পুর্বপ্রকাশের পর
বছর সাতেক আগে একবার গোডাউনের হাট পয়েন্টে তিস্তা দেখতে এসেছিলাম। বাঁধের ধারেই ছোট্ট বাজারটা—কিছু স্থায়ী দোকানপাট, এক প্রান্তে ভ্যান আর অটোরিকশাগুলো দাঁড়িয়ে থাকে যাত্রীর অপেক্ষায়। বাঁধ ধরে পুব দিকে এগোলে দুধারে চোখে পড়ে নদীভাঙা মানুষের বাড়িঘর—অগোছালো শ্রীহীন কুটিরগুলো যেন বাঁধের ঢালে কিংবা ঢালের নিচে কোনওরকমে ঝুলে আছে। একের পর এক বাঁশঝাড় ছাড়া অন্য গাছপালা তেমন নেই; সেগুলো একই সঙ্গে বাড়িগুলোকে ছায়া আর আব্রু দিচ্ছে, আবার বাঁধটাকেও কিছুটা শক্তি জোগাচ্ছে। তিস্তার আগ্রাসী ভাঙনের মুখে বেশ কয়েক বছর আগে দুটো গ্রোইন বানানো হয়েছে। মূল বাঁধের সাথে নব্বই ডিগ্রি কোণে নদীর ভেতরের দিকে কয়েকশ মিটার মাটির লম্বা একটা একটা বাঁধ বা রাস্তা চলে গেছে, তার মাথায় কংক্রিটের গ্রোইন। দ্বিতীয় গ্রোইনটা যেখানে শুরু হয়েছে তার লাগোয়া জমিটায় টিনের চালের ছোট্ট একটা দালান দেখেছিলাম, তার মাথায় লেখা “আবুলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়”, অথচ জায়গাটার নাম আবুলিয়া নয়। আদি আবুলিয়া এখন তিস্তার চরের ভেতরে—বোল্লার পাড় থেকে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তাটা ধরে নদীর দিকে বেশ কয়েক কিলোমিটার এগোলে ওখানে পৌঁছানো যায়।
তিস্তা অববাহিকায় নাম কখনও হারায় না, তার নিরন্তর স্থানান্তর হয় মাত্র। কোনও এক অন্ধকার রাতে নদীর গহ্বরে আচমকা ভেঙে পড়া ঘর, এমনকি কখনও কখনও আসবাব তৈজসপত্র পর্যন্ত সাথে নিয়ে পালাতে পারে না তিস্তাতীরের মানুষজন। কিন্তু স্থান অনিশ্চিত ভঙ্গুর হলেও তাদের নামগুলোর নাগাল নদীর স্রোত কখনোই পায় না। সেগুলোকে অতল জলতলে হারাতে দেয় না মানুষ। কেননা নামই বয়ে বেড়ায় ‘পুরান বাড়ি’র স্মৃতি আর সংজ্ঞা—আর ‘পুরান বাড়ি’ই হলো তিস্তাপাড়ের নদীভাঙা মানুষের একমাত্র বাড়ি বা ঘর, তার বাকি জীবনের সব আবাসই হলো সেই হারিয়ে যাওয়া ঘরের নিরুপায় প্রতিধ্বনি মাত্র।
গোডাউনের হাটের কাছে সেই পুরান বাড়ির দিশা খুঁজে পাবার পর আমার কাজ হলো গান্নার পাড় থেকে চরের ওপর দিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তাটা ধরে পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছানো। কেননা আমি যে শুধু কালের গভীরে পোঁতা আদি হৃৎপিণ্ডটাই খুঁজে পেতে চাইছিলাম তা নয়, তাতে রক্ত সঞ্চালন করেছিল যে ধমনীগুলো, সেগুলোরও অস্তিত্ব অনুভব করতে চাইছিলাম। সেইমতো গান্নার পাড়ের বাঁধের যে জায়গাটায় আমার বাবার সহপাঠীর দেখা পেয়েছিলাম, সেখানে আবার এসে পৌঁছুলাম বেশ সকাল সকালই। ভ্যানঅলা যথারীতি আমার উদ্দেশ্য শুনে আমাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং উপদেশ দিতে লাগলেন। আর তাঁর উপদেশ মানতে গিয়েই একটা বিপত্তি ঘটে গেল। আবার সেটাকে বিপত্তি না বলে একটা অপ্রত্যাশিত উপরি-পাওনাও বলা যেতে পারে।
সেই পথ ধরেই আবার নেমে পড়লাম তিস্তার চরের বুকে। গন্তব্য দৃষ্টিসীমায় হলেও বহুদূর। শুরুতে পথটার দুপাশের দৃশ্যাবলি পরিচিত। নানান রকম শাক-সবজি, তামাক আর আলুর ক্ষেত। লোকজন সেখানে কাজে ব্যস্ত। সবুজ ক্ষেত, এখানে-ওখানে পলি আর ভেজা মাটির কালচে বিস্তার, ধু ধু বিস্তৃত রুপালি জমির খণ্ডগুলোতে রোদ পড়ে বালির কণাগুলো চিকচিক করছে, মাঝে মাঝে তামাক বা আলুর ক্ষেতের পাশে সেচের পাম্পগুলোর টানা ঘটঘট আওয়াজ বিশাল চরটার অটুট নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছে। বোল্লার পাড় থেকে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা ধরে যেদিন এগিয়েছিলাম, সেদিন অনেকটা দূর পর্যন্ত রাস্তাটার অস্তিত্ব লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু এই রাস্তাটা শ’দুয়েক গজের মধ্যেই ক্ষেতের আল কিংবা এক-দেড় ফুট চওড়া সেচের সরু নালার রূপ নিয়েছে। সেই পথরেখা ধরে এঁকেবেঁকে এগিয়ে একটা তামাক ক্ষেতে পৌঁছুলাম। এক বৃদ্ধা সেখানে কাজ করছেন। ক্ষেতের চেহারা বিস্ময়কর—খসখসে চিকচিকে বালির জমি, সামান্য পলি বা ভেজা মাটির চিহ্ন পর্যন্ত নেই, তার উপর তামাকের চারাগুলো সার করে বসানো, আর সারা ক্ষেতটায় কিছুটা দূরে দূরে একইরকম বালির ছোট ছোট ঢিবি। বৃদ্ধা একমনে সেই ঢিবিগুলো ভেঙে ভেঙে তামাকের চারাগুলোর গোড়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ভেবেছিলাম ঐ বালির ঢিবিগুলোতে নিশ্চয়ই সার মেশানো আছে। কিন্তু বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করতেই ভুল ভাঙলো, “না বাবা, এইগ্লা খালি বালা, সার নাই।” তবে? এগুলো গাছের গোড়ায় দিচ্ছেন কেন! আসলে এই জমিতে তো কোনও ‘ম্যাদ’ বা পলি নেই, শুধু বালি। গাছের গোড়ায় একেবারে নিচের দিকে সামান্য পলি আছে, আর সেটুকুকে আশ্রয় করেই গাছগুলো বেঁচে আছে। এই বালির অতিরিক্ত আস্তরণটুুকু সেই পলিকে আর্দ্র রাখবে, রক্ষা করবে। নইলে চরের খোলা রোদে পলিটুকু শুকিয়ে গিয়ে চারাগাছগুলোর বেঁচে থাকা অসম্ভব করে তুলবে। ক্ষেতে সার বা পানি দিলেও এই বালির আস্তরণের ভেতর দিয়েই তা গাছের গোড়ায় পৌঁছাবে। ভাবলাম, চাষের এমন অদ্ভুত পদ্ধতি শুধু চরেই মিলবে—পলিমাটির বাংলাদেশের বিশাল বিস্তৃত সমতলের কোথাও নয়। “ভালো জমি নাই আপনার?”—এমন প্রশ্নে বৃদ্ধা জানালেন নদীতে ভেঙে যাওয়া পিতৃপুরুষের জমিজিরাতের মধ্যে এইটুকুই কেবল তিনি ভাইদের কাছে পেয়েছেন; বাকিটা হয় প্রবল ক্ষমতাবান পিতৃতন্ত্রের থাবার অধিকারে, নয়তো প্রবলতর তিস্তার ছুরির মতো ধারালো দাঁতে সাজানো চোয়ালের দখলে রয়ে গেছে।
তবে তিস্তার চরে জমির মালিকানা আর চাষের পদ্ধতির আরও বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন আমার তখনও বাকি।
বৃদ্ধাকে বিদায় জানিয়ে খানিকটা এগিয়ে লক্ষ করলাম, পথ থেকে বেশ কিছুটা বাঁয়ে এক চিলতে ভেজা মাটির খণ্ডে কয়েকজন নারী-পুরুষ বসে কাজ করছেন। আমার আর তাদের মাঝখানে মরুভূমির মতো শুষ্ক সাদা চিকচিকে বালির বিস্তার। অংশত কৌতূহলে, অংশত আমার যাত্রাপথ ঠিক আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নিতে বালি ঠেলে তাঁদের কাছে পৌঁছুলাম। মাত্র কয়েক বিঘত লম্বা এক টুকরো ‘ম্যাদ’ জমি, তাতে চারজন নারী-পুরুষ ভীষণ সরু স্বাস্থ্যহীন কতকগুলো পিঁয়াজের চারা পুঁতছেন। তাঁদের চারপাশ ঘিরে শুধু বালি আর বালি। অনেকটা দূরে দূরে আরও ছোটো কয়েকটা ভেজা জমির টুকরো। জানা গেল, এই ‘ম্যাদ’ বা পলি দূর