পূর্ব প্রকাশের পর
কিন্তু এখন শান্ত কৃশ তিস্তার তীরে বোল্ডারের স্তূপের ওপর বসে বড়শি ফেলে ধ্যানস্থ হয়ে আছে লোকজন—বালকেরাও বাদ যায়নি। নদীতীরের খোলা আকাশের ঈষৎ-তপ্ত রোদ আড়াল করতে কারও মাথায় ছাতা। আবালবৃদ্ধবনিতা গোসল সেরে নিচ্ছে পরিষ্কার ঠান্ডা পানিতে। এখানে-ওখানে দু-একটা ‘চটকা’ জাল খুঁটিতে বাঁধা, কোনওটার কেবল কাঠামোটা বাঁধা আছে, জালটা খুলে রাখা হয়েছে—অবসরমতো গৃহস্থ কৃষক ওটা টেনে দু-এক বেলার মতো মাছ ধরবে বলে। পানির কিনার আর নদীশাসনের সিমেন্টের বাঁধনের মাঝখানে যে এক চিলতে ভেজা বেলে মাটি, তীরবাসিনী বৌ-ঝিরা সেখানে ধনেপাতা, পিঁয়াজ কিংবা রসুনের বীজ বুনেছেন। সেগুলোর কচি পাতা শিরশিরে বাতাসে দোল খাচ্ছে।
তিস্তার এই অংশে মাছ ধরার আয়োজন খুব বেশি নেই। ‘চটকা’ জাল ছাড়া ছোট ডিঙি নৌকায় করে পাতা-জাল দিয়ে মাছ ধরতে দেখা গেল এক বৃদ্ধ আর তার সহকারীকে। বড়শির প্রচলন এখানে বেশি। বাজারের দোকানের সামনেই পরিচয় হয়েছিল বছর ত্রিশের এক যুবকের সাথে। হলুদ-কালো ডোরাকাটা টি-শার্ট আর অনেকগুলো পকেটঅলা প্যান্ট পরনে; মাছ ধরার উপযুক্ত পোশাক! হাতে হুইলঅলা বড়শি আর সাদা প্লাস্টিকের বাজারের ব্যাগ—মাছ ধরার সরঞ্জাম আর ধরা-মাছ রাখার জন্য। তেমন কিছু স্থির পেশা নেই, আছে মাছ ধরার নেশা। মুখে লম্বা কালো চাপদাড়ি আর খুলি কামড়ানো চুল। রোদে পুড়ে গায়ের শ্যামলা রং কালো হয়ে উঠেছে— ‘বোনা ফাইড’ মাছ-ধরিয়ে দেখেই বলে দেওয়া যায়। অনুরোধ করতেই নিজেই নদীটাকে পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে পাড়ের বাঁধানো জায়গায় এক হাতে ব্যাগ-বড়শি ধরে আরেক হাত সোজা ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন ছবি তোলার জন্য।
নদীর একেবারে তীর ধরে সরু মাটির ধুলোভরা পথ বুড়িরহাট-মহীপুর পাকা রাস্তার সমান্তরালে গঙ্গাচড়া সদর পর্যন্ত চলে গেছে। পায়ে-হাঁটা লোকজন, মোটরসাইকেল, ভ্যানগাড়ি, এমনকি দুয়েকটা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা সেই পথ দিয়ে চলাচল করছে। এই দুই রাস্তার মাঝখানে বাড়িঘর, যৎসামান্য সওদা সাজিয়ে রাখা দু-একটা দোকান, পুকুর, কিছু চাষজমি। এই বাড়িগুলো অন্যরকম—কোনওরকমে মাথার গোঁজার ব্যবস্থা যেন; কিন্তু তবু আলগা ভঙ্গুর নদীকবলিত মাটিতে জীবনের শিকড় পুঁতে দেওয়ার কোনও আয়োজন বাকি নেই। বাঁশ-খড় বা টিনের বেড়া, টিনের আচ্ছাদন, কিন্তু অগোছালো—নদীতীরের আলগা বেলেমাটির ওপর আলতো করে বসিয়ে রাখা হয়েছে যেন। কাছ ঘেঁষে মাটির ভাঙাচোরা পথটা চলে গেছে, বাড়ির উঠোন আর সেই পথটা একাকার। সেখানে গরু-ছাগল বাঁধা, কয়েকটা বাচ্চা নিয়ে মুরগি চরছে, দুটো কুকুরের ভালোবাসার পূর্বরাগ চলছে, পাটকাঠিতে গোবর চেপে তৈরি করা ‘শলা’ রোদে