে কবির শরীর। এলো বাইশে শ্রাবণ, ইংরেজির ৭ আগস্ট, এ শুধু 'কবির মৃত্যুদিন' নয়, বাঙালির শ্রেষ্ঠ আইকনের 'মহানির্বাণ'-এর দিন। যে প্রয়াণ ও তাকে ঘিরে ঘটে চলা নানা ঘটনা, অসম্মান ও গ্লানির হাজারও জিজ্ঞাসা আজও আমাদের মাথা নীচু করে দেয়। শৈশবে, মাত্র ১১ বছর বয়সে ডেঙ্গু জ্বরের হাত থেকে রক্ষা পেতে কলকাতা ছেড়ে গঙ্গা তীরের পানিহাটিতে আশ্রয় নিয়েছিল ঠাকুর পরিবার। পরিবারের একজন হিসেবে সে ছিল রবিঠাকুরের প্রথম 'বাসা' থেকে বাইরে যাওয়া। সেবার প্রাণচঞ্চল বালককে সম্ভাব্য মরণের কোপ থেকে রক্ষা করতে বড়রা নিয়ে গিয়েছিলেন অন্যত্র। এর সাত দশক পরে আশি পেরোনো কবিকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে নিয়ে আসা হলো সেই জোড়াসাঁকোয়, যেখানে তাকে মরণের কাছেই সমর্পণ করা হলো।

রবীন্দ্রনাথ, বাংলা তথা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রতিভা, হৃদয়ে যার ছিল দুর্বার প্রাচুর্য, অনুভবে, অসাধারণ স্পর্শকাতরতায় যিনি সমৃদ্ধ করে গেছেন আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, দেশাচারকে অথচ সেই মানুষটির চলার পথ কিন্তু কখনও 'ফুল্লকুসুমিত' ছিল না। বারংবার অসম্মান, অবজ্ঞা, উপেক্ষা, ঈর্ষার কাঁটায় রক্তাক্ত হতে হয়েছে তাকে। তার শেষ যাত্রাও এই অসম্মান ও আঘাত হতে মুক্ত থাকেনি। গোটা জীবনই তো তিনি মৃত্যুর 'শোকযাত্রা' দেখেছেন, মৃত্যুলোক বারবার তাকে বিধ্বস্ত করতে চেয়েছে, তবে মৃত্যুশোক তাকে আঘাত করলেও পরাভূত করতে পারেনি। ১৯০০ সালের নভেম্বরে কলকাতা থেকে স্ত্রী মৃণালিনীকে লিখেছিলেন, "বেঁচে থাকতে গেলেই মৃত্যু কতবার আমাদের দ্বারে এসে কত জায়গায় আঘাত করবে—মৃত্যুর চেয়ে নিশ্চিত ঘটনা'ত নেই, শোকের বিপদের মুখে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ বন্ধু জেনে যদি নির্ভর করতে না শেখ তাহলে তোমার শোকের অন্ত নেই।"

মাত্র-চৌদ্দ বছর বয়সে তার মায়ের মৃত্যু হয়। তার বিয়ের দিন, যখন তিনি নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ঢুকছেন সে সময়ই মৃত্যু বেছে নেন ঠাকুরবাড়ি ঘরজামাই সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, সৌদামিনীর স্বামী, যার উপর ছিল জমিদারি দেখাশোনার ভার। বিয়ের চার বছরের মধ্যেই আত্মঘাতী হলেন তার 'বৌঠান' কাদম্বরী দেবী। রবীন্দ্রনাথের পর আরও এক ভাই জন্মেই মারা যান, দু'ভাই ছিলেন বদ্ধ উন্মাদ। তার মাত্র আঠাশ বছর বয়স যখন, মারা গেলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী। প্রিয়তম পুত্রের মৃত্যু, কন্যার মৃত্যু যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হয়েছে। একমাত্র দৌহিত্র, মীরা দেবীর পুত্রের নিষ্ঠুর মৃত্যুর শোককে কবি প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন তার মতো করেই, 'যাবে যদি যাও, অশ্রু মুছে যাও।'

কবির উনচল্লিশতম জন্মদিনে, ১৩০৭-এ "জন্মদিনের গান'-এর শিরোনামে কবি লিখেছিলেন— 'ভয় হতে তব অভয় মাঝারে' যাত্রা করার প্রার্থনাটি। এই গানে ব্যক্ত হয়েছিল অস্তিত্বভীতি, জাগতিক-অধিজাগতিক নানা ভয় জয় করে নতুন জন্মলাভের বাসনা। তিনি ব্যাকুল ছিলেন 'সকল দীনতা-সংশয়-জড়তামুক্ত' নতুন জীবনের আস্বাদ পেতে। সুখ-দুঃখের ব্যক্তিগত বলয় থেকে সরে সেই আনন্দলোকে লীন হতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যে নবজন্মের উন্মেষ তিনি চেয়েছিলেন, আত্মমুক্তির পথেই আসে সেই নবজন্ম। উল্লিখিত গানটির পর রবীন্দ্রনাথ তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে দীর্ঘদিন আর কিছু লিখতে চাননি, লেখেননি। এর এক দশক পরে, তার পঞ্চাশতম জন্মদিন উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতনে যে উৎসবের আয়োজন হয়েছিল সেই উপলক্ষ্যে 'জন্মোৎসব' লেখেন। এখানে কবির দর্শন বহুমাত্রিক। লেখেন 'যতক্ষণ মানুষের মধ্যে নব নব সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত থাকে ততক্ষণ তা নতুন বলে বিবেচ্য হয়, তা আশা ও ঔৎসুক্যকে জাগিয়ে রাখত'। তিনি এখানে হয়ত কিছু নস্টালজিক হয়ে ওঠেন, ফিরে যান তার তারুণ্যে। এখানে তার কাছে 'উৎসব' জিনিসটাই হচ্ছে নবীনের উপলব্ধি। জন্মদিন হচ্ছে অপরকে আপনার করে পাওয়ার দিন, তাকেও অপরেরও আপন করে নেবার দিন। তার অতীত, তার তরুণ কালকে মনে করেন, যখন নিজেকে মনে হতো অসীম সম্ভাবনাময় এক সত্তা যার ভবিষ্যৎ দূরবিস্তৃত, যার রহস্যলোকের জীবন অনাবিষ্কৃত। এই দিনে কবি আসলে নিজের সত্তার অন্তর্গত করার মধ্য দিয়ে নিজেকেই বহুগুণ ফিরে পান।

