সাহিত্য মহৎ মনোচিকিৎসক : ওলগা তোকারচুক

প্রশ্ন: সাহিত্যিক জীবনের আগে আপনি মনোবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছিলেন। মনোবিজ্ঞানের প্রতি আপনার আগ্রহের কারণ কী?

উত্তর: সাহিত্য থেকে মনোবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল। অজস্র বই, আরো বিশেষ ভাবে বললে অনেক অনেক উপন্যাস পাঠ—আমাদের বিপুল মানসিক জগৎ, পৃথিবীর বিচিত্র ক্রিয়াকলাপ, বেদনা এবং বিচ্ছিন্নতার অনুভূতির দিকে আমার চোখ খুলে দিয়েছে।
সিগমন্ড ফ্রয়েডের লেখা 'বিয়ন্ড দ্য প্লেজার প্রিন্সিপল' বইটি আমি এই লিস্টে রাখতে চাই। বইটি আমাকে মনোবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বইটি পড়েছিলাম। সেখানে মনোবিদ্যাকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তখন বুঝতে পারি, সংস্কৃতি হলো যেকোনো কিছু ব্যাখ্যা করার শিল্প এবং মনোবিশ্লেষণ ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে বইটা অনন্য। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বইটি আমাদের বিভিন্ন দিক থেকে ভাবতে উৎসাহী করে।
আমি স্বীকার করছি—মানুষের সঙ্গে কাজ করার চাইতে মনোবিজ্ঞানের তত্ত্বের প্রতি আমার আগ্রহ বেশি ছিল।

প্রশ্ন : পোল্যান্ডের ইতিহাসের ঐতিহাসিক ও এক বিশৃঙ্খল সময়ে আপনার মনোবিজ্ঞানের পাঠ সম্পন্ন হয়েছিল। তখন সংহতি আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে দেশটির জনমানুষ ধর্মঘটে মগ্ন ছিল। মিলিশিয়া বাহিনী ওয়ারশতে টহল দেবার সময়ই তো লিখেছিলেন যে, উদ্ভূত পরিস্থিতি রোগীদের ওপর কতটা ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে—তা ভালোভাবেই নাকি দেখতে পাচ্ছিলেন। আপনি কি বলতে পারবেন, একটি দেশের স্বাস্থ্যের অবস্থা তার নাগরিকের স্বাস্থ্যের অবস্থার সঙ্গে কতটা গভীরভাবে জড়িত?

উত্তর : অবশ্যই তা একে অপরের সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও আমি মনে করি, সামষ্টিক চরিত্রের মতো কিছু একটা গঠিত হয় মূলত সমাজের অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে আর তা পরিবর্তিত হয় যুদ্ধে জয়-পরাজয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে।
নৈতিক কিংবা ধর্মীয় প্রথাও আমাদের ওপর একটা নির্দিষ্ট চাপ তৈরি করে। আমাদের মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে। জানেন তো, ইতিহাস পাঠে আমি লংগি দুরির গুণমুগ্ধ। তা এমন এক ধারণা যা দীর্ঘমেয়াদি ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে দারুণভাবে বর্ণনা করে। এই পাঠ থেকেই বুঝেছি আসলে কীভাবে ঘটনাগুলো সময়ের চেতনাই নয়, বরং সমষ্টির চেতনাকেও আকার দেয়। যেমন: কীভাবে আমরা একটা সংকটকে মোকাবেলা করি, আমাদের নিজস্ব সমষ্টিগত মূল্যবোধ আছে কিনা, আমাদের নিজস্ব পরিচয়ের ব্যাপারটাই বা কী রকম—এইসব।
আমার বেড়ে ওঠা এবং পরিণত হওয়ার কালে পোল্যান্ড ছিল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে একটি শোচনীয় রাষ্ট্র। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভয় এবং অনিশ্চয়তার মাত্রা ছিল অনেক বেশি। আমি মনে করি, তখন এক ধরনের সামষ্টিক হতাশা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু মানুষ চুপ না থেকে জোর গলায় একে অপরের কাছে সাহায্য চাইতো। হয়ত সংহতির জন্ম হয় এভাবেই। একত্রিত হওয়ার, সম্প্রদায় খোঁজার এবং একে অপরকে সমর্থন জোগানোর এই পদ্ধতিই বিশাল কোনো রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের উৎস হিসেবে কাজ করে। এটা তো এখন প্রমাণিত।

প্রশ্ন: মনোবিজ্ঞানে কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়গুলো শিখেছেন?

