রক্তজবাদের কেউ ভালোবাসেনি

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সংগ্রামের আখ্যান

এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের সমাজ এখনো স্বাভাবিক নয় এমন সন্তানদের প্রতি মমত্ববোধ বা মানবিক চেতনা জাগাতে পারেনি। তাই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রতি শুধু অবহেলাই নয়, তারা আদৌ মানুষ কি না এমন নিষ্ঠুর কৌতুক করতে দ্বিধা করে না। এরকম একটি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আখ্যান বয়ানের মধ্যে দিয়ে মৌলি আজাদ যে সাহসী বক্তব্য উপস্থাপন করেছে—তার জন্য সাধুবাদ না জানানো সমালোচকের দৃষ্টিতে অন্যায় মনে হয়।

এবার রক্তজবাদের গল্পে আসি। গ্রামের মাতবর ফজর আলির পুত্রসন্তান না হবার বেদনা ঘুচেছিল শোভন নামের এক সন্তান জন্মের পর। কিন্তু এক সময় দেখা গেল সে আসলে তৃতীয় লিঙ্গের। আর এরপরই অবহেলা অসম্মানে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো প্রচলিত সমাজের আত্মমর্যাদা আর মেকি অহঙ্কার ঢাকতে। শহরে এসে তৃতীয় লিঙ্গের শোভন হলো শোভা। সে লেখাপড়া শিখে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমাজে নেতৃত্বের জায়গা তৈরি করে নিয়েছে, যদিও আখ্যানে তার সেই সংগ্রামের বর্ণনা অনুপস্থিত। এই শোভা একসময়ে শহরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। অবতীর্ণ হয় সর্দারণীর ভূমিকায়। আলম নামের এক ছেলের সাথে তার ভালোবাসার গন্তব্যহীন সম্পকের্র কথাও আছে এ উপন্যাসে। মানুষ বলেই দুজনেরই পাওয়া-না পাওয়া বেদনার মধ্যেও শোভা অনেক বাস্তববাদী। তাই সে আলমকে বলে, ‘আমি তোমাকে বারবার বলেছি আবারও বলছি, আমার মতো অপূর্ণাঙ্গ মানুষের জন্য ভালোবাসা নয়। আমরা বড়জোড় করুণা পেতে পারি। ভুলে যেয়ো না তোমাদের সমাজ আছে। সে সমাজে আমি বা আমরা বেমানান।’ লেখক এখানে আমরা ও তোমরার দূরত্বটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হলেও এরা যে মানুষ এবং অন্য দশজনের মতো মায়া মমতা প্রেমের মানবিক গুণাবলি আছে, আছে ক্ষুধা আশ্রয় আর সপ্নের বাস্তবতা নিয়ে একই রকম জীবন, আমাদের সমাজ তা মানতে চায় না।

তাই রাস্তার মেড়ে, সিগনালে কিম্বা বাজারে যখন এরা কারো কাছে জীবন-ধারণের জন্য সাহায্য চায়, টাকা চায়, হয়তো চাওয়া ভঙ্গিটা রুঢ় কিন্তু পাল্টা তথাকথিত সভ্যসমাজের আচরণটা লেখক তুলে ধরেছেন এখানে—

আমার পথ ছাড়বি তুই?
তুই তোকারি কর কেন
তোদের সাথে আর কি ভালো ব্যবহার করব?
কেন আমরা মানুষ না বুঝি?
সেটা তোরাই ভালো জানিস যে তোরা মানুষ না জানোয়ার... না মানুষ না জানোয়ার আস্ত একটা হিজড়া। লজ্জা হয় না তোদের?

আসলে এ লজ্জা তো আমাদের সবার। সমাজ এখনো মানসিক-শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মানো সন্তানের প্রতি মানবিক হতে শেখেনি। এমনকি রাষ্ট্রও না। আর সেকারণেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অত্যাচারিত-নিগৃহীত হয় কখনো জনতা কখনো আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী রক্ষকের হাতে। এদের যেন ঠাঁই নেই কোথাও। মানচিত্রবিহীন অবাঞ্চিত মানুষ যেন এরা। যৌনকর্মী হিসাবেও দাঁড়াতে পারে না এরা, কখনো কখনো পৈশাচিক অত্যাচার ও বিকৃতি চরিতার্থ করে মানুষ নামের আমাদের সমাজের পশুরা।

এ উপন্যাসের আখ্যানে সালেহা, মাসুমা, পারুল, বকুলি, বানু, কিন্নরী যেন সেই অবহেলিত উপেক্ষিত সমাজেরই প্রতিনিধি।

সাধারণ মানুষ যখন এক কিশোরীর সম্ভ্রমহানি ও প্রাণনাশের চেষ্টার চোখের সামনে দেখেও প্রতিবাদ করে না প্রতিরোধ গড়ে না, তখন এই তৃতীয় লিঙ্গের সালেহাই প্রতিবাদ করে দেখিয়ে দিয়েছে সাহস আর মনোবল দিয়ে গুন্ডার হাত থেকে কিভাবে মানুষকে রক্ষা করতে হয়। যে কাজ মানুষ নামের অহংকারী মানুষ করেনি, তা মানবিক মমতা-ভালোবাসা বঞ্চিত একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ করেছে। সালেহা বলে, ‘পুলিশ স্যার আপনে ভালো মানুষ। তাই আপনে আমারে মানুষ কইছেন। আমাদের কেউ মানুষ কয় না। ওইযে কইলেন হয়তো কিছু তফাত আছে আপনাদের সাথে সেটাই আসল। সবাই সেটারে বড় কইরা দেখে। এ দুনিয়া আমাদের মত মানুষের জন্য নয়। দুনিয়াটা আপনাদের।’

এই আমাদের আর আপনাদের তফাতের আখ্যানই হলো ‘রক্তজবাদের কেউ ভালোবাসেনি’। যদিও আমাদের মতো একই রক্ত প্রবাহিত ওদেরও শরীরে।কিন্তু আমরা তা মনে রাখি না।

উপন্যাসের আখ্যান বিন্যাস, চরিত্র বিকাশ, ভাষাশৈলী এসব শিল্পগত দুর্বলতা সত্ত্বেও ‘রক্তজবাদের কেউ ভালোবাসেনি’ বিষয় ও দৃঢ় বক্তব্যের ভিন্নধর্মী উপন্যাস। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সামাজিক অসম্মান আর রাষ্ট্রের অবহেলা নিয়ে এধারার লেখা সাম্প্রতিক সময়ে আমার অন্তত চোখে পড়েনি। তাই ‘রক্তজবাদের কেউ ভালোবাসেনি’ (আগামী প্রকাশনী, ২০১৭) বইটির জন্য লেখক মৌলি আজাদকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।