রবীন্দ্রনাথ বাইরের আমি ও অন্তরের আমি-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন নানা ভাবে, এই সূত্রে তিনি কেন্দ্র ও প্রান্তের প্রসঙ্গ এনেছেন। স্বার্থমগ্ন আমি হচ্ছে কেন্দ্র, অন্য সমস্ত কিছু পরিধির প্রান্ত। "ওই স্বার্থমগ্ন আমিকে সকলের মঙ্গলকামনায় বিগলিত করার মধ্য দিয়ে সমগ্রের অন্তর্বর্তী করতে হয়। এক নিভৃত আমি-এর বিপরীতে আমি-এরই আরেক ক্ষুদ্রখণ্ড-অহংসর্বস্ব আমিত্ব আছে, তার উত্তরণ ঘটে সমগ্রের প্রাণ জড়িয়ে গিয়ে নিভৃত-আমির প্রাণসৃষ্টিতে। জন্ম উৎসবে কবি এই সমগ্রের প্রাণ স্পর্শ পান।" রবীন্দ্রনাথের শেষ জন্মদিনের স্মৃতিকথা তার দাদা সতেন্দ্রনাথের প্রপৌত্র সুপ্রিয় ঠাকুর লিখেছেন— "রবীন্দ্রনাথের শেষ জন্মদিন উদ্যাপিত হয়েছিল উদয়নের বারান্দায়। আর সেখানেই পড়ে শোনানো হয়েছিল সেই কালজয়ী রচনা 'সভ্যতার সঙ্কট'। অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ একটি চেয়ারে বসে আছেন, তার পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষিতীশ রায় পড়ছেন 'সভ্যতার সংকট'। আশ্রমবাসীরা সামনে স্তব্ধ হয়ে বসে সেই রচনা শুনছে"।

কবির শারীরিক অবসন্নতার ছাপ তার লেখাতেও চিহ্ন রাখছিল। ১৩২৯ এর ২৫ বৈশাখ লেখা ‘পঁচিশে বৈশাখ’ (পূরবী)-এ তিনি আবেগময় ও বাণীঋদ্ধ, যদিও তখন তিনি জীবনসায়াহ্নের পথে। তখনো তার কাছে পঁচিশে বৈশাখ 'জন্ম-স্মরণ-পূর্ণবাণী'। এর একদশক পরে 'জন্মদিন'-এ নিজেকে তপস্বী ভাবেন কবি, যাকে বলেন নিজের 'রুদ্রসত্তা'। নিজের রৌদ্রদগ্ধ দিনগুলো-যন্ত্রণাদগ্ধ ক্ষুব্ধ প্রজ্বলন্ত বাস্তবতা দিয়ে গাঁথা মালা তিনি রুদ্রের হাতে সঁপে দিতে চান। কেন রবীন্দ্রনাথ এ সময় রৌদ্রদিনের কথা বলছেন? কেন রুদ্রকে বলেন "তপস্যান্তে নেমে এসো ছায়া ঘন বনভূমিতে” যেখানে “অরুণ আকাশ আষাঢ়ের আভাসে করুণ?” বেশ কয়েক বছর আগেই 'পূরবী'-তে যে শারীরিক অবসন্নতার ছায়া দেখা যাচ্ছিল না সেই ছায়া এখানে কবির মনকে ছুঁয়েছে। জীবনের পরম সন্ধ্যায় উপনীত হয়ে চাইছেন স্থূল তর্ক-সন্দেহ-খ্যাতি-দুরাশা ছেড়ে সহস্র হতে, লিখছেন, “আমি যাই, রেখে যাই মোর ভালবাসা”। ‘তরঙ্গমণ্ডিত জনসমুদ্রতীরে’ কবি যে কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হয়েছেন, বারংবার আক্রান্ত হয়েছেন, মুখোমুখি হয়েছেন জীবনের রণক্ষেত্রে সংগ্রামের সংঘাত-দ্বন্দ্বে, "যার পায়ে বিঁধেছে কাঁটা/ক্ষত বক্ষে পরেছে রক্তধারা"।

এই রবীন্দ্রনাথকেও শেষ সময়ে সহ্য করতে হলো চূড়ান্ত অসহনীয় যন্ত্রণা, তার যাবতীয় ইচ্ছাকে পায়ের তলায় দুমড়ে মুচড়ে মৃতদেহকে দুষ্কৃতিদের মতো ছিনিয়ে নিয়ে চিতায় তোলা হলো, সেই দৃশ্য ভাবলে আজ গ্লানিতে মাথা নীচু হয়ে যায়। এমনকি, তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন যে শয্যায় সেটি এবং তার চিতাভস্ম-সহ কলসটিও বেমালুম বেপাত্তা হয়ে গেল!