দীপক রায়ের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া শহরে, ১৯৪৮ সালের মার্চে। কবিতার বই ১৪টি, গদ্যের ৪টি এবং সম্পাদনা ৩টি। তার স্লেজগাড়ি, অংশত সুন্দর, সাতজন একা, অজ্ঞাতবাসের চোদ্দদিন পাঠকপ্রিয় কবিতার বই। তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন ‘এই শতাব্দীর প্রেমের কবিতা’ নামে একটি সংকলন।
এখানে যিনি থাকেন তিনি রাজা
এখানে জ্যোৎস্না সবুজ। এখানে পাতা ঝরার শব্দ।
এখানে যিনি থাকেন তিনি রাজা।
এখানে রোদের গন্ধে নির্জনতা। এখানে নির্জনতায় পাখির কান্না।
এখানে যিনি থাকেন তিনি রাজা।
এখানে জলের শব্দে কম্পন। এখানে পাতার মর্মরে হাহাকার।
এখানে যিনি থাকেন তিনি রাজা।
এখানে এক রাজা থাকেন।
তার নগ্ন হাত আর পা।
ধূসর তার মুখ।
করতলে মাটির গন্ধ।
এখানে রাতের আঁধারে বাতাবির গন্ধে তিনি হাঁটেন। দুপুরের রোদে
দিঘির জলে পা ডুবিয়ে বসেন। আর অবিরল ধারায় বৃষ্টি হলে
তিনি নতজানু প্রার্থনা করেন।
এখানে যিনি থাকেন তিনি রাজা।
সময়
মেঘের ভিতর দিয়ে যে-বিমান ভেসে যায় দূরে কোনো অজানা দুপুরে
তার নাম জানি না কখনো।
শুধু এই মেঘাচ্ছন্ন মাঠে সে ফেলে যায় কিছু পরিত্যক্ত কাচ—
কুড়োতেই বেলা বয়ে যায়।
নৌকা
দিন যায়। আর রাত।
ভোর হলেই গুলঞ্চের ঝরা পাতা
খালি পায়ে ঘাটে এসে দাঁড়াই
মকবুলের ভাঙা নৌকোটা কতদিন পড়ে আছে
প্রতিশ্রুতি
গাজিপিরের মেলায় একদিন বিকেল হলে যাবার কথা ছিল। হলুদ বাঁশপাতা
হ্রদের নিচে ঝরে পড়ছে। আজ কি সেই বিকেল?
সারামেলা তন্নতন্ন করে খুঁজে সেই নীল চুড়ি আর অলৌকিক সাঁওতালি মালা
কিনবে বলেছ। এই কি সেই সময়! নীল মেঘের সঙ্গে ঠোক্কর খেতে খেতে
কোথায় মেষের গলায় ঘণ্টা বেজে ওঠে। আজ গাজিপিরের মেলা।
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে মেলা ছেড়ে ফিরে যাবে মানুষ। আর অলৌকিক
মালা হাতে সারাপ্রান্তর ঘুরে বেড়াব শুধু। মালা থেকে খসে পড়বে
শুকনো ফল, তামার পয়সা আর প্রতিশ্রুতি।
সীমানা
উত্তর দিকে সে ফিরে গিয়েছে কেন যে এমন
দখিনা বাতাস ফিরিয়ে এনেছে কেন যে এমন
গাছের বাকলে আঁকা ছিল মুখ তখন রাত্রি
পাথরে মাটিতে হারিয়ে গিয়েছে তখন রাত্রি
জীর্ণ পোশাকে কেন ফিরে আসা তখন রাত্রি
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাই রাতের ভেতরে কেন যে এমন
রাতের ভেতরে জবা হয়ে ফোটো কেন যে এমন
স্নাত
এই দুপুরে এক অলৌকিক হ্রদ থেকে উঠে এলে।
কানের পাশ দিয়ে গড়াচ্ছে জল,
