সিডনিতে আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলন

পাঠকের মুখোমুখি শাখাওয়াৎ নয়ন

Book Trail Campbelltown শিরোনামে সিডনির দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় ক্যাম্বেলটাউনে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনটি শুরু হয়েছে গত শনিবার ৭ মে। আগামী শনিবার ১৪ মে সকাল ১০টায় দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে চলবে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। এই সম্মেলনটি আয়োজন করছে এ বি স্ট্রিট লাইব্রেরি ও রেইনবো ক্রসিং। অস্ট্রেলিয়ান সরকারের অর্থায়নে এবং সার্বিক সহযোগিতা করছে ক্যাম্বেলটাউন সিটি কাউন্সিল। দুদিনব্যাপী সম্মেলনের প্রথম দিনে অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার ১২ জন স্বনামধন্য লেখক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ৬ জন অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ‘বোহেমিয়ান’ ঔপন্যাসিক খ্যাত বাঙালি অস্ট্রেলিয়ান কথাসাহিত্যিক শাখাওয়াৎ নয়ন। প্রথম দিনে বাঙালি কবি, লেখক, সাংবাদিক ছাড়াও অসংখ্য পাঠকের সমাগম ঘটে।

উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. শাখাওয়াৎ নয়ন দীর্ঘ দিন ধরে লেখালিখি করছেন। তিনি এ পর্যন্ত মোট ৫টি বই লিখেছেন এবং দুটি বই সম্পাদনা করেছেন। গত বইমেলায় তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস ‘বোহেমিয়ান’ বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এটি বাংলাদেশে রকমারিডটকম-এর বেস্টসেলার তালিকায় শীর্ষে অবস্থান নেয়। কথাসাহিত্যিক শাখাওয়াৎ নয়নের সেশনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে সকাল ১১টায় ক্যাফে স্ট্যাম্পে। উক্ত অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর লেখকজীবনের শুরু থেকে অদ্যাবধি সংক্ষেপে তুলে ধরেন। ১৯৯৭ সালে তাঁর লেখালিখি জীবনের শুরু। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসকে উপজীব্য করে তিনি একটি নাটক রচনা করেন ‘গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়’। নাটকটি তাঁরই নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের নবীনবরণ এবং বিদায়ী অনুষ্ঠানে মঞ্চস্ত হয়।

২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রবন্ধ লিখলেও তাঁর প্রথম গল্প ‘মায়াবতী’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে দৈনিক প্রথম আলোর ভ্যালেন্টাইনডে সংখ্যায়। এরপর ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নিয়মিত দৈনিক প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ ম্যাগাজিনে গল্প লিখেছেন। 

শাখাওয়াৎ নয়নের প্রথম বই ‘ব্যাপ্টিস্ট চার্চ এবং একটি টিকটিকির গল্প’ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের একুশে বইমেলায়। বইটি প্রকাশিত হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই প্রথম মুদ্রণের সকল কপি বিক্রি হয়ে যায়। বইমেলা চলাকালীন দৈনিক কালের কণ্ঠ, সমকাল এবং বাংলানিউজ২৪ডটকমের নির্বাচিত সেরা ১০টি বইয়ের তালিকায় ‘ব্যাপ্টিস্ট চার্চ এবং একটি টিকটিকির গল্প’ স্থান করে নেয়। ২০২২ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘বোহেমিয়ান’ পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। মাসব্যাপী বইমেলায় বইটি বেস্ট সেলার উপন্যাসের তালিকায় স্থান করে নেয়। 

Book Trail Campbelltown নামক এই লেখক সম্মেলনেও উপস্থিত কবি, লেখক এবং পাঠকদের মধ্যে ‘বোহেমিয়ান’ নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল লক্ষ করা গেছে। উল্লেখ্য, শাখাওয়াৎ নয়নের বক্তব্য শেষ হতে না হতেই অসংখ্য প্রশ্ন উত্থাপিত হতে দেখা গেছে। নয়ন অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্তভাবে ধৈর্যের সাথে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। এক পর্যায়ে তাঁর জন্য নির্ধারিত সময় বেলা ১১টা থেকে ১২টা পেরিয়ে গেলেও দর্শকেরা অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে রাজি হননি। তাই অনুষ্ঠানের মূল বক্তব্য এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হলেও লেখক-পাঠকের আড্ডা চলতে থাকে দুপুর দেড়টা পর্শন্ত। অতঃপর আয়োজকদের বিশেষ অনুরোধে আড্ডা শেষ করতে হয়। 

প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন অস্ট্রেলিয়ান লেখক মিস্টার জনাথন জানতে চান, যেহেতু ‘বোহেমিয়ান’ একটি বেস্ট সেলার উপন্যাস; সুতরাং এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করা হবে কি না? রবীন্দ্রনাথের পর আর কোনো বাংলা সাহিত্যিককে আমরা তেমনভাবে পাই না কেন?

