তুষার কবিরের

‘হাওয়াহরিৎ গান’ থেকে

noname
কিন্নরী


আবারও বুকঝিম্ বৃষ্টি!
বন্দরের থেমে থাকা জাহাজগুলোর পর
ঝরে যাচ্ছে একটানা ঘুমঘোর জলের কিন্নরী!
মাস্তুলের হাওয়ায়
উড়ে যাচ্ছে চারিদিকে জলমগ্ন সুরের লহরী!

বহুকাল বৃষ্টির অপেক্ষা করে
যে প্রমোদতরীটি থেমে ছিল
দিকশূন্য প্রাচীন নোঙরে—মর্চে পড়া ডকইয়ার্ডে—
লহমায় বৃষ্টির ফোঁটায় সেও জেগে ওঠে
গহন সুদূর অতলান্তে—
মহাস্রোতে ভাসতে ভাসতে বাঁক ফেরে
ঘুমদ্রাঘিমায়—ঠান্ডা জলস্রোতে—  
চকমকি বালুচরে—  
তরঙ্গের মুদ্রাবিভঙ্গের মোহে
সমুদ্রের জলরাশি ঘিরে কে যেন বাজিয়ে যায় শুধু
সান্ধ্যস্বরে সুরের ভৈরবী!

আর অই দূরে—সমুদ্রের তীর ছেড়ে—বাতিঘর পার হয়ে
পাথুরে ডেরায় যারা গান গায়
প্রার্থিত বৃষ্টির জন্যে আর শোনে মাস্তুলের গান;
তাদের আস্তিনে দেখি জড়ো হয়
মন্দ্রস্রোত জলের কোরক—সৈকতের তৃণলিপি—
আর দূর গম্বুজের নক্ষত্রস্মারক!

হিমবাক্স

এ শীতে আমাকে ডেকে যাচ্ছে শুধু
প্রান্তরের হরিৎ হাওয়া
বিকেলের ধূলিচিত্র
ফেলে দেয়া দূরের কিন্নরী!

আর আমি ধীর পায়ে হেঁটে চলি
শীতলাগা মেথরের মত;

কুয়াশার ক্যারাভান ছেড়ে
এই শীতে আমি হেঁটে চলি
জেগে ওঠা খড়ের গাদায়—
ধূসরিম নদীর কিনারে!

দেখি কোনো এক শীতপিয়নের হিমবাক্সে
নৈঃশব্দ্যের ধূলিখামে
ছোট ছোট প্রেমের হরফে
কে যেন লিখছে শুধু
অসমাপ্ত শীতসমাচার!

দ্যাখো প্রান্তরের কুয়াশারা এখন মুদ্রিত;
বিষণ্ন ছাপাখানায়
লণ্ঠনের নীলাভ রেখায়—
শীতগ্রস্ত কবিগৃহে!

সমুদ্র সংগীত

সমুদ্রও মাঝে মাঝে গেয়ে ওঠে তার রাতচেরা সেরেনাদ—মাঝরাতে আরো শোনা যায় তার মার্মেইড স্বরে কান্না—দূর তাঁবু ও বাতিঘর থেকে উঠে আসে রিনরিনে সাইরেন—মাস্তুলের হাওয়ায় ভেসে আসে নৈঃশব্দ্যের ঘুমঘোর বীণা!

ঝিনুকের বুকঝিম্ ঘুম আর প্রবালের দুঃখগাথা নিয়ে সমুদ্রও মাঝে মাঝে বলে ওঠে জলনূপুরের জমানো কিন্নরী—ফুঁসে ওঠা স্রোতকান্না—আর সূর্যাস্তের সান্ধ্য মাধুকরী!

লণ্ঠনের নীলাভ আলোয় সমুদ্রের বুক থেকে উঠে আসে সরাইখানার গান, ঘুমকুঠুরির স্বর আর ময়ূরীর ভগ্ন মনোলগ!

সমুদ্রের তীর ঘেঁষে দ্যাখো আমি শুনে নিই যত জলের পয়ার—মাস্তুলের হাওয়ায় কে যেন বাজিয়ে যায় শুধু দূরের সেতার!

ছাতিম বালিকা

ছাতিম বালিকা, তোমাকে রাধার মতো লাগছিল বিকেলের ধূলিচেরা রোদে।

তোমার কুমুদ সুরে—ডাহুকী ও ডাকিনীর স্বরে—দ্যাখো এ শরতে আমি হেঁটে যাচ্ছি কোনো নীল ময়ূরীর পুরনো ডেরায়—অরণ্যের সরুপথে—জেগে ওঠা ঘাসের জঙ্গলে! তার পাখসাটে শুনে যাচ্ছি শুধু বেজে ওঠা ঘুমের কিন্নরী!

সান্ধ্য মাধুকরী, আমি টের পাচ্ছি তোমারই হাওয়াহরিৎ গান—এ শরতে সোনা পুড়ে যাওয়ার ঘ্রাণ ভেসে আসে কোনো সোনারুর পাতার কুটিরে!

মুঠোভরা রঙিন টিকিট হাতে আমাকে ডাকছে দ্যাখো টিনশেড শেফালি অপেরা!

ছাতিম বালিকা, তোমারই ভেজা ভেজা শাড়ির আঁচলে আজো খুঁজে পাই কাশফুলের প্রকাশবিভা, কামিনীর ধূপজ্বলা ঘ্রাণ আর শারদীয়া রাধার তনুকা!

মনোলগ

পাখসাটে শব্দ তুলে যে পাখিটা উড়ে যাচ্ছে
দূর থেকে দূরে—
তার ডানা ছিঁড়ে দ্যাখো পড়ে যায় যত পুরাণ পালক।

নৈঃশব্দ্যের রঙ জ্বেলে যে ধ্বনিটা ভেসে যাচ্ছে
সুর থেকে সুরে—
তার স্বর চিরে দ্যাখো উড়ে যায় যত কোমল কোরক।

মন্দ্রস্রোত ঢেউ তুলে যে নদীটা ঘুরে যাচ্ছে
কূল থেকে কূলে—
তার ঢেউ ফুঁড়ে দ্যাখো নেমে যায় যত জলের স্মারক।

তবে কি জগত ঠিক সেই মতো ঘূর্ণ্যমান—
মোহময় ধ্বনিময় সুরময় এক মায়ার আলোক?