পূর্ব প্রকাশের পর
এবার দেখলাম ছোট মেয়েও মুখ খুললো। ‘এমন অশান্তির দেশ যাকে ঘরে রাখলেও শান্তি থাকে না বলে জোর করে স্বাধীনতা দিয়ে দেয়া হলো, সেই দেশ আজ এত শান্তির দেশ হলো কীভাবে?’—তার প্রশ্ন। দেখলাম কিছুটা কৌতূহল জেগেছে। ভাবলাম সাসপেন্সটা ধরে রাখি। তাই বললাম—‘এই গল্প আজ আর থাক। চলো আমরা রাতের খাবার খাই আর কালকের কাজের পরিকল্পনা করি। কাল রাত বারোটার পরে অর্থাৎ সকাল ১টায় আমাদের ফ্লাইট। এই সকাল ১টা-২টার হিসাব আর এএম-পিএম এর খতিয়ান বিমানের ক্ষেত্রে বড় প্যাঁচ লাগায়। আমার বন্ধু সৈয়দ সগিরউদ্দিন এই সিঙ্গাপুর বসেই বছর দুই আগে সকাল পাঁচটার বিমান ধরতে বিকাল পাঁচটায় উপস্থিত হয়েছিল। বন্ধু শামীম রেজাও একবার এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিল কাছের দেশ কলকাতায়। ফলে ব্যাপারটা আমাদের খুব মাথায় রাখতে হবে। তোমরা জানো, টাকা বাঁচানোর জন্য আমরা যেতে-পথে তিন ঘণ্টা আর আসতে-পথে ৭ ঘণ্টার স্টপওভারসহ এক গরিবি বিমানে টিকেট করেছি। তোমাদেরকে বলেছি—এতে করে আমরা থাইল্যান্ডের এয়ারপোর্টটা আসতে যেতে অন্তত দু’বার ভালো করে দেখতে পাবো। কিন্তু আসলে তোমরা জানো, ব্যাপারটা দেখার উদ্দেশ্যবাহিত নয় বরং দারিদ্র্যজনিত। তোমরা বড় হয়ে যখন আমাকে নিয়ে ঘুরবে, তখন আশা করি এরূপ দারিদ্র্যজনিত স্টপওভারে আমাদেরকে ভুগতে হবে না।’
পরের পুরো দিনটা আমরা ঢাকায়ই কাটালাম। ছেলেমেয়েরা উত্তরায় তাদের মামার বাসায় আর আমি আমার কয়েক বন্ধুর সঙ্গে সরকারের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার বাসায় এক গেট-টুগেদারে। গেট-টুগেদারের সেই স্মৃতিটুকু বেশ করুণ। সেখানে অনেক বছর পরে দেখা হয়েছিল আমাদের এক আমেরিকা-প্রবাসী বন্ধু মোহাম্মদ জিয়াউল আহসানের সঙ্গে। জিয়া নিউইয়র্কে পুলিশ বিভাগে ট্রাফিক সুপারভাইজার পদে চাকুরি করতো। ওটাই ছিল জিয়ার সঙ্গে শেষ দেখা। জিয়া গত ২৬ এপ্রিল নিউইয়র্কে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমাদেরকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেছে। সেদিন কি ঘুণাক্ষরেও মনে হয়েছে—জিয়ার সঙ্গে আর দেখা হবে না?
রাত ১০টার দিকেই আমরা চলে এলাম বিমানবন্দরে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমাদের বোর্ডিং পাস ও ইমিগ্রেশন শেষ হলো। এখনো আমাদের হাতে দেড়-দু’ঘণ্টা সময়। কী করবো ভাবতে ছোট মেয়েই বললো সিঙ্গাপুরের বাকি গল্পটা হতে পারে। একটু নিরিবিলি দেখে এক জায়গায় বসলাম। গতকালের বলা পর্যন্ত ছোট মেয়ে ইতোমধ্যে বড় মেয়েকে ব্রিফ করে দিয়েছে। তাই বলা শুরু হলো সিঙ্গাপুরের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া স্বাধীনতার পরের দিন থেকে।
স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা দেশ যে কত হাজারো সমস্যায় পড়ে তা তো তোমাদের জানার কথা না, আমার কিছু কিছু মনে আছে আমাদের নিজেদের স্বাধীনতার পরের কিসসা-কাহিনি থেকে। সিঙ্গাপুরের সে বিপদ তো আরও অনেক বিশাল। তাদের দেশ মানে তিন দিকে সাগর দিয়ে ঘেরা একখানা পোর্ট যা বানিয়ে দিয়ে গিয়েছে বৃটিশরা। কিন্তু একখানা পোর্ট চলতে, তার মালামাল-কলকব্জা আরও হাজারো অনুষঙ্গী বিষয়াদি রাখার জন্য, সামলানোর জন্য যে একটু সুবিধামতো জায়গা আর পরিবেশ দরকার, জ্ঞানী মানুষেরা যার নাম দিয়েছে ‘হিন্টারল্যান্ড’, সেইটাও তাদের নেই। সোজা কথায় পোর্ট একখানা থাকলেও তা চালানোর জন্য দরকারি জায়গাজমিটুকুও নেই। চাল-ডাল-গম-ভুট্টা নিজের কিছুই নেই। এক পিপা ডিজেল বা পেট্রোলও নিজের নেই। আছে খালি মালে-চাইনিজে মারামারির পাপ।