শুকাচ্ছে—সুলভ আর উৎকৃষ্ট জ্বালানি। পথটার একধারে কিছু গাছপালা, ইলেকট্রিকের খাম্বা, বাঁশের খুঁটি দিয়ে একটা মাচা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তাতে মেটে আলু, লাউ-কুমড়া বা শিমের লতা উঠে গেছে। পথটার প্রায় উপরেই কিছুটা দূরত্বে দুটো বাঁশের খুঁটি পুঁতে আর একটা বাঁশ তার ওপর আড়াআড়ি বসিয়ে গোলপোস্টের মতো একটা কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে—সেই গোলপোস্টের ক্রসবারে কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছে। মূল বসতঘরের একপাশের বেড়াটার তিনদিকে টিনের বেড়া দিয়ে গোয়ালঘর করা হয়েছে, তার খোলা দরজার বাইরে খড় ছড়ানো, উপরের চালাটায় ছোটো একটা জাল বাঁশের ফ্রেমসুদ্ধ উল্টো হয়ে রোদে শুকোচ্ছে।
সামনেই গান্নার পাড়—এ অঞ্চলে তিস্তার সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ বাঁক ওটা। গত এক দশকে বর্ষা মৌসুমে এখানে যতবার এসেছি, নদীর করাল গ্রাস দেখেছি। এখন শীতের শুরুতে নদী অনেক ভেতরে চলে গেছে। গান্নার পাড় থেকে নদীর ধারা পর্যন্ত অনেকখানি চর—সেখানে মিষ্টি আলু, শাকসবজির ক্ষেত। নদীর ধারার ধার ঘেঁষে সেইসব ফসলসমেত বিরাট বিরাট বেলেমাটির চাঙড় ভেঙে ভেঙে নদীতে পড়ছে।
সেখানে পথের ধারের আরেকটা বাড়ির উঠোনে সামান্য কিছু ধানের আঁটি একটা কাঠের গুঁড়িতে আছাড় মেরে মেরে ধান ঝাড়ছিলেন বছর পঁয়ত্রিশের একজন নারী। তাঁকে সাহায্য করছে তের-চৌদ্দ বছরের এক কিশোরী। নদীর অবস্থা কেমন জিজ্ঞেস করতেই নিতান্ত চেনা মানুষের মতো হাসিমুখে কাজ বন্ধ করে ভাঙতে থাকা সবজি ক্ষেতের দিকে আঙুল তাক করে বললেন, “ঐ যে দ্যাখেন, সোউগ চলি যায়চোল (সব চলে যাচ্ছে)।” নিজে থেকেই পরিস্থিতির বিস্তারিত বলতে লাগলেন, কিন্তু বর্ণনার ভাষায়, দেহভঙ্গিতে কোনও অভিযোগ নেই—যেন খুব স্বাভাবিক এসব, নিত্যদিনের ব্যাপার। বাস্তবিকই তাই; নদীর ভাঙাগড়ায় এই মানুষেরা অভ্যস্ত। হয়তো গোটা জীবনটাই এই নদীর তীরে, ভাঙনে ঘরবাড়ি ভিটেমাটি হারিয়ে, আবার গড়ে কাটিয়ে দিয়েছেন এই নারী। বাকিটা জীবনটাও কাটিয়ে দেবেন। সরল, বন্ধুত্বপূর্ণ—কিন্তু আদিম, সভ্যতাবিচ্ছিন্ন, অসচেতন নন এঁরা। ছবি তুলতে চাইলেই একইরকম মিষ্টি হেসে প্রত্যাখ্যান করে বললেন, “ছবি তুলবেন কেন? ছবি তুলব না।” সোজা সংক্ষিপ্ত প্রত্যাখ্যান, কিন্তু অমলিন হাসি আর বিনীত দেহভঙ্গির মিশেলে সে প্রত্যাখ্যানকে খুব ভব্য মনে হয়।