উত্তর: জনমানুষের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা। তারা তাদের ব্যক্তিগত ইতিহাসকে কীভাবে ধারণ করে সেটি শোনা। একই বিষয়কে যে অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, তা আমাকে মনোবিজ্ঞানই শিখিয়েছে। কখনও কখনও এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলিকে একই তারে বেঁধে ঐকতান সৃষ্টি করা যায়, কিছু ক্ষেত্রে তা অসম্ভব। অবশ্য এইভাবে দেখতে পারাটা আমার ক্ষেত্রে রত্নপাথরের মতো মূল্যবান বা অভিশাপও হতে পারে। আমি বুঝেছি, বাস্তবতা হলো এমন এক বিষয় যা প্রতিনিয়ত মিলেমিশে যাচ্ছে, সমন্বিত হচ্ছে। আমাদের প্রয়োজনের ভিত্তিতে একে কেটে কুচি কুচিও করা যাচ্ছে, পুনরায় নির্মাণ করাও যাচ্ছে।

প্রশ্ন: আপনার লেখালেখিতে মনোবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহের ছাপ দেখা যায়, যেমন: আপনার উপন্যাস 'ই. ই.'। মনোবিজ্ঞানের প্রতি এই গভীর আগ্রহ আপনার লেখালেখিতে কতটা প্রভাব রেখেছে?

উত্তর: লেখালেখি এবং মনোবিজ্ঞান একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিরোধীপক্ষ নয়—অনেকটা এক রকমের ধারাবাহিকতার মতো। এই দুটি বিষয়ই সম্মিলিতভাবে আমাদের মনের জগতকে খুঁজে বেড়ায় আর বাইরের জগতের ওপর ছায়া ফেলে। এটাই সাহিত্যের নির্যাস, এভাবেই আমি দেখি একে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মনোবিজ্ঞানের পড়াশুনা ছাড়াই অনেক লেখক এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেছেন।

প্রশ্ন : লেখালেখি কি কারো মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারে? যদি পারে, তবে কীভাবে?

উত্তর: আমি মনে করি সাহিত্য হচ্ছে মহৎ মনোচিকিৎসক। সাহিত্য আমাদের চলমান সমস্যাগুলো থেকে বা অতি উত্তেজনা আর চারপাশের গোলমাল থেকেই কেবল বিচ্ছিন্ন করে এমন না, বরং সাহিত্য আমাদের চেতনাকে প্রসারিত করে। প্রতিটি বই পড়ার পর আমরা আরো মহৎ হই। গভীর গভীরতরভাবে। আমরা আরো ভালো বুঝি এবং জীবন জগতকে অনুভব করতে পারি।

সাহিত্য বা আরো নির্দিষ্টভাবে বললে বেশিরভাগ উপন্যাস আমাদের দরদি হতে শেখায়। আমাদের সংবেদনে নাড়া দেয়। আমরা কীভাবে বুঝে উঠি উপন্যাসের মূল চরিত্রগুলোর অনুপ্রেরণা? এখানেই আমাদের কাছে আছে এক সুবর্ণ সুযোগ নিজেদের ভেতর থেকে বের হয়ে কিছু সময়ের জন্য অন্য কেউ হয়ে ওঠার এবং পৃথিবীকে তাদের চোখে দেখার।
এই দুর্লভ অভিজ্ঞতা আমাদের যাপনের ভার থেকে মুক্ত করে খুবই নিরাপদ উপায়ে। আমি বোধ করি মানসিকভাবে পরিণত হওয়ার পথে তরুণ প্রজন্মের জন্য তা হতে পারে ভীষণ মূল্যবান অভিজ্ঞতা।
এছাড়াও সাহিত্য আমাদের সমৃদ্ধ করে এমন সব বিষয় দেখিয়ে, এমন সব সময় এবং স্থানের বর্ণনা দিয়ে, যা আমরা কখনও বাস্তবে আস্বাদ করে উঠতে পারতাম না। সুতরাং, সাহিত্য সৃষ্টি করে এক ধরনের সূক্ষ্ম মনোবৈজ্ঞানিক গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী ভাষা, সংস্কৃতি, নির্দিষ্ট দেশের পাসপোর্ট পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া সাহিত্য নানান চিন্তার এমন এক কার্যকর অভিমুখ যেটা কোনো মহৎ মানুষকেও ঈর্ষান্বিত করতে পারে।

প্রশ্ন: 'স্বাস্থ্য' শব্দটি সম্ভবত বিভিন্ন মানুষের কাছে বিভিন্ন রকম। 'স্বাস্থ্য' শব্দটি আপনার কাছে কী অর্থ নিয়ে হাজির হয়?

উত্তর: স্বাস্থ্য বলতে আমি বুঝি—আমাদের ভেতর ও বাইরের জগতের এমন এক হারমোনি যা এই পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের মিশতে উদার করে। সুস্বাস্থ্য এই পৃথিবীর পরিবেশের বাস্তবতার সঙ্গে এবং চারপাশের জীবন্ত প্রাণীদের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিকভাবে আশ্লেষে মেশার আকাঙ্ক্ষা জোগায়। আধ্যাত্মিক ভাবে দেখতে গেলে, স্বাস্থ্যের অর্থ হলো যেকোনো দুঃখের বিনিময়ে হলেও নিজের চেতনাকে সুদূরে বিস্তৃত করা।
তবে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে সম্পর্কিত করে আমাদের বোঝা উচিত। কেননা তা কোনো আলাদা একক অবস্থা না। বরং বিনিময়, দান এবং গ্রহণের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেবার ক্ষমতা হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্যকে দেখা উচিত।

'স্বাস্থ্যের ভবিষ্যৎ' বিষয়ক নোবেল সপ্তাহ সংলাপের অংশ হিসেবে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেছে নোবেল ফাউন্ডেশন।