এভাবেই ৫০ বছরের সাধনায় একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশ বিশ্বের প্রথম শ্রেণির দেশেরও প্রথম সারিতে চলে এসেছে একজন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে। তাঁর নাম তোমরা ইতোমধ্যেই জেনেছো—লি কুয়ান ইউ, সংক্ষেপে লি। লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স থেকে অর্থনীতিতে গ্রাজুয়েট এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে গ্রাজুয়েট এই লোকটি ১৯৬৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত একটানা ২৫ বছর সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তারপর নিজেই পার্টির পরবর্তী জনকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে সরকার থেকে সরে আসেন। তিনি সরে আসতে চাইলেও পরবর্তী সরকার ১৯৯৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সিনিয়র মিনিস্টার হিসেবে তাঁকে ক্যাবিনেটে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেন। এরপরেও তাঁর নিষ্কৃতি হয়নি। ২০০৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তাঁকে সরকারে ধরে রাখা হয় ‘মিনিস্টার মেন্টর’ হিসেবে, বা বলা যায় সরকারের ‘গুরুদেব’ হিসেবে। তখন তাঁর বয়স ৮৮ বছর। ২০১৫ সালে মারা যাওয়ার পূর্বে তিনি তাঁর নিজ মৃত্যু সংবাদ শুনে যেতে পেরেছিলেন কারণ তাঁর আসল মৃত্যুর পাঁচদিন আগে ১৮ মার্চ তারিখে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর অফিসের এক ভুয়া ওয়েবপেইজে তাঁর মৃত্যুর খবর ছাপা হয় এবং সেই পেইজ থেকে অনেক ইন্টারন্যাশনাল নিউজ এজেন্সি খবরটি ভুল ভাঙ্গার আগেই গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে ফেলে। শোনা যায়, তিনি মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, মৃত্যুর পরপরই যাতে তাঁর মরদেহ তাঁদের ধর্মীয় রীতিতে অগ্নি-সৎকার করে ফেলা হয়। কিন্তু তাঁর ভক্তকুল তাঁর সব কথা শুনলেও এই কথা শোনেননি। মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ সাতদিন ধরে রাখা হয় সবাইকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের সুযোগ প্রদানের জন্য। ২৯ মার্চ তাঁর মরদেহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সৎকার করা হয়।
গল্পের এ পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই আমাদের বিমানের বোর্ডিং গেইট ঘোষণা করা হয়েছে। কিছু মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েও গেছে। আমরাও গল্প আর না বাড়িয়ে গরিবি বিমান থাই লায়নের জন্য সিকিউরিটি চেকের গেটে দাঁড়িয়ে গেলাম। একই গেট থেকে দুই বিমানের জন্য লোক ডাকা হচ্ছে। সৌদি এয়ার লাইনস এবং থাই লায়ন। সৌদি আমিরদের জোর বেশি তাই তারা একটু আগে আর আমরা একটু পরে। বাগড়ির হাটের ‘টাপুইর্যা নায়’তে ওঠার সেই ছেলেবেলার অভিজ্ঞতা। কেউ যাচ্ছে এদিক দিয়া, কেউ ওদিক দিয়া, যার যেমন খুশি। আমরাও খুশিমতো যাচ্ছিলাম। শেষে বললো বোর্ডিং পাস এটাও লাগবে, আর থাই এয়ারপোর্টেরটাও লাগবে। কী আর করা। রেখে দেওয়া ব্যাগ থেকে আবার বের করে দুটোই দেখাতে হলো। সব দেখাদেখির পালা শেষে জায়গা মিললো থাই লায়নের প্যাসেঞ্জার টিউবে। ভোর-রাত নাগাদ আমাদের বিমানখানা নামতে শুরু করলো। আমার ছেলে জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলো—দেখ, কোনো দেশ উন্নত হলে আসমান থেকেও তার আলামত পাওয়া যায়। জানতে চাইলাম—‘কী আলামত, বাবা’? বললো—‘দেখ, নিচের আলোর সারি। কতটা পরিকল্পিত, যেন একদম ছকে আঁকা। ঢাকা থেকে ওঠার সময়ও তো নিচের দিকে তাকিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল এবড়ো-থেবেড়া এক দঙ্গল বাতি নাচানাচি করছে। আর এখন দেখ আলোর সারিগুলো কত জ্যামিতিক মাপে মাপে ছকে সাজানো।’ বললাম—‘বাবা, এইসব ভেবে দুঃখ বাড়িয়ো না। দেশের ভালো বিষয়গুলো নিয়ে ভাবো।’