চিবুক বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা বুকের অন্তরঙ্গতায়।
একটু দূরে দাঁড়াও—না হলে তোমাকে ছুঁয়ে ফেলব।
কাবুল থেকে এসেছি জোব্বা পরে
কাল, পরশু কি পরদিন ফিরে যেতে হবে আফগানে।
—এই নাও আখরোট বাদাম কিশমিশ।
আমার আফগানের বালি আছে ঝুলিতে—নাও।
আর যে-হ্রদ থেকে এই দুপুরে উঠে এলে তুমি
আলগোছে তার থেকে কিছু জল নিংড়ে দাও—
পান করি, আর তোমাকে দেখি—
স্নাত তুমি, আলগোছে তোমাকে একবার।
চিহ্ন ১৯৭১
বাস থেকে নামিয়ে কাল যাদের গুলি করা হলো
তাদের লাশ সারারাত পড়েছিল রাস্তায়
লাশগুলি মর্গে যাবে আজ
শুধু ওয়াসিম কাপুরের তেলরং ছবির মতন
দু-এক ফোঁটা রক্ত লেগেছিল দেয়ালে দেয়ালে
হেমন্তের হাওয়ায় আজ এক অনর্থ
হেমন্তের হেমবর্ণ হাওয়ায় আজ খুব অনর্থ হলো।
একঝাঁক পাতা এসে ছড়িয়ে পড়ল
আমাদের হেমবর্ণ উঠোনে।
কিছুই উপেক্ষণীয় নয়—এমনকী এই সামান্য হাওয়া
এই পাতা ঝরে পড়া, এই শীতের আভাস, সার্কাস তাঁবু
আর ছোট্ট চেহারার জোকার।
ঈশ্বর আমায় আর-একবার সময় দিন। আর-একবার।
আমি সব ঝরা পাতা কুড়িয়ে নেব।
সব ঝরা পাতা, যা তোমাদের পায়ের ওপর ঝরে পড়েছে
—কুড়িযে নেব, কুড়িয়ে কুড়িয়ে নেব
ওই হেমবর্ণ আলোয়।
আজ আমি এক অনির্বচনীয় আলো পেয়েছি।
আজ এক অনর্থ ঘটে গেল হেমন্তের হেমবর্ণ হাওয়ায়।
পাহাড়
ভোরবেলা, পরিখার চারপাশ ঘুরে, ফিরে আসার কথা ছিল মেয়র হোটেলে।
সাজ সেরে বসে থেকো তুমি, সাতটায় বাস—সেরে নিয়ো প্রাতরাশ।
ঝাউয়ের সারির পাশে রক্তমাখা জামা, তাই দেরি হলো।
শোনো, এটা অজুহাত নয়। শুধু চলে গেল বাস—
রক্তমাখা জামার অন্তরালে যে-কাহিনি থাকে
ভোরের শিশিরে ঢেকে কতটুকু চাপা থাকে তার সর্বনাশ।
কী যে হয়েছিল মনে নেই, মনে আছে শুধু পথ চলা
দুপুরের ঠিক কিছু পরে কী যে হয়েছিল মনে নেই
মনে নেই ঠিক কারা ছিল মনে আছে শুধু ছায়া ছিল।
তুমি ছিলে নাকি তারা ছিল বিকেলের খুব কাছাকাছি।
মনে আছে শুধু বহুরূপী মাঠ পেরিয়েছে টলোমলো।
ভুসোমাখা মুখ, খালিপায়ে, কিছু কিছু কথা ডালপালা।
উড়োজাহাজটি উড়েছিল আর সবকিছু এলোমেলো।
সারাবিকেল কি মাঠে ঘোরা? শুধু মনে আছে সাঁঝ নামা
শুধু মনে আছে তারা ফোটা মনে আছে শুধু পথ চলা।
কেউ কেঁদেছিল, মনে আছে? আরো কিছু কিছু মেঘমালা
বেলা হয়েছিল মেঘে মেঘে মনে হলো আজ সারাবেলা।
অপেক্ষা
সমস্ত আকাশ নক্ষত্রময় হয়ে উঠলে ডাক আসবে
জগন্নাথ অপেক্ষা করে।
ছোটো ইতিহাস
সে চেষ্টা করেছিল। সে পারেনি।
সকালে। দুপুরে। বিকেলে। সন্ধ্যায়।
সে চেষ্টা করেছিল। সে পারেনি।
