অমৃতকথা—১০

যাস্কের নিরুক্ত হল ব্যুৎপত্তির উপর খুবই বিখ্যাত কাজ। এটি সম্ভবত এই বিষয়ে প্রথম কাজ এবং নিরুক্তকে একটি পৃথক বৈজ্ঞানিক বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা যায়। তৈত্তিরীয় উপনিষদে নিরুক্ত ছয়টি বেদাঙ্গের মধ্যে চতুর্থ হিসাবে তালিকাভুক্ত। নিরুক্ত অবশ্য নিজে একটি স্বাধীন গ্রন্থ নয়, এটি যাস্কের পূর্ববর্তী কাজ নিঘণ্টুর একটি ভাষ্য। নিঘণ্টু হল বৈদিক শব্দের শ্রেণিবদ্ধ তালিকার একটি সংকলন।

এই নিঘণ্টু পাঁচটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়কে বলা হয় নৈঘণ্টুক কাণ্ড। এই তিন অধ্যায় সমার্থক শব্দ নিয়ে আলোচনা করে এবং এগুলিতে ১৩৪১টি শব্দ রয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়কে নৈগম কাণ্ড বলা হয়, এই অধ্যায়ে সমজাতীয় বহু শব্দ রয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে ২৭৮টি শব্দ রয়েছে। পঞ্চম অধ্যায় হল দৈবত কাণ্ড, যা দেবতাদের নাম নিয়ে আলোচনা করে। দৈবত কাণ্ডে ১৫টি শব্দ আছে। নৈঘণ্টুক কাণ্ডের তিনটি অধ্যায়ের মধ্যে প্রথমটি ভৌত বস্তু যেমন পৃথিবী, জল এবং প্রকৃতির নানা বস্তু যেমন মেঘ, ভোর, দিন এবং রাত নিয়ে আলোচনা করে। নৈঘণ্টুক কাণ্ডের দ্বিতীয় অধ্যায়টি মানুষের এবং নরনারীর শারীরস্থান যেমন বাহু, অঙ্গ, আঙুল নিয়ে আলোচনা করে, সেই সঙ্গে নৈঘণ্টুক মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন গুণাবলি যেমন সম্পদ, ক্রোধ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। তৃতীয় এবং শেষ নৈঘণ্টুক অধ্যায়টি গুরুত্ব বা লঘুত্বের মতো বিমূর্ত গুণাবলি নিয়ে আলোচনা করে।

মহাকাব্যের কিছু অংশ নিরুক্ত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। সূর্যবংশের কুলগুরু বশিষ্ঠ মুনি ছিলেন অসুরগুরু শুক্রাচার্যের রাজনীতির উত্তরসাধক। স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের যে বিপুল ঐশ্বর্য তা দেবতারা দাবি করলে অসুরদের সঙ্গে দেবতাদের বিরোধ বাধে। দেবতারা বৃহস্পতিকে (যাঁর ক্ষেত্রজ পুত্র বুধ—যিনি চন্দ্রবংশের প্রথম পুরুষ) এবং অসুররা শুক্রাচার্যকে গুরুর পদে বরণ করেন। এই দুই গুরুর মধ্যে তীব্র বিরোধ ছিল—তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উভয় ক্ষেত্রেই। তাত্ত্বিক দিক থেকে বিরোধ হল, বৃহস্পতি অর্থনীতি ও রাজনীতিশাস্ত্রকে পৃথক বা স্বতন্ত্র বলে মানতেন। মহাভারতের রাজনীতি যেহেতু নীতিশাস্ত্র থেকে পৃথক নয়, তাই বৃহস্পতির অর্থনীতি নৈতিকতাশূন্য। কল্যাণমূলক অর্থনীতির যে ধারণা আমরা ইদানীং পাই এবং প্লেটোর ডায়ালগসমূহে পেয়েছি, তা থেকে বৃহস্পতি সম্পূর্ণ অন্য ধারার মত পোষণ করতেন। অন্য দিকে শুক্রাচার্যের অর্থনীতি নৈতিকতাসম্পন্ন। অসুররা ছিলেন প্রাকৃতিক শক্তির পূজারি। অপর দিকে দেবতারা দুর্ধর্ষ যুদ্ধবাজ এবং সম্পদ কুক্ষিগত করার নেশায় আচ্ছন্ন। বেদে রয়েছে, অসুররা উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিলেন। অসুররা ছিলেন যৌথ মালিকানার পক্ষে। সূর্যংশীয়রাও তাই। কিন্তু দেবতারা বা অধ্যাত্মবাদীরা কিংবা ক্ষেত্রজ পুত্ররা কেউই যৌথ মালিকানায় বিশ্বাসী ছিলেন না।

