শান্তিপর্বের রাজকরণাধ্যায়ে বলা হয়েছে, সমাজে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হলে মানুষ পিতামহ ব্রহ্মার শরণ নেন। ব্রহ্মা মনুকে পৃথিবীর রাজপদ গ্রহণ করার আদেশ দেন। মনু প্রাথমিকভাবে গররাজি থাকলেও তিনি অবশেষে সেই ভার গ্রহণ করেন। মনুই পৃথিবীর আদি রাজা। রাজা না থাকলে সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আবার অকর্মণ্য ও অযোগ্য রাজার দ্বারাও শাসনকার্য চলতে পারে না। হস্তিনার রাজা তখন প্রতীপপুত্র শান্তনু। শান্তনুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দেবাপি বনে চলে গেলে শান্তনু হস্তিনার রাজা হন। তিনি গঙ্গার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। যিনি পাপহরণ করেন, দুঃখ বিনাশ করেন; সুখদাত্রী, মোক্ষদাত্রী, পরম গতি—তিনিই গঙ্গা। কলিযুগে অবতার হলেন কল্কি, শাসক হল ধনলোভী এবং বুদ্ধিজীবী শাস্ত্রহীন কিন্তু গঙ্গাই পরম তীর্থ। শান্তনুর সময়কাল অবশ্য দ্বাপর যুগে। পাশার যে দিকে দুটি বিন্দু থাকে তাকে বলে দ্বাপর। পাশার যে দিকে এক বিন্দু থাকে সেই পাশ হল কলি। পাশাকে যদি রাজনীতি বলা হয়, যে রাজনীতির পরম ভক্ত ছিলেন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির—তাহলে দেখা যাবে, দ্বাপরের রাজনীতি ছিল মিশ্র—সম্পত্তির যৌথ মালিকানার সঙ্গে তখন ধীরে ধীরে ব্যক্তিমালিকানার আবির্ভাব হচ্ছে। কলিতে অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরে যে যুগের সূচনা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ পারিবারিক/ব্যক্তিমালিকানার যুগ। অর্থনীতির এই জায়গা ঘিরে তখনকার রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে। এই খানে শান্তনুর দুই পত্নী—গঙ্গা ও মৎস্যগন্ধার ভূমিকা গুরুতর। গঙ্গা আদতে শুভ্র পণ্যপ্রবাহ, তা ধীরে ধীরে জ্যোৎস্নাবর্ণ থেকে চন্দন, তার পর আবার আস্তে আস্তে বর্ণহীন হতে শুরু করল। সেই স্থানে এল যমুনার প্রবাহ, এই যমুনায় খেয়া পারাপার করতেন মৎস্যগন্ধা, যিনি পারানির কড়ি নিতেন বলে তাঁর গায়ে ছিল আঁশটে গন্ধ। সমাজে তিনি ছিলেন নিন্দিত। মৎস্যগন্ধার গায়ে মৎস্য অর্থাৎ নিজস্ব মালিকানার গন্ধ ছিল। গঙ্গার ক্ষেত্রে যা ছিল না। সূর্যবংশের কুলগুরু বশিষ্ঠের যৌথ সম্পত্তি নন্দিনীকে চুরি করতে এসেছিলেন তেত্রিশ কোটি দেবতার যে আট কোটি বসু তাঁদের বাঁচাতে মর্ত্যে মানবী হিসাবে এসেছিলেন শুভ্র প্রবাহের গঙ্গা। ‘বসু’ শব্দের ধাতু ‘বস্’-এর একটি অর্থ হল অপহরণ।
ইক্ষাকুরা সূর্যবংশীয়। ইক্ষাকু বংশের একদা রাজা ছিলেন মহাভীষ। মহাভীষ ‘পুনর্জন্ম’ লাভ করেন চন্দ্রবংশীয় রাজা প্রতীপের ঔরসে, সুনন্দার গর্ভে। তাঁর নাম হয় ‘শান্তনু’। তিনি নষ্টপ্রায় বংশের রক্ষক ছিলেন বলে এই রকম নামকরণ—শান্তনু। শান্তনু যুবক হলে প্রতীপ তাঁকে জানান, একজন দিব্য রমণী আসবেন, কোনও পরিচয় না জানতে চেয়ে শান্তনু যেন তাঁকে বিবাহ করেন। এই কথা বলে প্রতীপ বাণপ্রস্থে চলে গেলেন। শান্তনু হস্তিনার রাজা হওয়ার পর এক সময় গঙ্গা তাঁর উদ্দেশ্য সফল করতে এলেন। শান্তনু তাঁকে স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলেন। অষ্টবসুর কথা ভাবতে ভাবতে শরীরিণী গঙ্গা প্রতীপপুত্রকে বললেন,
ভবিষ্যমি মহিপাল মহিষী তে বশানুগা।
যত্তু কুর্য্যামহং রাজন্ শুভং বা যদিবাশুভম্।
ন তদ্বারয়িতব্যাস্মি ন বক্তব্যা তথাপ্রিয়ম্।
-মহারাজ, আমি যা করব, ভালো হোক বা মন্দ, তুমি বাধা দেবে না এবং আমাকে কোনও অপ্রিয় কথা বলবে না। সেরূপ করলে তখনই তোমাকে ত্যাগ করব। তুমি এই শর্তে সম্মত হলে আমি তোমার মহিষী হতে রাজি আছি।
একে একে সাত পুত্রের জন্ম দিয়ে গঙ্গা তাদের জলে ডুবিয়ে হত্যা করলেন। শান্তনু চুক্তিবদ্ধ তাই কিছু বলতেন না কিন্তু দুঃখ-শোকে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। অষ্টম পুত্র জন্মানোর পর শান্তনু গঙ্গাকে বললেন, পুত্রঘাতিনী, তুমি কে, কেন এই মহাপাপ করছ? হে পুত্রঘ্নি, তোমার পাপের সীমা নেই। গঙ্গা জবাব দিলেন, তুমি পুত্র চাও অতএব এই পুত্রকে বধ করব না, কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি আর থাকব না। আমি বিদায় নিচ্ছি।
অহং গঙ্গা জহ্নুসুতা মহর্ষিগণসেবিতা।
দেবকার্য্যার্থ-সিদ্ধ্যর্থমুষিতাহং ত্বয়া সহ।
আমি মহর্ষিদের দ্বারা সেবিতা জাহ্নবী গঙ্গা। দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য তোমার সঙ্গে এতকাল বাস করেছি। গঙ্গা নিজের সম্যক পরিচয় দিলেন এবং বসুগণের কাহিনি সবিস্তারে বললেন। কী সেই কাহিনি?