বিরোধীতার সৃজনশীলতা

nonameতরুণ বয়সে কবিতার দিকে চোখ রেখে তিনি তার যাত্রা শুরু করেছিলেন, তারুণ্য পেরিয়ে এক সময় উপলব্ধি করলেন, গদ্যই তার প্রাণে বেশি ঝড় তুলছে। তা সত্যিই বোধকরি। এখন যখন তার সৃষ্টিকর্মের দিকে আমরা ফিরে তাকাই, তখন দেখি হুমায়ুন আজাদ নামের মানুষটি মূলত তার গদ্যের জন্যই ঝড় তুলেছিলেন আমাদের সমাজ-রাজনীতি ও সাহিত্যে।

প্রথানুগত চিন্তা করেননি হুমায়ুন। আর সেই প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত গদ্যের কাছেই যেতে হয়েছে তাকে। প্রবন্ধে এই চিন্তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই উঠে এসেছে, কেননা প্রবন্ধের জন্য নিজস্ব একটি ভাষাভঙ্গিও নির্মাণ করে নিতে পেরেছিলেন তিনি। আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখব, প্রথম দিকে তিনি যে ভাষারীতিতে প্রবন্ধ লিখেছেন, যত দিন গেছে, ততই তা যেন বেঁকে যেতে শুরু করেছে এবং অনেক তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। তিনি যে কলাম লিখতেন, সে জন্যে যে ভাষাভঙ্গীকে বেছে নিতে হয়েছিল, যে ভাষাভঙ্গীর সঙ্গে তার স্বভাবগত বাচনভঙ্গীরও মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তা তার প্রবন্ধের লিখনরীতিতেও শেষের দিকে ভর করেছে। প্রবন্ধ অবশ্য প্রবন্ধের মতোই হয়ে উঠেছে, তবে এর ফলে তা পেয়েছে এমন এক গতিময়তা, যা আমাদের আটকে রাখতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

এ কারণেই দেখি, হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’র মতো গভীর ব্যাপ্ত বিষয়ও পাঠককে আকৃষ্ট করেছিল। লেখাই বাহুল্য, তার প্রবন্ধগ্রন্থগুলোর মধ্যে এটিই তাকে জনসমক্ষে আলোচিত করে তোলে। প্রবন্ধ ক্যাটাগরিতে ফেলে বিবেচনা করা তার ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’ও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। যদিও একে ঠিক প্রবন্ধগ্রন্থ বলা যায় না। গ্রন্থের প্রথম থেকেই মনে হয়, একজন জননেতা জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে, উদ্বেল এক ভাষাভঙ্গিতে কথা বলছেন, তাতে যুক্তি আছে, কিন্তু আরও বেশি রয়েছে অতৃপ্তি ও অপ্রাপ্তিকে উসকে দিয়ে পাঠককে উত্তেজিত করে তোলার নাটকীয় শক্তি। শেষ পর্যন্ত এ বই এক দীর্ঘ কলাম– আমাদের সাম্প্রতিকীর দলিল। এমন একটা বিপণ্ন রাজনৈতিকতার দেশে বাস করি আমরা যে, শেষ পর্যন্ত কোনও প্রাবন্ধিকের এমন রাজনৈতিক গদ্যই আমাদের তাকে মূল্যায়ন করতে শেখায়। তাই হুমায়ুন আজাদ যে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কিংবা পাকিস্তানবাদী সাহিত্য আন্দোলনকে নিয়ে লিখতে লিখতে অকস্মাৎ তার দেখা পাখিদের দিকেও বারবার ফিরে তাকিয়েছেন, তা আর আমাদের আড্ডা-আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে না খুব একটা, স্পেনের দার্শনিক হোসে ওর্তেগা ঈগাসেৎ-এর লেখা পড়তে পড়তে তিনি যে আলোড়িত হয়েছিলেন আর তা থেকে জন্ম নিয়েছিল সেই প্রাবন্ধিকের চিন্তাদর্শের সংক্ষিপ্তসার ‘শিল্পকলার বিমানবিকীরণ’, তাও ভালো করে ছুঁয়ে দেখা হয় না।

এই সংক্ষিপ্তভাষ্যে হুমায়ুন আজাদের চিন্তার, প্রবন্ধের কিছুই আসলে স্পর্শ করা সম্ভব নয়। তবে এটুকু হয়তো বলা যায়, প্রথাবিরোধিতার যে চুম্বকশক্তি আছে, হুমায়ুন আজাদ আমাদের টানেন সেই শক্তি দিয়ে; কিন্তু সেই বিরোধীতার মধ্যে যে সৃজনশীলতার শক্তি আছে, নির্মাণের ব্যাকরণও আছে, তা আবিষ্কার করার চেষ্টা আমরা খুব কমই করে থাকি।