কিছুক্ষণেই নামলাম ডন মুইয়াং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, থাইল্যান্ড। আগে এর নাম ছিল শুধুই থাইল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। ১৯১৪ সালে এটি নির্মিত হয়েছিল। তখন সারা দুনিয়ায় মাত্র হাতে গোনা ত্রিশ-চল্লিশটার মতো এয়ারপোর্ট ছিল। তবে সেগুলোও ছিল না যাত্রী পরিবহণের জন্য। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত এশিয়ায় কোনো যাত্রীবাহী বিমানই ছিল না। ১৯২৪ সালে এই এয়ারপোর্টটি প্রথম যাত্রী পরিবহণের জন্য খুলে দেয়া হয়েছিল। এটি সারা দুনিয়ার জন্যই অতি পুরনো একটি যাত্রীবাহী বিমানবন্দর। তবে ইতিহাসে খানদানি হলেও বর্তমান জৌলুসে এটি অনেক খাটো। ২০০৬ সালে ব্যাংককে সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট খুলে দেয়ার পরে এটি এক বছর পুরো বন্ধ ছিল। ২০০৭ সাল থেকে এটি আবার চালু হয়েছে শুধুমাত্র সব গরিবি ফ্লাইটগুলোর এক এয়ারপোর্ট হিসেবে। ২০১৫ সালে এটি খেতাব পেয়েছে দুনিয়ার গরিবি ফ্লাইটের সবচেয়ে বড় বিমান বন্দর হিসেবে (the world's largest low cost carrier airport)। ২০২০ সালে সেই বিমানবন্দরে ছেলেমেয়েসহ নেমে গরিব হিসেবে আমিও সেই সম্মানের ভাগ পেলাম। অবশ্য এই বিরল সম্মানের কথা ছেলেমেয়েদেরকে জানালাম না। বরং সুড়সুড় করে ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সফার ডেস্কে নতুন বোর্ডিং পাস নিয়ে বোর্ডিং পাসে উল্লিখিত গেটে গিয়ে অপেক্ষায় বসলাম পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য। যাওয়ার সময়ের স্টপওভার খুব দীর্ঘ ছিল না। দুই-আড়াই ঘণ্টার স্টপওভার বোর্ডিং পাস নেয়া, বোর্ডিং গেট খুঁজে পাওয়া আর ওয়াশরুমে ফ্রেশ হওয়ার মধ্যেই কেটে গেল। ওয়েটিং লাউঞ্জে পরিচয় হলো বাংলাদেশেরই এক সৌখিন ট্রাভেলারের সঙ্গে, যিনি বর্ণনা দিচ্ছিলেন তাঁর ১৪/১৫টা দেশের ঘোরার অভিজ্ঞতা যার কোথাও তিনি হ্যান্ডলাগেজের চেয়ে বেশি কোনো লাগেজ নিয়ে কখনো ভ্রমণ করেননি। আফসোস হচ্ছিলো আমার স্ত্রী সঙ্গে থাকলে দেখিয়ে বলতে পারতাম, ‘দেখ, ওনাকে দেখে রাখো, আর শিখে রাখো কীভাবে দেশে-বিদেশে ঘুরতে হয়’। তিনিও আমাদের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে যাচ্ছিলেন।
চাঙ্গি এয়ারপোর্ট থেকে বিশ্বের ১০০ এয়ারলাইনসের বিমান সরাসরি বিশ্বের ৩৮০টি শহরে চলাচল করে থাকে। গড়ে প্রতি ৮০ সেকেন্ডে এখান থেকে একটি বিমান ওঠানামা করে। এর চারটি টার্মিনাল রয়েছে। আমাদের থাই লায়নের ঘাঁটি হলো ৩ নম্বর টার্মিনালটি। শুধু এই টার্মিনালেই ২৮টি এ্যারোব্রিজ গেট রয়েছে, আর পুরো বিমানবন্দরের রয়েছে ১১৭টি এ্যারোব্রিজ ও ৪২টি রিমোট গেট। টার্মিনালের নির্মাণ-কাঠামোটি মূলত কাচের। ৯১৯টি স্কাইলাইট গেট থেকে ৩ নম্বর টার্মিনালটি সরাসরি রোদের আলোতে আলোকিত হয়। সম্প্রতি শুনলাম এই কোভিড আমলে নাকি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আর সব টার্মিনাল বন্ধ করে এই একটি টার্মিনালই সচল রেখেছে। চলবে
আরও পড়ুন : সিঙ্গাপুর সায়েরি | পর্ব-০১