‘নিমজ্জন’ সেলিম আল দীনের নাটক; তবে এ রচনাকে নাটক বা নির্দিষ্ট ‘ফর্ম’-এ অভিহিত করার বিষয়ে সেলিম আল দীন নিজেই সংশয় প্রকাশ করেছেন— “চাকা থেকে অতি সম্প্রতি লেখা উষা উৎসব বা স্বপ্ন রমণীগণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ নাট্যরূপে অভিধেয় হওয়ার মতো নয়। আবার সেগুলো নাটক যে নয় তাও নয়।”
এক ধাঁধার সৃষ্টি করে ‘নিমজ্জন’—এখানে স্থানবিহীন এক স্থানের কথা বলা হয়েছে—স্থানের ঐক্য ভেঙে ‘সর্বময়’ করতে চেয়েছিলেন। পাঠক বা দর্শক কেউই বলতে পারবে না স্থানটি ঠিক কোথায়— এটি কি বাংলাদেশ? বুরুন্ডি? নাকি আফগান? মানুষেরও কোনো নাম নেই, কিংবা যেকোনো একটা নাম ধরেই যেন চরিত্র গুলোকে ডাকা যায়, তাতে চরিত্র বা গল্পের কোনো মানহানি হয় না।
‘এক রুক্মবর্ণ স্টিমার এসে বন্দরে থামে যখন মধ্যরাত্রি’—এ সংলাপের সাথে সাথেই দর্শকের মাঝে মধ্যরাত্রের উৎকণ্ঠা শুরু হয়। মঞ্চের দক্ষিণে রাখা নরকঙ্কালও যেন সংলাপের সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠে ‘গণহত্যাকারীদের ক্ষমা নাই’। নাটক শুরু হয় দুই পর্বের মঙ্গলাচরণ দিয়ে; যদিও গ্রাম থিয়েটারের সেই মঙ্গলাচরণ থেকে ভিন্ন ধাঁচের এ কথামালা। নাটকে একজন আগন্তুক আসে একসময়ের সহযোদ্ধা অধ্যাপক বন্ধুর কাছে। যে বন্ধু আজ পঙ্গু; শাসকের পোষ্যরা তার মেরুদণ্ডে পেরেক মেরে দিয়েছে। হুইল চেয়ারে বসা অধ্যাপক বন্ধু আগন্তুককে এই শহরে প্রবেশে যত বিপত্তি তা চিঠিতে লেখে, আগন্তুক শহরে এসে বুঝতে পারে চিঠিতে লেখা প্রতিটি হরফ রক্ত বর্ণের। অগণিত লাশ ও বীভৎস মৃত্যু দেখতে পায় স্টেশনে নেমেই। লেখক যে হোটেলে উঠেন তা একতলা ডুবে যাওয়া নদী ঘেঁষা স্থাপনা। মূলত এর মাধ্যমে নির্দেশক দর্শকের কল্পনা কে নিয়ে গেছেন নিমজ্জিত এক মঞ্চের কাছে।
নিমজ্জিত মঞ্চ থেকে আগন্তুক ভ্রমে পৌঁছে যায় এক আধুনিক শব সংরক্ষণ মর্গে—যেখানে সে বিধর্মী একান্নটি শিশুর লাশ দেখতে পায়, যাদের হত্যার কারণ হিসেবে বলা হয়— “এরা ভিন্ন ধর্মের শিশু, সে ধর্মের লোকসংখ্যা কমানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।”
সেলিম আল দীন কিংবা এই নাটকের অন্য প্রযোজনা যেমন স্থানহীন স্থান কিংবা নামহীন চরিত্র উপস্থাপন করে গল্পের কেন্দ্র ভেঙে দিচ্ছেন নূর-ই-নাজনীন সেখানে ব্যতিক্রম। তিনি তার প্রযোজনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুর ব্যবহার করেছেন। এখানে যেমন ছিল আগন্তুকের স্মৃতিচারণে তার মেক্সিকান প্রেমিকার সাথে ওয়েস্টার্ন সুরে নৃত্য, তেমনি ছিল উকিল মুন্সীর ‘পূবালী বাতাসে’ গানটির সুর। এই মিশ্র সুর ব্যবহার করে নূর মূলত সকল স্থানকে কেন্দ্রীভূত করে স্থানের নির্দিষ্টতাকে ভেঙে দিয়েছেন।
গণহত্যার বীভৎসতার আবহ তৈরিতে ভূমিকা রেখছে আগন্তুক চরিত্রের পোশাক। চে গুয়েভারা কিংবা ফিদেল কাস্ত্রোর মতো যোদ্ধার পোশাক যা এসব গণহত্যার বিরুদ্ধে তার বিপ্লবী অবস্থান পরিষ্কার করেছে। নিমজ্জন নাটক সেলিম আল দীন শুরু করেন ‘রুক্মবর্ণ’ স্টিমার এর কথা বলে, বাস্তবে শব্দটি ব্যবহার তেমন দেখা যায় না—তাই আমাদের শ্রবণে শব্দটি এক বিমূর্ত দ্যোতনা সৃষ্টি করে। নূর-ই-নাজনীনও সেরূপ তার পুরো স্ক্রিপ্ট জুড়ে এমন বিমূর্ত শব্দের আশ্রয় নিয়েছেন; যা মূল টেক্সটকে অনেকটা ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে।
কেন লিখলাম এই নিমজ্জনের কথা? এর উত্তর আছে ‘নিমজ্জন’-এর সংলাপে— “যে এই আশ্চর্য নিমজ্জনের সাক্ষী সে যেন অন্য সাতজনকে বলে—সেই অন্য সাতজন যেন আরও ঊনপঞ্চাশজনকে বলবে—সেই ঊনপঞ্চাশ জনের প্রত্যেকে আরও সাতজনকে বলুক এবং পৃথিবীর তাবৎ গণহত্যা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এই নিমজ্জনের কাহিনী প্রত্যেক শ্রবণকারী, কবি ও চিত্রী এই উপাখ্যান ও গণহত্যার কাহিনী নিজ নিজ সুরে ও কথায় চাষ করুন"। অন্তত সাতজনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমার এই লেখা। কারণ এখনও পৃথিবীতে, "সভ্যতা বলে কিছু নাই, আছে শুধু জেনোসাইড।"