যৌথ মালিকানার এই ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন ইক্ষ্বাকু তথা সূর্যবংশীয় সমস্ত রাজা। তাঁদের গুরু বশিষ্ঠও ছিলেন এই রাজনীতির অন্যতম পুরোধা। যদিও চন্দ্রবংশীয় দেবব্রত-ভীষ্ম শাস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন মহর্ষি বশিষ্ঠের কাছ থেকে, কিন্তু তিনি যেহেতু চন্দ্রবংশীয় তাই তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি এবং পরবর্তী সময়ে যাতে চন্দ্রবংশ থেমে যায়, সেই জন্য আজীবন ব্রহ্মচারী থাকার শপথ নেন। বিমাতা সত্যবতীর অনুরোধে বৈমাত্র ভ্রাতার বধূদের গর্ভে নিয়োগ প্রথায় সন্তান উৎপাদনে সম্মত হননি। তখন সত্যবতী আহ্বান করেন তাঁর কানীনপুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকে। এই বেদব্যাস বশিষ্ঠ মুনির বংশধর, তিনি অদৃশ্যন্তী-শক্ত্রির পৌত্র এবং মৎস্যগন্ধা-পরাশরের পুত্র।

‘বশিষ্ঠ’ শব্দের অর্থ অতিশয় বশী। তাঁর স্ত্রীর নাম অরুন্ধতী—‘অরুন্ধতী’ শব্দের অর্থ হল, যাকে রুদ্ধ করা যায় না। অরুন্ধতীর আর এক অর্থ জিহ্বা। এই দুই পরস্পরবিরোধী প্রত্যয় থেকে আসে শক্তি। তাঁদের পুত্র শক্ত্রির নামের তাৎপর্য এমনই। বশিষ্ঠের ছিল এক কামধেনু, যার নাম নন্দিনী। ‘নন্দিনী’ মানে আনন্দয়িত্রী, সে সুরভিকন্যা। নন্দিনীর কাছ থেকে চাইলেই পাওয়া যায় জীবনধারণের সব উপাদান—অন্নরাশি, ডাল, দই, ঘি, মিষ্টান্ন, মদ—এমনকি জামাকাপড়ও। বশিষ্ঠের যে সিস্টেম বা তন্ত্র, তাতে খাদ্য-বস্ত্রের জন্য মানুষকে কেবল নিজের শ্রমের উপর নির্ভর করতে হত না, যৌথ সমাজ তার ব্যবস্থা করত। একদা বিশ্বামিত্র এসে এই নন্দিনীকে নিজের, অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকানার অধীন করতে চান। বশিষ্ঠ তাতে সম্মত হননি। বিশ্বামিত্র তখন এই তন্ত্র ভেঙে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। কে এই বিশ্বামিত্র? তিনি গাধির পুত্র, তাই তাঁকে গাধেয় বলা হয়। গাধি হলেন রাজা কুশের পুত্র, যে কুশ পুরুবংশের রাজা। পুরু যযাতির পুত্র, যযাতির পূর্বপুরুষ যথাক্রমে পুরূরবা ও বুধ; অর্থাৎ বিশ্বামিত্র হলেন চন্দ্রবংশীয় রাজা। সেই বিশ্বামিত্র সূর্যবংশের কুলগুরু বশিষ্ঠের সঙ্গে বিরোধে মাতোয়ারা হলেন।