সময়কে আমি ধারণ করতে চাই : আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির

nonameআব্দুল্লাহ আল মুক্তাদিরের জন্ম সিরাজগঞ্জে, ১৯৯০ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করে এখন শিক্ষকতা করছেন ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। ২০১৬ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্য গাঙের গান, সমুদ্রসমান’।

দ্বিতীয় দশকের কয়েকজন কবির কাব্য-ভাবনা ও লেখালেখি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন সাহিত্যের এই আয়োজন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একই সময়ের কবি রাসেল রায়হান।


প্রশ্ন : আপনি ইংরেজি সাহিত্য পড়ান। আপনার সাথে বরং কবিতার আন্তর্জাতিকতা বিষয়টি নিয়ে শুরু করি। এটাকে কীভাবে দেখেন?

উত্তর : এখনকার যুগে আন্তর্জাতিকতাকে এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আমি যেহেতু ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম আমার জন্য আরও কঠিন। বিষয় ও আঙ্গিকের দিক থেকে বাংলা কবিতায় আন্তর্জাতিকতা বোধের যাত্রা মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরেই। তবে মানুষের চেতনার সাধারণ বিশ্ববোধ কিন্তু সাহিত্যে সবসময়েই ছিল, থাকাটাই স্বাভাবিক। আর ভাষার দিকে থেকে যদি বলেন, ইংরেজিকে অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই। এর মাধ্যমেই বিশ্ব-মানুষের ভাষিক যোগাযোগ গড়ে উঠছে। আমি প্রধানত বাংলায় লিখলেও আমার ইংরেজিতে গল্প কবিতা লিখতে কিন্তু ভালোই লাগে।

এক দেশের পাঠক আরেক দেশের কবিতা পড়ুক এইটা আমি সবসময়ই চাই। ভালো অনুবাদে আমাদের কবিদের কবিতা বিভিন্ন দেশের পাঠকের কাছে পৌঁছানো উচিত বলে আমি মনে করি।

প্রশ্ন : একজন কবির নিজের মাটির কথা বলা কতটা বাধ্যতামূলক? কবিতা কখন নিজের সীমারেখা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক হয়ে ওঠে?

উত্তর : ‘বাধ্যতামূলক’ বলে কোনো কিছু সৃজনশীল কাজে থাকে না। কার কবিতায় কী থাকবে সেটা চেতনে বা অবচেতনে কবি নিজেই ঠিক করবে। বৈশ্বিক হয়ে ওঠারও তেমনি কোনো পরিমাপ, পরিকল্পনা নাই। একেবারে ব্যক্তিগত কথাও বৈশ্বিক হয়ে উঠতে পারে। উই ক্যান নেভার প্রেডিক্ট।

প্রশ্ন : ‘অন্য গাঙের গান, সমুদ্রসমান’ তো দুই বছর হয়ে গেল প্রায়। নেক্সট প্ল্যান কী?

উত্তর : কবিতার বই আসতে দেরি হবে। তবে কবিতার ভাব আর ভাষায় বেশ কিছু গল্প লিখেছি; যাকে ইংরেজিতে ‘পোয়েটিক ফিকশন’ বলে। সেই গল্পগুলো নিয়ে বই করার পরিকল্পনা আছে শীঘ্রই।

এছাড়াও ‘গডেস অভ্ অ্যামনেশিয়া’ নামে একট দীর্ঘ লেখা শুরু করেছি সম্প্রতি। একটা সম্মিলিত স্মৃতিকথার মতন লেখা। ফিকশনের আদলে হিস্ট্রি আর ফ্যাক্টস থাকবে। ‘ই-প্রকাশ’ নামের একটা অনলাইন ম্যাগাজিন ধারাবাহিকভাবে ছাপছে লেখাটি। পরে একসময় বই আকারে প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে।

প্রশ্ন : আপনার বইগুলো কতটা ব্যক্তি আপনাকে রিপ্রেজেন্ট করছে?

উত্তর : অনেকখানিই করছে। আমি তা বুঝতে পারি। কিন্তু পাঠক আমার কবিতায় আমাকে খুঁজতে গেলে বিভ্রান্ত হবেন। আবার নাও হতে পারেন। আর বই পড়ার সময় লেখককে ভেবে পড়ার দরকারও নাই।

প্রশ্ন : প্রথম বইয়ে আপনার কবিতার ভাষা কিছুটা আলাদা অন্যদের চেয়ে। কিছুটা সেই পুরনো সময়ের ক্ল্যাসিক ঘরানার ভাষা। ওটা কি নিরীক্ষার স্বার্থেই, নাকি আপনি ওভাবে বলতেই পছন্দ করেন?

উত্তর : বইটিতে দুই ধরনের কবিতা আছে। কিছু আছে নিরীক্ষাধর্মী : ভাষা ও ফর্ম ভেঙে লেখা। তবে বেশির ভাগ কবিতাই স্বতঃস্ফূর্ত। ভাষার ভিন্নতাও এসেছে সাবলীলভাবেই। ওভাবে লিখতেই ভালো লেগেছে। তবে ভাষাটা কিন্তু ঠিক পুরনো ঘরানার না। বা হলেও ক্ষতি নাই। পুরনো, নতুন, দেখা, অদেখা সব ধরনের সময়কে আমি নিজের মধ্যে ধারণ করতে চাই। নিজেকে কেবল একটা নির্দিষ্ট সময়ে বন্দি মানুষ ভাবতে ভালো লাগে না।

প্রশ্ন : আপনি নিজের কবিতার ক্ষেত্রে ক্ল্যাসিক বিষয়টিকে আনতে চাননি?

উত্তর : ওই অর্থে আমি আনতে চাইনি। কিন্তু এসে গেছে। ক্ল্যাসিক কবিতা পড়ার প্রভাবে এমনটা হয়েছে।

প্রশ্ন : বাংলা কবিতায় আপনার কবিতা কী স্বাতন্ত্র্য নিয়ে এসেছে, বলতে পারবেন? ঠিক কিসের তাগিদে লিখছেন?

উত্তর : নিজের ব্যাপারে ঠিক মূল্যায়ন তো আমি করতে পারব না। আমার কবিতাগুলো অনেকের মতে সেকেলে রোমান্টিক ইমেজে ভরা। আবার অনেকে মনে করছে নতুনত্ব আছে। এক সম্পাদক যেমন একদিন বলছিলেন, এই সময় যারা লিখছে তারা একটা সমকালীন সুর, স্বর, ভাষা, আবেগ বজায় রাখছে কবিতায়। আমার কবিতায় নাকি সেটা নাই। ঠিক সমকালীনও না, ভবিষ্যতেরও না, আবার পুরোপুরি অতীতেরও না। এইটা হতে পারে একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।

প্রশ্ন : অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের সাথে কবিতার পার্থক্যটা কোথায়?

উত্তর : এখন আসলে ওইভাবে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমার মনে হয় দরকারও নাই। সব শিল্পমাধ্যমেরই তো তারল্য বাড়ছে। এক মাধ্যম আরেক মাধ্যমের সাথে মিলে অভিনবত্ব পাচ্ছে, বিচিত্র হচ্ছে। এইখানে প্রসেসটা উইন-উইন। পার্থক্য খুঁজতে গেলেই বরং বেঁধে ফেলা হয়।

তবে সাবলীলভাবে স্বাতন্ত্র্য আনতে পারলে বা বজায় রাখতে পারলে সেটাও প্রশংসার দাবি রাখে।

প্রশ্ন : আচ্ছা, কবিতা লেখার ক্ষেত্রে নিজের জগৎ নির্মাণের বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

উত্তর : নিজের একটা জগৎ তো সব মানুষেরই থাকে। আমার মনে হয়, কবিতা লেখার জন্যে জরুরি হল নিজের ধরন নির্মাণ। একাকীত্ব বা প্রেম, দ্বিধা বা সাহস, স্মৃতি বা ঘুমহীনতার কথা কীভাবে নিজের ঢঙে বলা যায় সেটাই মনে হয় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জটা আমি গুরুত্ব সহকারে নিয়েছি শুরু থেকেই। এখনও চেষ্টা চলছে নিজের একটা আলাদা স্বর বা ধরন খুঁজে পাওয়ার।

প্রশ্ন : আপনার ক্ষেত্রে নিজের জগৎ নির্মাণের পদ্ধতিটা ঠিক কেমন?

উত্তর : পদ্ধতি একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হয়। আমি ওই অর্থে কোনো পদ্ধতিতে আগাইনি। তবে হ্যাঁ, একটা সময় বুঝতে পারলাম, আমার কথা বলার একটা সাবলীল ঢং আছে (অধিকাংশ মানুষেরই হয়তো থাকে)। লেখার ক্ষেত্রে আমি নিজের ওই স্টাইলটা ফলো করি বেশির ভাগ সময়, করতে ভালো লাগে।

প্রশ্ন : আরেকটা বিষয়, কবিতার পাঠক কম- এরকম একটা অভিযোগ আছে। এর কি কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে করেন?

উত্তর : এখন তো সবকিছুরই পাঠক কম। আনুপাতিক হারে কবিতারও কমেছে বা কমছে।  আরেকটা কারণ হলো, আমাদের এখানকার প্রকাশনা শিল্প সবচেয়ে দুর্বল তাদের প্রচারণায়। বিশেষ করে নতুন ধরনের লেখা বা নতুন কবির প্রচার-প্রকাশ একদমই কম হয় বা স্ব-উদ্যোগে করতে হয়। অনেকেই আত্ম-প্রচারণায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না- এটাই স্বাভাবিক।

প্রশ্ন : উত্তরণ সম্ভব কিনা? কীভাবে?

উত্তর : উত্তরণের উপায় নিশ্চয়ই আছে। কবিতা পড়ার অভ্যাসকে নানান ভাবে, নানান স্তরে উৎসাহিত করতে হবে। উল্লেখযোগ্য নতুন কবিতা বা কবির প্রচারণা ব্যাপকভাবে করা, সেটা বাণিজ্যিক ধাঁচেও করা যেতে পারে। দোষের কিছু নাই।

প্রশ্ন : প্রচারণার ক্ষেত্রে পুরস্কারের ভূমিকা কিংবা প্রভাব কেমন হতে পারে?

