মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সাক্ষাৎকার

nonameমনোরঞ্জন ব্যাপারীর জন্ম বরিশালে। দেশভাগের পর পরিবারসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। জীবনের বিভিন্ন সময়ে অর্থের প্রয়োজনে বিভিন্ন রকমের কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কলকাতার মুকুন্দপুরে একটি বধির স্কুলে রান্নার কাজ করেছেন, চালিয়েছেন রিকশাও, কিন্তু সেসব টানাপোড়েন অতিক্রম করে সাম্প্রতিককালের বাংলার দলিত জীবনের অন্যতম কাহিনিকার তিনি।

পর্ব এক

মুশফিকুর রহমান : দাদা আপনার লেখালেখির শুরুটা কবে থেকে?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : একাশি সাল থেকে।

মুশফিকুর রহমান : তারপর?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : এই রে আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে…!

মুশফিকুর রহমান : হ্যাঁ দাদা, আমরা শুনতে চাই, প্রথম থেকেই।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : তুমি আবার পুরোনো গল্পটা বলাবে। আমি আর কতবার একই গল্প বলবো!

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : আমি রিকশা চালক ছিলাম। প্রচণ্ড বই পড়তাম। আমি জেলখানায় লেখাপড়া শিখেছি, তোমাদের মতো বয়সে [মুশফিক অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র—সম্পাদক] জেলে গিয়েছিলাম। জেলে গিয়ে লেখাপড়া শিখি। তার আগে কিছুই জানতাম না।

মুশফিকুর রহমান : জেলে যাওয়ার গল্পটা কী?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : রাজনীতি করতাম, নকশাল ছিলাম।

মুশফিকুর রহমান : আহা, সে তো কবির সুমন থেকে আরো অনেকেই ছিলেন।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : কবির সুমন আমার বন্ধু। তারে জিজ্ঞাসা করো মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে চেনেন কি না? আমার বন্ধুলোক।

মুশফিকুর রহমান : আচ্ছা আচ্ছা।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : জেলে বসে লেখাপড়া শিখি। নিরক্ষর হয়ে ঢুকেছিলাম স্বাক্ষর হয়ে বের হই। রিকশা চালাতাম। আমার রিকশায় একদিন একজন উঠেছিলেন, আমি একটা শব্দের মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না, জিজ্ঞেস করি ওনাকে, উনি চমকে গেলেন। আমাকে বললেন, আমার পত্রিকায় তোমার মতো লোকেরা লেখে, তুমি লিখবে? আমি তার আগে বললাম, কী নিয়ে লিখবো? ব্যাপারটা সহজ হলে চেষ্টা করে দেখব। তিনি আমার হাতে একটা চিরকুট দিলেন। আমিও চমকে গেলাম, কারণ একটু আগে ওনারই বই পড়ছিলাম। তারপর ওনার পত্রিকায় লিখলাম, সেটা পাঠক সমাজে সমাদৃত হলো, যুগান্তর কাগজে একটা রিভিউ বের হলো। এইটা কোনোদিন স্কুলে না যাওয়া এক লোক লিখেছে এটা কোনোদিন হইতেই পারে না।

মুশফিকুর রহমান : আচ্ছা, তবে আপনি লেখালেখির আগে রিকশা চালাতেন?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : জীবনে অনেক কাজই করেছি। রিকশা চালাতাম, চায়ের দোকানে কাজ করতাম, গরু-ছাগল চড়িয়েছি, ডোম ছিলাম, দিনমজুরি করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি, আরো নানা কাজ করেছি।

মুশফিকুর রহমান : তার মানে আপনার জীবন-নদী বহু জল ঘোলা করেছে?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : হ্যাঁ, তারপর লেখা শুরু করলাম। বহু সম্মান-পুরস্কার পেলাম। লিখতে লিখতে, লিখতে লিখতে বাংলা আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছি, সর্বভারতীয় পুরস্কার, এ পি জি পুরস্কার তালিকায় আমার বই শর্ট লিস্টে ছিল। আরেকটা পুরস্কারের তালিকায় আছে।

মুশফিকুর রহমান : আপনি যে লেখালেখি করছেন এটা কি আপনার নিজের জন্যই শুধু, নাকি মানুষের জন্য?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : নিজের জন্য কী? আমি নিজে পড়ার জন্য কি লিখি?

