অমৃতকথা—৯

মহাভারতের শান্তিপর্বের একটি শ্লোকে দেখা যায়, আচার্য বৃহস্পতি প্রজাপতিকে প্রণাম করে বলেছেন, তিনি ঋক, সাম, যজুঃ, ছন্দঃ, নক্ষত্রগতি, নিরুক্ত, ব্যাকরণ, কল্প এবং শিক্ষা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেছেন। এখানে ‘নিরুক্ত’ ও ‘ব্যাকরণ’ শব্দ দুটি লক্ষণীয়। সনৎসুজাতীয় প্রকরণে বলা হয়েছে, যিনি শাব্দিক, ব্যুৎপত্তি ইত্যাদি জানেন, তাঁকেই বৈয়াকরণ বলে। পণ্ডিত সুখময় ভট্টাচার্যের মতে, “অধ্যাপক পরম্পরায় জানা যায়, তৎকালে ‘মাহেশ’ নামে প্রকাণ্ড এক ব্যাকরণ ছিল। সেই ব্যাকরণ সাগরের তুলনায় পাণিনি নাকি গোষ্পদমাত্র।”

মহাভারতের শান্তিপর্বে আচার্য যাস্কের নাম পাওয়া যায়। নিরুক্তশাস্ত্র তাঁর কাছেই ধরা দেয়। নির্ঘণ্ট বা নির্বচন পদ্ধতির দ্বারা ব্যুৎপত্তি লাভের বা অর্থ নিষ্কাশনের কথা বলা হয়েছে এই মহাকাব্যে। দর্শনের জগতে ভাষার ব্যাকরণ নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে। ‘মাহেশ’ নামক ব্যাকরণের কথা ছেড়ে দিলেও পাণিনি থেকে নোম চমস্কি পর্যন্ত সকলেই ভাষার শরীর (syntax) নিয়ে গবেষণা করেছেন। স্বাস্থ্যবান ভাষাই যার পরিণতি। কিন্তু শব্দ তথা ভাষার আত্মার কথা বলেন মহাভারতে উল্লিখিত আচার্য যাস্ক। প্রাচীন দর্শনের কিছু শাখা (গ্রীসের প্রাচীন দর্শন, মীমাংসা দর্শন) বাদ দিলে পদ-অর্থ সম্পর্ককে সকলেই আকস্মিক, প্রথাগত বলে বর্ণনা করেছেন। এখন শব্দ-অর্থ সম্পর্ক মানে সিগনিফায়ার-সিগনিফায়েড সম্পর্ক। চমস্কি শব্দের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক( Deep Structure) ও বহিরঙ্গ (Surface) গঠন স্বীকার করলেও বললেন, শব্দের অর্থ নির্ধারিত হয় বহিরঙ্গ গঠনের দ্বারা। কেউ বললেন, প্রয়োগের কথা। উত্তরাধুনিক দার্শনিকেরা বললেন, শব্দের কোনও দ্ব্যর্থহীন অর্থ নেই। প্রতিটি শব্দই অর্থের অভাবে ভুগছে। এ শুধু ভাষাবিজ্ঞানের সমস্যা নয়, এ সমস্যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আক্রমণ করেছে। এর জন্য ভাষার একরৈখিকতাই দায়ী। কোনও কোনও জায়গায় ভাষাকে বুঝতে গেলে মহাভারতে উল্লিখিত আচার্য যাস্কের নিরুক্তকে বুঝতে হবে; যে পদ্ধতি মানলে ভাষার একরৈখিকতা থেকে বেরিয়ে আমরা বহুরৈখিকতার দিকে এগোতে পারব। মহাভারত নামক মহাকাব্যও একরৈখিক নয়, বহুরৈখিক। নির্বচন প্রক্রিয়ার দ্বারা শব্দের ক্রিয়া ধরে শব্দের লক্ষণ নিষ্কাশিত হতে পারে।