শাখাওয়াৎ নয়ন : ধন্যবাদ। অবশ্যই চাই ‘বোহেমিয়ান’ উপন্যাসটি ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ হোক। উপযুক্ত অনুবাদক এবং প্রকাশক খুঁজছি। দুর্ভাগ্যবশত বাংলা ভাষায় প্রকাশিত খুব কম বই-ই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। এমনকি ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্য যখন কোনো আলোচনাতেই ছিল না, তখন ১৯১০ সালে বাংলা সাহিত্য ‘গীতাঞ্জলী’ ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। ফলে, রবীন্দ্রনাথের সেই গীতাঞ্জলীই ১৯১৩ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছে। আমি বলছি না- ‘বোহেমিয়ান’ নোবেল পাবে। তবে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালেও বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশের মতো কবি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো উপন্যাসিক এসেছেন কিন্তু ইংরেজি অনুবাদ না হওয়ার কারণে বিশ্বসাহিত্যের আলোচনায় সঠিক সময়ে আসতে পারেনি। তবে আমার বিশ্বাস, আমি না পারি আমাদের বাংলা সাহিত্যের বই একদিন ঠিকই ইউরোপের ২৩/২৪টি ভাষায় অনূদিত হবে।

সাবিনা ইয়াসমিন বেবী : লেখার সময় ইমোশন নাকি নির্মাণ কৌশল কোন বিষয়টিকে প্রাধান্য দেন? কোনটি আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
শাখাওয়াৎ নয়ন : খুব ভালো প্রশ্ন। ধন্যবাদ। হার্ট অর ব্রেইন? হার্ট কিংবা ইমোশন ছাড়া তো সৃজনশীল লেখা সম্ভব নয়। প্রথমে হার্টকে কাজে লাগাই তারপর ব্রেইন। ইনফ্যাক্ট মনের টানেই লিখি। তারপর ব্যাপক কাটাকুটি, সম্পাদনা করি। নির্মাণ কৌশল, প্লট নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি। একটা লেখা লিখে তক্ষুনি ছাপানোর জন্য পাঠাই না। সময় নেই, বারবার চিন্তা করি। ঠিকঠাক করি। 

ড. পলাশ বসাক : আপনার বইয়ের চরিত্রগুলোকে কি একজন ইয়ং পাঠক ইমিটেইট করতে পারবে? লেখক হিসেবে আপনার দায়িত্ববোধের জায়গাটা কেমন?
শাখাওয়াৎ নয়ন : ‘বোহেমিয়ান’ উপন্যাসটি ঠিক উনবিংশ কিংবা বিংশ শতাব্দীর কথাসাহিত্যের ধারায় রচিত উপন্যাস নয়। একটা সময় ছিল, আইডিয়ালিস্টিক ফিলোসফি মেনে সাহিত্য লেখা হতো। সেই সময় উপন্যাসের নায়ক-নায়িকারা সুবোধ সম্পন্ন, আদর্শিক চরিত্র ছিল। একথা সত্যি, একটা বই পড়ার সময় নায়ক-নায়িকার চরিত্রের মধ্যে আমরা নিজেকে প্রতিস্থাপন করতে পছন্দ করি। অনেকেই উপন্যাসের চরিত্র দেবদাস কিংবা হিমু হওয়ার চেষ্টা করে।
কিন্তু এই পোস্টমর্ডানিজমের যুগে একটা অপরাধী চরিত্রও উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হতে পারে। একজন সেক্স ওয়ার্কারও সিনেমার প্রধান চরিত্র হয়। ‘বোহেমিয়ান’ উপন্যাসেও ম্যাচিওর্ড কন্টেন্ট আছে, যা প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য উপযোগী। আমার কাছে মনে হয়, এই উত্তরাধুনিকতার দরকার আছে। নায়ক-নায়িকার কোনো দোষ কিংবা খারাপ দিক থাকবে না, এটা বাস্তবসম্মত নয়। ফুলে কাঁটা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ‘বোহেমিয়ান’ উপন্যাসে ছয়টি চরিত্র আছে, যারা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী; তাঁদের মধ্য কমবেশি ভালো এবং মন্দ দিক আছে। অন্যভাবে যদি আপনাকেই জিজ্ঞেস করি, ‘ভালো-মন্দ কাকে বলে? ভালো-মন্দের কি কোনো স্বতঃসিদ্ধ সংজ্ঞা আছে?’ আমার আপনার কাছে যা নেতিবাচক আরেকজনের কাছে তা ইতিবাচকও হতে পারে। সম্পূর্ণ আপেক্ষিক ব্যাপার। সুতরাং, আমার লেখায় যে চরিত্র যেমন কিংবা জীবন যেখানে যেমন; তেমনভাবেই উপস্থাপন করেছি। জোর করে কোনো চরিত্রকে নিষ্পাপ কিংবা রোল মডেল বানাতে চাইনি।

শুভজিৎ ভৌমিক : সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পাঠকরা যেভাবে কবি-লেখকদের সাথে যোগাযোগ করেন; মতামত জানান; তাতে কি কোনোভাবে আপনি প্রভাবিত হন? মানে লেখকের লেখার ধরন কিংবা প্লট নির্বাচনে পরিবর্তন আসে?
শাখাওয়াৎ নয়ন : পৃথিবীতে মোট ১১৮টি মৌলিক পদার্থ আছে। মৌলিক পদার্থ ভাঙলেও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একটুও পরিবর্তিত হয় না, একই থাকে। কবি-লেখকরা মৌলিক পদার্থ। তারা অন্যকে দ্রবীভূত করেন, নিজেরা খুব একটা হন না। যিনি হন তিনি লেখক না। 

সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক সরকার কবির উদ্দিন, আরিফুর রহমান, ইসহাক হাফিজ, শাহানা চৌধুরী, কবি এবং জাদুকর এম এ জলিল, কবি সঞ্জয় চক্রবর্তী, শিশুসাহিত্যিক এবং কলামিস্ট অনীলা পারভীন, সাংবাদিক মিজানুর রহমান সুমন এবং নাঈম আবদুল্লাহ, সাংস্কৃতিক কর্মী মুনা মোস্তফা, ডা. ইকবাল হোসেন, আবিদা রুচি, ফরিদা ইয়াসমিন, এলিজা আজাদ টুম্পা প্রমুখ। এছাড়া এ বি স্ট্রিট লাইব্রেরির কামাল পাশা, আশিকুর রহমান আ্যশসহ সংশ্লিষ্ট সকলে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছেন।