কারও কারও মনে অপু কোনওদিন মরে না। জীবনের কুশ্রী কাটাকুটি আর বলিরেখার আড়ালে ঢাকা-পড়া অপাপবিদ্ধ মুখটায় বসানো বিস্ময়ভরা একজোড়া চোখ আর তাদের অন্তহীন দেখার আকাঙ্ক্ষা বেঁচে থাকে। সেই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই সেই একই পথ দিয়ে চললাম তিস্তা দেখতে; বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে মহীপুর বাজারের কাছে তিস্তার ওপর নতুন তৈরি হওয়া ব্রিজ দেখতে।
কিন্তু পথের মতো পথিকও চিরকাল একরকম থাকে না, সেকথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে পড়ল বাড়ির কাছের বটতলা থেকে রিকশা ভাড়া করতে দাঁড়ানোর পর; পায়ে-চালানো রিকশা একটাও নেই—সব ব্যাটারির রিকশা। তাতে পায়ে চালানোর প্যাডেল যথারীতি আছে, তবে সেটা ঠুটো হাতের মতো অচল হয়ে রিকশার গায়ে লেগে আছে মাত্র। চালানোর সময় রিকশাঅলার পা জোড়া অলসভাবে পড়ে থাকে প্যাডেলের স্পিন্ডল শ্যাফ্টের দুদিকে। অমসৃণ পথের ঝাঁকুনিতে প্যাডেলজোড়া মাঝে মাঝেই অতিরিক্ত দুটো আঙুলের মতো নড়েচড়ে জ্বালাতন করে। তাই দুয়েকজন পাটের দড়ি বা লতা দিয়ে সে-দুটোকে শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হলো, রিকশার বিবর্তনের পরের ধাপে মানবজাতির ল্যাজের মতো প্যাডেল খসে পড়তে আর বেশি দেরি নেই। কাঠামোতেও পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট; বাঁশের হুডের জায়গা নিচ্ছে ধাতব কাঠামোর হুড, গড়নও আগের চেয়ে আঁটোসাঁটো আর শক্তপোক্ত। গোলাটে আকৃতির বদলে চৌকো আকৃতির চলন বেড়েছে। মনে হলো, সাধের রিকশাচিত্রকেও লোকে বাহুল্য বলে মনে করছে আজকাল। বাংলাদেশের মফস্বলে নতুন যন্ত্রযুগ এসে গেছে।
শুধু চিরচেনা মনুষ্যবাহী রিকশাই নয়—মালবাহী রিকশাভ্যানগুলোও পুরনো যান্ত্রিক কাঠামো আর নতুন বৈদ্যুতিক শক্তির মিশেলে যেন ‘বায়োনিক’ কিংবা ‘হাইব্রিড’ বস্তু হয়ে উঠেছে। সেই সাথে শত শত ব্যাটারিচালিত ‘অটোরিকশা’ তো আছেই। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, পুরো রংপুর শহর আর তার চারদিকের পথঘাট গত কয়েক বছরে বৈদ্যুতিক ব্যাটারির স্বয়ংক্রিয় শক্তিতে গতিময় হয়ে উঠেছে।
রিকশার ধীরগতির সুযোগে চারদিকটা ভাল করে দেখতে দেখতে যাব বলে ইচ্ছা ছিল। অগত্যা সে ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে চটজলদি দেখে নিতে লাগলাম দ্রুত অপসৃয়মাণ দৃশ্যাবলি : পথের একদিকে দেখছি কৃষক সদ্যই ধান কেটে নিয়েছে, নাড়াগুলো এখনও তাজা। পড়ন্ত বেলায় ধানের আঁটির বোঝা নিয়ে কেউ কেউ বাড়ির পথ ধরেছে। তারই অন্যদিকে নতুন গজিয়ে ওঠা দোকানের সারি—মুদি দোকান, স্টেশনারি, ওষুধের দোকান তো আছেই, আরও আছে কাপড়ের দোকান, মাঝখানে একটা দুটো লেদ মেশিন, গ্রিল বানানোর ওয়ার্কশপ, প্লাস্টিকের তৈজস আর ফার্নিচার বিক্রি হচ্ছে কোনও দোকানে, আর মাঝেই মাঝেই ঝকঝক করছে ‘বিকাশ’ আর ‘ফ্লেক্সি লোডে’র ব্যানার। ঝলমল করছে ‘গ্লো অ্যান্ড লাভলি’র নতুন গোলাপি সাইনবোর্ড, ভুলে কিংবা অবহেলায় থেকে-যাওয়া পুরনো ‘ফেয়ার’-অলা সাইনবোর্ড একটাও চোখে পড়ল না—সুদূর আমেরিকার ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের ধাক্কা কত দ্রুতই না বাংলাদেশের দরিদ্র উত্তরাঞ্চলের পরিবর্তমান গ্রামীণ জনপদে এসে পৌঁছেছে। বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন বাংলার তথাকথিত ‘চিরকালিন গ্রাম’ আসলেই আজ আর নেই।
মহীপুরের ব্রিজ তিস্তার দু’পাড়কে এক করেছে, বলাই বহুল্য—সেটাই তো তার কাজ। এপারে রংপুর শহর থেকে বুড়িরহাট, তালুক হাবু, গজঘণ্ঠা হয়ে মহীপুর বাজার। ওপাড়ে কাকিনা, তুষভাণ্ডার হয়ে লালমনিরহাট। এপারের এই পথই আমার এবারের যাত্রাপথ, আমার বালকবেলার সেই পায়ে-হাঁটা পথ।
‘পথ’ জিনিসটা যে ভূপৃষ্ঠের ওপর পড়ে থাকা একটা স্থির দ্বিমাত্রিক ভৌগোলিক কাঠামোমাত্র নয়, সেকথা সবাই জানেন। পথ বহুমাত্রিক, কেননা সাদা চোখে সে স্থির হলেও তার একটা ‘প্যাসিভ’ বিমূর্ত গতি আছে, যে-গতি প্রাণ পায় পথিকের পায়ের নিচে, যানবাহনের চাকার নিচে। পথের লুকনো গতিই পথিকের পায়ে সঞ্চারিত হয়ে তাকে সামনে এগিয়ে দেয়। পথিক এগোয় আর পথটা তার পায়ের নিচে কেবলই পিছিয়ে যায়। আর এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াটা একবারই ঘটে, চিরকালের জন্যে—কোনও পথের কোনও নির্দিষ্ট বিন্দুতে কোনও পথিকের পা দুবার পড়ে না। অর্থাৎ, পথের একটা ‘সময়’ বা ‘কাল’ মাত্রাও আছে। আর অন্য মাত্রাটা হলো পথের দুধারের পৃথিবী, তার ক্রমাগত বদলাতে থাকা ভূদৃশ্য আর জীবন। বুড়িরহাট বাজার পার হয়ে তালুক হাবুর দিকে রিকশাটা যতই এগোতে লাগল, পথের এই নানান মাত্রা যেন রূপ ধরে আমার চোখের সামনে ততই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।
শত শত বা হয়তো হাজার হাজার বছরের বাঁশ-খড়-কাশের বাড়ি দ্রুত বিদায় নিচ্ছে। ব্যাপকভাবে খড়-কাশের বদলে টিনের চালের আবির্ভাব তো কয়েক দশক আগেই ঘটেছে; এখন বাঁশের বেড়াগুলো দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে ইটের দেওয়ালে। কৃষিক্ষেত আর পুরনো বাঁশের বেড়াঅলা বাড়িঘর হটিয়ে এখানে-ওখানে গজিয়ে উঠেছে ইটের দালান—এই দৃশ্যটাই সবার আগে দৃষ্টি কাড়ে। এলোমেলো ছড়ানো পাকা বসতবাড়ি, দোকানপাট, খামার, সরকারি স্থাপনা—কোনওটার টিনের ছাদ, কোনওটা কংক্রিটের। আর সেগুলো গড়ে ওঠার কোনও মাথামুণ্ডু নেই, ‘ডিজাইন’ বা পরিকল্পনা নেই। খসে-পড়া বাঁশের বেড়া আর টিনের ছাউনিঅলা এক দঙ্গল পুরনো গ্রামীণ ‘বাড়ি’র মাঝখানে হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে উঠেছে একটা একতলা বা দোতলা পাকা ‘বাসা’—নতুন, ঝাঁ চকচকে। কোথাও বাড়ির পাশের কৃষিজমি ভরাট করে তৈরি হচ্ছে মুরগির খামার বা পশুখাদ্যের কারখানা। সব দালানের আকার আর রোয়াব-রোশনাই অবশ্য সমান নয়। কোনওটা সচ্ছল কৃষকের ফসল-বেচা টাকায় বানানো, কোনওটা ঢাকায়-চাকরি-করা একদা-গ্রামবাসীর অল্প বেতন থেকে কষ্টে জমানো অর্থে গড়া, কোনওটা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বা রংপুর বিভাগের অন্যান্য জায়গা থেকে আসা মানুষজনের নতুন আবাস, কোনওটা এক পুরুষ আগে কৃষি-ছেড়ে-দেওয়া ব্যবসা-সফল মানুষের, কোনওটা বা আঙুল ফুলে কলাগাছদের অট্টালিকা। এদেশের এলোমেলোভাবে গড়ে ওঠা সমাজে কে যে কখন কীভাবে কোন আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়ায় ফকির থেকে আমির হয়ে ওঠে বোঝা মুশকিল। সেই অননুমেয় রহস্যময় ‘সোশাল ক্লাইম্বিং’-এর ব্যাখ্যাহীন বিশৃঙ্খলা এই পথের দুই ধারে মূর্তিমান।
বুড়িরহাট বাজারের পাশ কাটিয়ে যাওয়া রাস্তাটা এখন পিচঢালা মসৃণ আর প্রশস্ত। তালুক হাবু পেরিয়ে গজঘণ্টার সীমানার দিকে এগোতেই বেনারশি-পল্লী। রাস্তা থেকে তাঁতঘরগুলো দেখা না গেলেও গত কয়েক বছরে পথের দুই ধারে গড়ে উঠেছে বিরাট বিরাট শো-রুম। সেগুলোর আকার আর রোশনাই চারপাশের গ্রামীণ প্রাকৃতিক পটভূমিতে বেমানানই লাগে। এখানকার সমাজের মনের ভেতরের সীমাহীন মাত্রাহীন বিবেচনাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষার ধৈর্যহীন বিরাট পাখিটা বহুবছরের দারিদ্র্যের বন্দিত্ব থেকে একলাফে ঠেলে গুঁতিয়ে বেরিয়ে এসে আকাশ ছুঁতে চাইছে—সেই আকাঙ্ক্ষা অসুখের লক্ষণ এখানে-ওখানে বিভিন্ন চেহারায় ফুলে ফেটে বেরোচ্ছে। একটা জায়গায় ছোট্ট একটা দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা : ‘প্রোপাইটার: মোঃ দিল্লীর বাদশা (নাসির)’।
আর দুই-আড়াই কিলোমিটার এগোলেই মহীপুর বাজার। পাঁচ বছর আগে শেষ যেবার এসেছিলাম, ব্রিজের কাজ তখনও অনেক বাকি। নদীর ভাঙনে মহীপুর বাজার বারবার সরে গেছে; তারপর নতুন তীরের কাছে আবার গড়ে উঠেছে। বর্তমান বাজার তাই বহুবারের নতুন বাজার। তিস্তাপাড়ের এই রীতি। বসতবাড়ি হোক বা মসজিদ, ফসলের ক্ষেত হোক বা বাগান—বারবার পুনর্জন্ম নেয়, মরে না। নদীর ভাঙাগড়া বুঝে খানিক সরে গিয়ে আবার মাথা তোলে, গড়ে ওঠে। এ কি তিস্তার মায়া নাকি মানবস্বভাব, নাকি দুটো আসলে একই—কে বলবে। মানুষ সহজে তার পরিচিত আবাস ছেড়ে যেতে চায় না। তবে অনেকেই যে বাধ্য হয়ে চিরকালের মতো নদীপাড়ের আদি আবাস ছেড়ে অন্য কোথাও পাড়ি জমান না তা নয়। কেননা এও তো সত্যি যে মানুষ চিরকালের যাযাবর।
দেখলাম পাঁচ বছর আগের বাজারের চেহারা আমূল বদলে গেছে। যথারীতি বাঁশ-কাঠের কাঠামোর জায়গা নিয়েছে ইট-সিমেন্টের কাঠামো। যথেচ্ছভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুরনো দোকানপাটের বদলে দুটো টিনের ছাদঅলা একতলা মার্কেট গড়ে উঠেছে। তার ফলে একটা কেন্দ্রীয় শৃঙ্খলা এসে গ্রামীণ হাটের মতো বাজারটাকে অনেকটা শহুরে রূপ দিয়েছে।
ব্রিজের কাছে এসে চোখ জুড়িয়ে গেল; নভেম্বরের শেষের মেঘহীন পরিষ্কার নীল আকাশ। নিচে ক্ষীণতোয়া শান্ত নদী; তার পানির ধারাটা ঠিক মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে আর ওপরের আকাশ তাকে নীল রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। বর্ষার তীব্র স্রোত থেকে রক্ষার জন্য ব্রিজের কাছাকাছি নদীর পাড়টা বাঁধানো, তার নিচে বড় বড় সিমেন্টের বোল্ডারের জঙ্গল। নদীশাসনের এই আয়োজন ব্রিজের কাছের বাসিন্দাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে স্থায়িত্বের। তাই পাড়ের উপরেই গড়ে উঠেছে নদীমুখি সুদৃশ্য বাড়িঘর। এই শুকনো মৌসুমে নদীর ওপাড় ধরে চর। এপাড়-ওপাড় জুড়ে দাঁড়ানো উঁচু ব্রিজটার রেলিংগুলো লাল রং করা। মধ্যদুপুরের রোদে উজ্জ্বল ব্রিজটার উপর দিয়ে একটা-দুটো গাড়ি চলেছে; আর অনেক নিচে শান্ত নদীর উপর ছোট্ট একটা ডিঙি বাঁধা। ব্রিজের উচ্চতা আর থামগুলোর বিশালত্বের পাশে কেমন ক্ষীণ আর পরিত্যক্ত দেখাচ্ছে সেটাকে। কদিন আগেও নৌকাটার ব্যস্ততা ছিল; সে-ই ছিল ঘাটের প্রাণ। সারাক্ষণ যাত্রী নিয়ে এপাড়-ওপাড় করত ওটা, উপার্জন ছিল। আজ কিচ্ছু নেই।
ব্রিজ যখন ছিল না, এখানে খেয়াঘাট ছিল। ওপারের লালমনিরহাট, কাকিনা, তুষভাণ্ডার থেকে অবিরাম যাত্রীভরা নৌকা এসে ভিড়ত এপাড়ে। ওপাড়ে যাওয়ার জন্য নৌকার অপেক্ষায় থাকত শত শত যাত্রী। দোকানের বেচাকেনাও ছিল ভালো। এখন আর খেয়াপারের জন্য কোনও অপেক্ষা নেই; অনতিদূরে উঁচু ব্রিজের ওপর দিয়ে সাঁ করে ছুটে যাওয়া যাত্রীঠাসা অটোরিকশা কি গাড়িগুলো দোকান থেকে দেখা যায়। বৃদ্ধের দোকানে এসে একটা পান খেয়ে যাবার ফুরসত বা প্রয়োজন কারও নেই।
দোকানের সামনে দুদিকে দুটো বেঞ্চি পাতা, তাতে ক্রেতা বা পথচলতি লোকজন বা বাজারে আসা লোকজন বসে। দুএকজন এটা-ওটা কেনে। আজ হাটবার নয়, বেলাও দুপুর। তাই বাজারের মতো বেঞ্চিদুটোও প্রায় ফাঁকা। তাতে সাদা চেক লুঙ্গি আর ময়লাটে সাদা পাঞ্জাবিপরা গাট্টাগোট্টা আরেক বৃদ্ধ বসা, কদমছাট চুল আর চাপদাড়ি কাশফুলের মতো ধবধবে সাদা। পেশায় মাছের পাইকার; নদী থেকে ধরা বেলে, বাণ, বৈরালি কিনে নিয়ে রংপুর, লালমনিরহাটে চালান করেন। জানালেন, ব্রিজ হয়ে তাঁর ব্যাবসার সুবিধেই হয়েছে; যাতায়াত সহজ আর দ্রুত হওয়ায় মাছ নষ্ট হয় কম, ক্রেতাও মেলে সহজে। সব সময় কারও দুর্ভাগ্যের মূল্যেই কি অন্য কারও সৌভাগ্য কেনা হয়?