মুশফিকুর রহমান : আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম, পাঠক যা পড়তে চায় আপনি কি ঐদিকেই যাচ্ছেন কি না, বা ওই বিষয়েই লিখেছেন কতটুকু?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : একদম মোটেই চাচ্ছি না, আমি লিখছি আমার পাঠককে আমার ভাবনায় ভাবিত করার জন্য। পাঠকের মন-পছন্দ নিয়ে আমার কোনো লেখা নেই। আমার একটাও মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের গল্প নেই। সবকটা গল্পের মধ্যে আমার ক্ষুধা, যন্ত্রণা, বঞ্চনা, হিংস্রতা, প্রতিশোধ, প্রতিরোধ…মিষ্টতা একদম নেই। কিন্তু তারপরও পাঠিকারাই আমার সংখ্যায় বেশি।

মুশফিকুর রহমান : তারমানে পাঠিকা সমাজে আপনি বেশি সমাদৃত?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : একদম তাই। এটা যারা আমার ফেসবুক ফলোয়ার তারা জানে (মজা করে)।

মুশফিকুর রহমান : এই আকর্ষণের কারণ কী বলে করেন?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : কারণটা হচ্ছে যে, আমার যে বয়স এই বয়েসে আমরা খালি প্রেমই করতে পারি আর কিছু করতে পারি না।

মুশফিকুর রহমান : আচ্ছা আচ্ছা। বেয়াদবি না নিলে এবং অভয় দিলে এবার সঙ্গত কারণেই আপনার বয়স জানতে চাইব।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : আমার বয়স জানতে চাও! একদম সত্যি?

মুশফিকুর রহমান : আলবৎ, হ্যাঁ মশাই।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : তাহলে ওর পেছনে একটা গল্প আছে। গল্প হচ্ছে গিয়ে, ৭৭ সাল যখন তখন আমার বয়স হচ্ছে সাতাশ।

মুশফিকুর রহমান : ৭৭ সালে বয়স সাতাশ…

মনোরঞ্জন ব্যাপারী :  তো ৭৭ সালে বয়স যখন সাতাশ তখন আমি একদিন হঠাৎ ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখলাম, আরে এতগুলো দিন পার হয়ে গেলো চাঁদ দেখিনি, সূর্য দেখিনি…ও না, সূর্য দেখেছি, জোছনা দেখিনি, সমুদ্র দেখিনি, পাহাড় দেখিনি, পাখির গান শুনিনি।

মুশফিকুর রহমান : আচ্ছা বেশ, তবে সাতাশ বছর জীবনে আপনি পাখির গানও শুনলেন না!

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : কিচ্ছু না, মানে কোথায় দিয়ে দিনগুলো সব চলে গেলো।

মুশফিকুর রহমান : ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না’…

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : হ্যাঁ, ঠিক তাই, আরে যায় তো সময়, তখনি কষে একটা ব্রেক মারলাম। বললাম, আজ থেকে আমার মাস হবে ৩৬৫ দিনে।

মুশফিকুর রহমান : এর পেছনে কী যুক্তি দাঁড়াল বয়সে লাগাম দেবার?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : হ্যাঁ, ঠিক তাই আর আমার বয়সটাও আর বড়লো না। আমি এখন ৩২-৩৩-এ আটকে আছি!

মুশফিকুর রহমান : ও আচ্ছা আচ্ছা…তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন ৩২-৩৩ বছর প্রেমের জন্যে ভালো সময়?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : সেতো আমি ভাবলে হবে না। প্রেম তো আমি একা একা করতে পারব না। এই যে সারাদিন এই খেপির [গাইড—সম্পাদক] সাথে ঘুরলাম, ও কি একটাবারও প্রেমের কথা সুন্দর করে বলল! কিছুই বলেনি! একদম বলেনি! বলো আমি কী করব!

মুশফিকুর রহমান : তাহলে কি দাদু বা কাকার পর্যায়ে ফেলে দিয়েছে?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : ওই জ্যাঠা-ফ্যাটা বলা শুরু করে দিলো। আমি ধমক দেই। দাদু মোটেও বলে না। তবে মেলা কমিটিকে ধন্যবাদ জানাবো একটা সুন্দর গাইড দিয়েছে আমাকে।

মুশফিকুর রহমান : আপনি খুবই লাকি। আপনি কি আপনার গাইডকেও লাকি বলতে চাইবেন?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : মনে হচ্ছে না।

মুশফিকুর রহমান : তাহলে আপনি এখনো একটা প্রেম চালাবার প্রচেষ্টায় আছেন তাহলে…

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : আর আমার প্রেম চালাবার কী দরকার, এমনিতেই ফেসবুকে আমার দেড় হাজার খেপি আছে।

মুশফিকুর রহমান : দেড় হাজার! অনেক। আপনি তো নির্মলেন্দু গুণের নাম শুনেছেন, তারও নাকি ৩৯ টা গার্লফ্রেন্ড বিভিন্ন দেশে আছে।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : আমার তো গার্লফ্রেন্ড না, এগুলো খেপি। পাগলী! সবাই ঘিরে ধরে সবজায়গায়। ছেলেরা নাই। সংখ্যায় কম।

মুশফিকুর রহমান : মানে ছেলেরা আপনার সাহিত্য বিমুখ।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : না ফটো তুলতে তেমন আগ্রহী বা আনন্দিত হয় না, সাহিত্যে নয়। খালি তুমি দেখে যাও।