কথা বলতে বলতে উল্টোপাশের বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলেন শাড়ি-পরা এক নারী; বয়স ত্রিশের কোঠাতেই হবে। চুল ভেজা, ভাঁজ করা হাতে ভেজা কাপড়। বোঝাই যাচ্ছে, কেবলই গোসল করেছেন, কাপড় শুকোতে দেবেন। সুদর্শনা, সুযৌবনা নারীর কথায়-ভঙ্গিতে সম্পূর্ণ অপরিচিত পুরুষের সামনে কোনও সংকোচ নেই, আবার সামান্যতম অশালীনতা বা অসৌজন্যের আভাস নেই। অত্যন্ত পরিচিতের মতো স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে কথায় যোগ দিলেন কাপড় শুকোতে দিতে দিতে। শাড়ির পাড় একদিকে কিছুটা সরে গেছে, তথাকথিত আব্রু রক্ষার কোনও বাড়াবাড়ি নেই। আমার মনে হলো, আমার সামনে এই নারী অকারণে নিজের শাড়ির পাড় আর আঁচল টানাটানি শুরু করলেই বরং সেটা অশালীন আর অপমানজনক হতো। যামিনী রায়ের এলিগ্যান্ট নারীদের কথা অবধারিতভাবেই মনে এলো। স্বভাবতই এই নারীকে ছবির জন্য অনুরোধ করার সাহস পাইনি। অপ্রয়োজনীয়ও মনে হলো।
কিছুটা এগোতে একটা চওড়া বাঁকের কোনায় একটা দোকান। টিন-বাঁশ-কাঠের কাঠামোর ভেতরটায় উঁচু মাচার মতো মেঝে। সেখানে দোকানি বসে। এই দোকানটা মালপত্রে ঠাসা। সামনের বেঞ্চিতে দুই বৃদ্ধ বসে। একজনের কাঁচাপাকা চুল, কপালের উপরটায় অনেকখানি ফাঁকা। সাদা দাড়ি। নদীপাড়ের মৃদু ঠান্ডায় গায়ে গোলাপি গলাবন্ধ হালকা সোয়েটার। অন্যজন আরও বয়সী। চুল দাড়ি সব সাদা। পরনেও সাদা গেঞ্জির ওপরে আধময়লা হাফহাতা সাদা টি-শার্ট। হাতদুটো কোলের কাছে গোটানো। জিজ্ঞেস করতেই সাগ্রহে জানালেন তাঁর বয়স ‘সই সই’ একশ হয়েছে। পাশে বসতেই অচেনা মানুষের সাথে নিঃসঙ্কোচে আলাপ জুড়লেন। এককালে ব্রিটিশ টোব্যাকো কম্প্যানিতে চাকরি করেছেন। এক ছেলে আর তার বউ-ছেলে—এদের নিয়ে তাঁর সংসার। নাতি আর্মিতে চাকরি করে। বুড়ো দাদার ভীষণ যত্ন নেয়। শরীরে এই বয়সেও তেমন কোনও রোগ নেই তাঁর। শুধু চোখ আর কানের শক্তি কিছুটা কমেছে—ঐ যে মহিলাটা সামনের পথ দিয়ে যাচ্ছে তার কাঠামোটা বুঝলেও চিনতে পারছেন না। তবু চশমা পরেন না—কী দরকার! তাঁর কোনও অসুবিধা তো হয় না। আমাকে টানছিলো বয়সের আড়ালে ঢাকা-না-পড়া বৃদ্ধের কিশোর মুখখানা, আর সাগ্রহ সরল দৃষ্টি। সুখী পুরো একটি শতাব্দী বেঁচে থাকা তার সার্থক হয়েছে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, গাড়িতে ওঠার এক-দুই মিনিট পর একটু অস্বস্তিই লাগছিল। ভাবছিলাম পাকা রাস্তাটা আর কতটা দূর হতে পারে। হঠাৎ গাড়িটা ব্রেক কষে দাঁড়াতেই ছেলেটা বলে উঠল, “এইখানে বুড়িরহাটের গাড়ি পাবেন।” তাকিয়ে দেখি পাকা রাস্তায় এসে গেছি। ভাড়া দেব বলে পকেটের দিকে হাত বাড়াতেই কিশোরের সলজ্জ সবেগ “না না না” তার অটোরিকশার শোঁ শোঁ শব্দের সাথে মিশে একটা ব্যঙ্গাত্মক ধ্বনি তৈরি করে চারদিকের ঘনায়মান অন্ধকারকে নাড়িয়ে দিয়ে গঙ্গাচড়ার দিকে ছুটে চলল। আমি বুড়িরহাটের একটা অটোরিকশা ভাড়া করে তাতে উঠে বসলাম। নিজের মনের সংকীর্ণতায় অনুশোচনা হচ্ছিল।
টাকা দেওয়ার জন্য পকেটের দিকে হাত বাড়ানোটা আমার ঠিক হয়নি। চলবে
আরও পড়ুন : তিস্তা জার্নাল | পর্ব এক