থেকে এনে বালির সাথে মিশিয়ে জমির টুকরোগুলো তৈরি করা হয়েছে মাস তিনেক পর বৈশাখের ঝড় আর বৃষ্টির তাণ্ডব শুরু হবার আগেই চটজলদি কিছু পেঁয়াজ-রসুন বা মিষ্টি আলু ঘরে তোলার আশায়। আবার খেয়ালি তিস্তা নিজেও এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পলিজমির টুকরো সুবিস্তৃত বালির চরের এখানে-ওখানে ফেলে যায় প্রতি বর্ষায়; সেগুলো যে যেমন পারে দখল করে আবাদ করে। প্রতিবার বর্ষা বা বন্যা চলে গেলে চর যে রূপ পায়, সেই অনুযায়ী জমির মালিকানা নিয়ে তৎপরতা চলে। ‘ম্যাদ’ বা পলি বিশাল এলাকা জুড়ে পড়লে সেই জমির মালিকেরা দখল বুঝে নেবার জন্য আমিন এনে মাপজোকের আয়োজন করে, ঝগড়া বাধায়, মারামারি পর্যন্ত করে। আর বালি পড়লে ভ্রূক্ষেপও করে না। অনেক জমির মালিক রংপুর, ঢাকা কিংবা বিদেশে থাকে—জমির খোঁজ নিতে আসার গরজই বোধ করে না।
তিস্তার চরের আরেক অদ্ভুত নিজস্ব দৃশ্য চোখে পড়লো আরও খানিকটা এগিয়ে। সামনে দূরে সবুজ দিগন্তরেখা, সেখানে নদীর বর্তমান ধারা। ওপাড়ে গাছপালা, ক্ষেত, গ্রামের ঘরবাড়ি আর ময়াল দেখা যায়। সেই দিক থেকে শুকনো কচুরিপানার একটা রেখা বালির প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে বিরাট একটা সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে এসেছে ক্ষেতগুলোর কাছাকাছি। দূর থেকে চোখে পড়ল, একটা সাইকেলের দুটো হ্যান্ডেল দুহাতে ধরে একজন এগিয়ে আসছেন—ওটার চাকাদুটো চলছে কচুরিপানার সাপটার ঠিক পেট বা পিঠ বরাবর। সাইকেলের ফ্রেমের ফাঁকটাতে আর পেছনের ক্যারিয়ারে বড় প্লাস্টিকের ভর্তি বস্তা। বাহক কাছে আসতে আমাকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজে থেকেই হাসিমুখে বললেন, চরের বালির মধ্যে এ ছাড়া আর উপায় কি! দারুণ ব্যবস্থা—আমাকে স্বীকার করতেই হলো। সামান্য একটু উদ্ভাবনী কাজ অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে। কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ পুরু বালির স্তরের উপর দিয়ে অত ভারি বোঝা নদীর ঘাট থেকে চরের যান চলাচলের উপযোগী অংশে বয়ে আনা অসম্ভব হতো এইটুকু আয়োজন ছাড়া। আর তিস্তার চরের এই অনিশ্চিত, মায়াবীর দেশের মতো থাকা-না-থাকার ভূখণ্ডে কে বানাবে আধুনিক রাস্তাঘাট! তিস্তার চরের মানুষ তাই অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে নিজেরাই নিজেদের একান্ত নিজস্ব জীবনযাত্রা চালিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছে।
আমার চোখের সামনে কিছুটা দূরে প্রথম গ্রোইনটার কাঠামো স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। দ্বিতীয়টা এখনও অস্পষ্ট ছায়ার মতো দিগন্তে নেমে পড়া গাঢ় নীল আকাশ, সেখানে ভাসতে থাকা ছোট ছোট পাতলা সাদা মেঘের টুকরো আর ময়ালের সবুজের সাথে একাকার। সূর্য পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে, কিন্তু চরের আবহাওয়ায় এখনও আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়ানো। সে উষ্ণতায় পেছনে ফেলে আসা সদ্যপরিচিত কিন্তু যেন বহুকালের আত্মীয় মানুষগুলোর কুটিলতাহীন হাসিভরা মুখের আলো আর অমল অকৃত্রিম হৃদ্যতা মেশানো। চলবে