মুশফিকুর রহমান : যাক আমি তবে এক ভদ্রলোক যে আপনার সঙ্গে আনন্দ করে ছবি তুললাম।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : না বাংলাদেশে বহু ভদ্রলোকেরা এসেছেন তবে খেপিরাই কিন্তু আমার মূল ভক্ত। তবে দুঃখের বিষয়, আমি আজ পর্যন্ত একটা প্রেমের গল্প লিখিনি। আমি এখন কী করতে পারি, কোনো উপায় আছে।

মুশফিকুর রহমান : বেশ বুঝেছি, খুব কঠিন পরিস্থিতি আপনার। আমি বরং আপনাকে বয়সের লাগাম কষে রাখারই পরামর্শই দেব।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : যাক ভাই, আমার কোনো প্রেমের গল্প নাই। আমার সব রগচটা গল্প মারামারি কাটাকাটির গল্প।

মুশফিকুর রহমান : আচ্ছা দাদা, আপনি আপনার সাহিত্যে যা বলতে বা লিখতে চেয়েছেন, তা কি আপনি পুরোপুরি বলতে পেরেছেন?

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : পুরোপুরি বলতে তো পারা যায় না। অনেক রকম বাধ্যবাধকতা থাকে।

মুশফিকুর রহমান : যেমন...

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : আমি তো একটা গল্প বা উপন্যাস লিখি। আমাকে তো শিল্পির যে কতগুলো বাধ্যবাধকতা থাকে তার মধ্যে থেকেই কাজ করতে হয়। আমি তো গণ-আন্দোলনকারী বা রাজনীতিক কর্মী নই বা রাজনৈতিক আন্দোলন করছি না, ফলে আমার বক্তব্যটাকে নান্দনিক সৌন্দর্যমণ্ডিত করে মানুষের সামনে আনতে হয়। মানুষ যেটা বুঝে নেওয়ার বুঝে নেবে, খোলাখুলি আমার পক্ষে সবকিছু বলা তো সম্ভব নয়। আমার যেই বইটা নিয়ে এখন ভারত বলো, বাংলাদেশ বলো বা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সেটা যেখানে হোক আমার বই ‘বাতাসে বারুদের গন্ধ’ যেটা নিয়ে হইচই হচ্ছে, সেটা তো নকশাল আন্দোলনে কিছু নকশাল রাজবন্দিরা জেল ভেঙেছিলো, তার কথা রয়েছে ওখানে। তাতে কোনো করুণ-রস নেই, বীভৎস-রস আছে। এখন, এখানে আমার কাজ হচ্ছে দলিলিকরণ, সময়টাকে লিপিবদ্ধ করা। সেই যে সেই ভয়ঙ্কর ইমার্জেন্সির কাল ছিল, কী সাংঘাতিক জটিলতা ছিল! সেই কালে ভারতে তোমার মতো যুবক ছেলেরা রাস্তায় দাঁড়াতে পারেনি। দেখলেই গুলি মেরে দিতো নয়ত জেলখানায় নিয়ে যেত।

মুশফিকুর রহমান : মানে জঙ্গলের আইন চলে তখন।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : হ্যাঁ। আমি সেই সময়ের মধ্যে দিয়ে মানুষ, সেই সময় থেকে বেঁচে আছি। সেই সময় আমি ওই মানুষগুলোকে দেখেছি বন্দুকের সামনে, তারা কী করে বুক টান করে দাঁড়িয়ে গুলি খেয়েছে মারা গেছে, তাদের কথা আমি লিপিবদ্ধ করেছি।

মুশফিকুর রহমান : মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, একজন লেখক বা সাহিত্যিকের মূল কাজটা হলো সময়টাকে ফ্রেমে বাঁধানো।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী : না। বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন ভাবনা থেকে লেখে। সবাই আমার ভাবনায় ভাবিত হবে, তা নয়। আমি মনে করেছি যে, সেই সময়টা ধরে রাখা প্রয়োজন। হ্যাঁ, তুমি আজকের সময়ের সঙ্গে সেদিনের সময়টা মিলিয়ে দেখো। যদি মনে করো কিছু পরিবর্তিত হয়েছে, তাহলে তো ঠিক আছে। যদি মনে করো তার থেকে খারাপ হয়েছে তাহলে আগামী দিনের সমাজটা কেমন হবে…

তখনকার দিনে আমার মনে হয়েছিলো, এই সমাজটা আমার মতো মানুষদের বসবাসের যোগ্য নয়, এই সমাজটাকে পরিবর্তন করতে হবে, এই সমাজটাকে শিশুর বাসযোগ্য করে যেতে হবে। চলবে


 

(সাক্ষাৎকারটি ঢাকায় অনুষ্ঠিত Dhaka Lit Fest 2019-এর ২য় দিন গ্রহণ করা হয়েছে।)