নভেরাকে নিয়ে আনা ইসলামের বই, অবশ্যপাঠ্য

noname

আনা ইসলামের লেখার সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় দৈনিক বাংলার সাহিত্য সাময়িকীর দৌলতে। কবি আহসান হাবীবের সম্পাদনায় সাময়িকী। সাহিত্য বিচারে, সম্পাদনায়, লেখা নির্বাচনে, এবং জাত-লেখক চেনার মুন্সিয়ানায় আহসান হাবীব বহুমান্য, বহুশ্রুত, বহুল আলোচিত।

এরকম জনপ্রবাদ, আহসান হাবীব যখন নতুন লেখক বাছাই করেন, নিশ্চিত তিনি, আমাদের সাহিত্য তাঁর কাছে (লেখকেরা কাছে) ঋণী।

তাঁর নিশ্চয়তায় ভরসা পেয়েছি আমরা। যেমন পেয়েছি আনা ইসলামকে, লেখার গুণেই।

ধারণা ছিল, আনা ইসলাম বোধহয় শিল্পসমালোচনার গণ্ডিতেই আবদ্ধ। ধারণার কারণও আছে। বেলাল চৌধুরী (কবি) সম্পাদিত ‘সচিত্র সন্ধানী’তে চারুকলা বিষয়ক লেখালেখি প্রাধান্য দিয়েছেন। দরকার ছিল বৈকি।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম নারী সাংবাদিক ‘লায়লা সামাদ’ (আসলে গল্পকার, তাঁর দুই-চারটি গল্প পাঠককুলে সাড়া জাগিয়েছিল একদা), ‘সংবাদ’-এ। পরে নিজেও পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন।

আনা ইসলামও বাংলাদেশে পয়লা শিল্পসমালোচক, নারী-নামধারী। পয়লা অর্থে বোঝাচ্ছি, যথার্থ। আরও ছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু, আনার মতো গভীর পর্যালোচনায় ছবির ভিতর মহল, সার্বিক মহল, ছবির রূপ-অরূপ নিয়ে তীক্ষ্ণধী হননি। তাঁর সমালোচনা পড়ে ছবি দেখার চোখও তৈরি হয়, ‘দৃষ্টি’ পায়।

আনা ইসলাম গল্পও লেখেন, পরে জেনেছি। গল্পের বইও প্রকাশিত, পরে পড়েছি। গল্পের বিষয় বহুবিধ। অভিজ্ঞতালব্ধ। ভাষায় কোনো মারপ্যাঁচ, আঁতলামি নেই। সহজ-সরল কথন, অথচ কাহিনি ও কাহিনির বিন্যাস গভীরতর বোধের প্রকাশ। এতটাই যে, সমাজ-রাজনীতি, পারিপার্শ্বিকের চরিত্রের মুখোশ উন্মোচিত।

আনা ইসলামের বোধের প্রকাশে মূলত শিল্পের (চারুকলার) অন্তর্নিহিত জগতের খুঁটিনাটির বিশ্লেষণ।

“মানুষকে চেনাজানা, মানুষকে বোঝা দুষ্কর, যদি-না মানুষ আপাদমস্তকে নিজেকে একাত্ম না-করে।” এরকমই বলেছেন মার্শল প্রুস্ত, ফরাসি জাঁদরেল ঔপন্যাসিক, একটি লেখায়।

আনা ইসলাম মানুষ চিনেছেন, শিল্পীকে চিনেছেন, না চিনলে ফ্রিডা কালো’কে অবশ্যপাঠ্য বই, ‘কষ্টের মনীষা’ কী করে লিখলেন? আত্মিক বেদনাবোধ এবং মানবশিল্পের প্রেরণা থেকেই নতুন বই, ‘নভেরা : বিভুঁইয়ে সভূমে’; চলতি বছরের প্রথমার্ধে প্রকাশিত, ঢাকার ‘জার্নিম্যান বুকস’ এবং ‘অন্যপ্রকাশ’-এর যৌথ উদ্যোগে। ৩৩২ পৃষ্ঠার ঢাউস বই, এরকম অঙ্গসৌষ্ঠবের বই বাংলা প্রকাশনায় সচারচার দুর্লভ। না-পড়ে ঘরে সাজিয়ে রাখলেও শোভাবর্ধক। কার একটি লেখায় পড়েছি, “রবীন্দ্রনাথের সব বই নয়, রচনাবলীও নয়, ‘সঞ্চয়িতা’ এবং জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ বহু ঘরে, ড্রয়িংরুমে সজ্জিত। বাঙালির পাঠকালচার আলমারিতে শোভিত।”

আনা ইসলামের ‘নভেরা : বিভুঁইয়ে সভূমে’র বিচ্ছন্ন লেখা, নানা সময়ে লেখা, বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত। পড়ে অপেক্ষায় ছিলাম, গ্রন্থে প্রকাশিত করলে কীভাবে সাজাবেন, গ্রন্থিত করবেন। উদ্বেগের অবসান ঘটিয়েছেন। নভেরার শুরু ও শেষের পরম্পরা একমাত্রায় রচনা সাংঘাতিক বাহাদুরি। পড়তে-পড়তে মনে হয়, ‘ধন্য হলেম গহনকালে/ ধন্য আমি সকালসাঁঝে’ (নবনীতা দেবসেন)।

নভেরাকে নিয়ে বিস্তর গল্প, কিংবদন্তী, মিথ্যে কথার পসরা, মনগড়া কথার বস্তা, নভেরার সমকালীনদের (শিল্পী), আসল কথা কী, সব তথ্য একত্রিত করে আনা ইসলাম দেখিয়েছেন, জানিয়েছেন গলদে গুজবে ডালপালা ছড়িয়ে বাঙালি আত্মসুখী। আনা ইসলামের এই বই না পড়লে জানা অসম্ভব নভেরা কতটা দেশীয়, কতটা বৈশ্বিক, কতটা মানবিক, কতটা বিভুঁইয়ে সভূমে, কতটা মাটি-মানুষের আপন।

এই বইয়ের অনেকাংশে নভেরার বিভিন্ন সময়ের ছবি, নভেরার কাজের ছবি, কথোপকথনের কথামালায় উল্লেখিত, বিস্তারিত।

অবাক হয়েছি আনা ইসলামের অধ্যবসায়ে, এতটা খাটাখাটনি করে, এতটা বিচার-বিশ্লেষণে কী করে লিখলেন ‘নভেরা : বিভুঁইয়ে সভূমে’ এই বই না পড়লে নভেরাকে সম্পূর্ণ জানবো না। অজ্ঞানতাও দূর হবে না।

আনা ইসলামকে প্রণতি।