ভাষার উৎপত্তির প্রশ্ন নিয়ে ভারতীয় জ্ঞানমণ্ডলে উত্তপ্ত তর্ক ছিল। যাস্ক ব্যুৎপত্তিবিদ (নৈরুক্ত) সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই সম্প্রদায়ের প্রাথমিক বিশ্বাস হল, সমস্ত শব্দই মূল ধাতু থেকে উদ্ভূত। যদিও কখনও কখনও আমাদের মনে হতে পারে যে যাস্ক বৈয়াকরণদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাস করতেন কারণ তিনি অনুকরণের নীতিটিকে ভাষার একটি মৌলিক বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু আমাদের মনে হয় যাস্ক মধ্যম পন্থা বেছে নিয়েছিলেন যখন তিনি দাবি করেন যে অনুকরণ শুধুমাত্র পাখির নামেই পাওয়া যায়। দুদুম্ভি শব্দটিকে যাস্ক ব্যাখ্যা করেন অনুকরণতা দিয়ে—দুদুম্ভি: ইতি শব্দানুকরণম্। যাস্ক এই বিষয়ে ঔদম্বরায়নের চরম দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ধৃতি দিয়েছেন যেখানে তিনি ভাষার উৎপত্তিতে অনুকরণের ভূমিকাকে সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন। অন্যদিকে, প্লেটো ভাষা গঠনের ক্ষেত্রে অনুকরণকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আর ভারতে একজন প্রতিপক্ষ খুঁজে পান যিনিও এই ঘটনাটি গ্রহণ করেন, তিনি হলেন পাণিনি। কিন্তু যাস্ক বলেন, ভাষার ভিত্তিতে অনুকরণ কোনও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে না। তিনি নিরুক্তের মূল তত্ত্বের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অনুগামী। যাস্ক বিশ্বাস করতেন যে ভাষায় কিছু শব্দ আছে যেগুলো নিছক প্রকৃতির শব্দের অনুকরণে গঠিত হয়। তবে ওই শব্দগুলি অন্যভাবেও উদ্ভূত হতে পারে।

ভারতীয় জ্ঞানের জগতে বৈয়াকরণ এবং দার্শনিক উভয়ই একইভাবে, শব্দের নিত্যতা বা চিরন্তনতার ধারণা নিয়ে তীব্র বিতর্ক করেন। কাত্যায়ন পাণিনির একটি ভাষ্যে দুটি বিপরীত চিন্তাধারার উল্লেখ করেছেন—নৈত্যশাব্দিক এবং কার্যশাব্দিক। উল্লেখ্য যে, এখানে শব্দ বলতে বাক্যের অন্তর্ভুক্ত শব্দ, আওয়াজ নামক শব্দ এবং ভাষাকেই বোঝানো হয়। পাণিনি এবং কাত্যায়ন বিশ্বাস করতেন যে শব্দগুলি নিত্য প্রকৃতির। এ বিষয়ে যাস্ক ঔদম্বরায়ণকে উদ্ধৃত করে বিপরীত মত পোষণ করেছিলেন। তিনি বলেন, শব্দগুলিকে প্রকৃতিতে ক্ষণস্থায়ী হিসাবে বিবেচনা করা হয়, অর্থাৎ, যতক্ষণ সেগুলি উচ্চারিত হয় ততক্ষণ তারা স্থায়ী হয়—ইন্দ্রিয়নিত্যম্ বচনৌদম্বরায়ণঃ। কিন্তু যাস্ক শব্দের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। তিনি দাবি করেন যে শব্দকে নিত্য বিবেচনা না করে শব্দের চতুর্বিধ বিভাজন (বৈখারী, মধ্যম, পশ্যন্তী এবং পরা) করা কঠিন। তৈত্তিরীয় অনুসারীরাও একই মত পোষণ করেন যে, যা লোপ তাই বিনাশ।

একটি মতে, পদকে অর্থপূর্ণ ধ্বনি বলে নির্দেশ করা হয়। বর্ণের গোষ্ঠীকে পদ হিসাবেও বর্ণনা করা হয়েছে কোনও কোনও শাস্ত্রে। এই ধরনের সংজ্ঞাগুলি যাস্ক নিরুক্তে তালিকাভুক্ত করেন। যাস্ক তাঁর শব্দকে বা পদকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন--নাম (বিশেষ্য), অখ্যাত (ক্রিয়া), উপসর্গ এবং নিপাত।