সকালে বৃষ্টি হলে। দুপুরে রোদ উঠলে। বিকেলে করলে
আর রাত্রে হিম পড়লে।
সে চেষ্টা করেছিল। সে পারেনি।
সে শৈশবে পারেনি। সে কৈশোরে পারেনি। সে যৌবনে পারেনি।
আর প্রৌঢ়ত্বে এসেও সে পারেনি।
সে চেষ্টা করেছিল। সে পারেনি।
সে চেষ্টা করেছিল আর সে যে পারেনি।
—এটুকুই লিখে যেতে চায় সে।
আলো
‘জীবন পুড়িয়ে দিয়ে মুক্তি পেয়েছি’
—এইটুকুই বলে, ম্লান হেসে
মুখ তুলে চেয়েছিল সে
সূর্য গিয়েছে ঢলে, পশ্চিমে, ম্লান আলোটুকু তার
মুখে এসে পড়ে অবশেষে।
আবছা
বাঁশবাগানের ধারে একটু উঁচু জমি আবছা মনে পড়ে
শ্যাওলা-ধরা ইটে একটু ঘেরা জমি আবছা মনে পড়ে
ছোটো মাটির ঘোড়া ছড়িয়ে আছে কেন দরগা পিরের মাঠে
জ্বালানো মোমবাতি কাঁপতে থাকে রাতে মনে পড়ছে খুব
শহর পার করে বনের কাছাকাছি মনে পড়ল খুব
আখ্যান
কমলকুমার আজ আরও উন্মত্ত ও আগ্রাসী। বনবিহারী
আরও শান্ত ও উদাসীন।
ঊর্মিমালা আরও আক্রান্ত ও মেঘ ঢাকা।
এরপর আর-কিছু জিজ্ঞাসা করেনি সে।
ফেরিওয়ালা
এক অনিশ্চিত ফেরিওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়
এক অনিশ্চিত বসন্তের সন্ধ্যায়
সুন্দরবন পর্ব
১
ভোরবেলা জোয়ারের জলে এসে পড়ে আছে একা
এখন ভাটার টানে সরে গেছে নির্বিকার জল।
একটি স্টিমার কীরকম মুখ গুঁজে পড়ে আছে
কাদার ভেতর—এই কথা ভেবে একাকী সারস
উড়ে উড়ে চলে গেল দূরে। কোথায় সারেং তার?
সারেং-এর বউ তাকে অসময়ে কেন ডেকেছিল?
বিপদ ছিল কি তার কিছু? পর্যটকের মতন
অনেক সমুদ্র আর অনেক নাবিক দেখে আমি
নদী মোহনায় এই কথা ভেবে, ভয়ে কেঁপে উঠি।
দূরে চোখে পড়ে একটি টালির বাড়ি। ধোঁয়া ওড়ে
মাটির উনুন থেকে। কালো হাঁড়ি চাপানো উনুনে।
উনুনে বাতাস দেয় গৃহবধূ। ভাত ফোটে। গন্ধ
তার বাতাসে ছড়ায়। একটি ছাগলছানা দূরে শুয়ে আছে।
বিপদ ঘটেনি তবে। ছল করে ডেকেছিল সারেং-এর বউ
কূটযুক্তি
কৌটিল্যের যুক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছ তুমি। লিখে দাও
একশো সনেট—তবে আমি কবি বলে মেনে নেব।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছি। কী করি এবার?
ও কাজ আমার নয়—মধুসূদন, ক্ষমা করো, পেত্রার্ক তুমিও। শুধু
আত্মপক্ষ সমর্থনে বলি
—বাশো কি লিখেছে কোনো চতুর্দশপদী?
লিখেছেন হিমেনেথ উনগারেত্তি অথবা কোনো বের্টোল্ট ব্রেশট?
কবিতা তো হরেকরকম—বলেছেন যিনি
সেই কবি জীবনানন্দও লিখেছেন অনেক সনেট
প্রাণে ভরে দু’-চার লাইন যা লিখেছি ছড়ানো-ছিটানো
কিছুই হলো না ভেবে মাথা খুঁড়ি
—প্রতিদিন মাথা খুঁড়ে মরি...