উত্তর : প্রভাব তো আছেই। পাঠক বাড়ে, লেখার চাহিদা বাড়ে। মানুষ চিনতে শুরু করে। আবার কিছু ক্ষতিও হতে পারে। অতিমূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন দুইই ক্ষতিকর। তাই পুরস্কারের যোগ্য হলে না পাওয়া, আর যোগ্য না হলেও পাওয়া- দুইয়ের প্রভাবই ভয়াবহ।

প্রশ্ন : এই মূল্যায়িত হওয়ার জন্য কিংবা 'লাইনে আসার জন্য' জুনিয়র কবিরা সিনিয়র কবিদের পেছনে ঘোরে, সম্পাদকের পেছনে ঘোরে- এমন অভিযোগ আছে। এই অভিযোগ কতটা সত্যি? সত্যি হলে, এই প্রক্রিয়ায় কতটা জাতে ওঠা যায়?

উত্তর : অভিযোগটা, আমার বিশ্বাস, সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়। আবার আমার নিজের দেখা কিছু ‘জুনিয়র’ কবি এমনটা করছে, এটাও সত্য। এখন ‘জাতে ওঠা’র ব্যাপারটা আসলে অনেক জটিল। নির্দিষ্ট একটা পদ্ধতি অবলম্বন করে সেটা অসম্ভব।

আবার এটাও তো মানতে হবে সবাই নিশ্চয়ই একটা কমন উদ্দেশ্য নিয়ে লিখবে না। ‘সার্থক’ বা ‘সফল’ কবি হয়ে ওঠার সংজ্ঞাও তেমনি একেক জনের কাছে একেক রকম। ‘জাতে ওঠা’ বলতে বোধহয় আপনি বোধ হয় ‘সফল হওয়া’ বোঝাতে চেয়েছেন।

প্রশ্ন : সফল হওয়া, কিংবা ধরুন অন্যদের কাছে ভালো কবি হিসেবে একটা পরিচিতি পাওয়া। আচ্ছা, বিভিন্ন দৈনিকে, অনলাইন নিউজ পোর্টালেও সাহিত্যবিভাগ থাকে।এই বিভাগটি সাহিত্যের কতটুকু উপকার করছে?

উত্তর : উপকার তো করছেই। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। আপনি আমাকে বা আমি আপনাকে হয়তো সেই কারণেই চিনি।

কিন্তু সমস্যা হল আমাদের এখানকার বেশিরভাগ সাহিত্য-পাতার ধরন, রূপ বা রুচি একই রকমের। ব্যাপারটা একটু একঘেয়েও। মানের ব্যাপারেও অনেক সময় প্রশ্ন তোলা যায়। লেখা বাছাইয়ের পদ্ধতিতেও, আমি যদ্দুর জানি, দুই একটা পত্রিকা বাদ দিলে, তেমন সততা নাই।

প্রশ্ন : একদিকে লিটলম্যাগ ম্রিয়মাণ, অন্যদিকে দৈনিকগুলোর উত্থান, এই দুইয়ের সুবাদে সাহিত্য একটি কর্পোরেট শ্রেণির কাছে বাঁধা পড়ছে কিনা?

উত্তর : লিটলম্যাগের সাথে দৈনিকের অনেক অনেক পার্থক্য। এতো বেশি পার্থক্য নিয়ে আসলে প্রতিযোগিতা হয় না।

আর আমার মনে হয়, দৈনিক পত্রিকাগুলো মোটামুটি আগের জায়গাতেই আছে। আগেও তাদের সাহিত্য-পাতার কমবেশি কদর ছিল, এখনও আছে। সমস্যা হল পত্রিকাগুলোর কর্পোরেট হয়ে যাওয়া। কর্পোরেট পলিটিক্স অনেক জটিল এবং শক্ত। সেই পলিটিক্স অনেক কিছুর মতো সাহিত্যকেও ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে।

প্রশ্ন : দুই বাংলার কবিতা নিয়ে আপনার ভাবনা কী? দুই বাংলার কবিতায় মিল অমিল কী?

উত্তর : আসলে পশ্চিম বাংলার সাম্প্রতিক কবিতাগুলো আমার অনেক কম পড়া। তাই ওইভাবে ওভারঅল মন্তব্য করা আমার উচিত হবে না। তবে আমার বিশ্বাস পার্থক্যের চেয়ে মিল অনেক বেশি। ‌এবং সত্যিই হয়ে থাকলে, তা অনেকটা হতাশাজনক। আজকাল সারা পৃথিবীতেই সাংস্কৃতিক আর সাহিত্যিক বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে দুঃখজনকভাবে।

ধন্যবাদ মুক্তাদির।

আপনাকেও ধন্যবাদ, রাসেল।


আরো পড়ুন-

কবিতায় আড়াল আমার পছন্দ : হাসনাত শোয়েব

অলঙ্করণ : নরোত্তমা