সূর্যবংশের পুরোধা বশিষ্ঠদের যৌথ সম্পত্তি চুরি করেছিল অষ্টবসু। তাই তারা অভিশপ্ত হয়ে মর্ত্যে এসেছিল। গঙ্গা ছিলেন গর্ভধারিণী। আট জনের মধ্যে ‘দ্যু’ নামক বসুর অপরাধ ছিল সবচেয়ে বেশি, তাই সে বেশি দিন মর্ত্যে থাকবে। এই পুত্রকে গঙ্গার দান বলে মনে করবে। গঙ্গা নবজাতককে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্হিত হলেন। শান্তনু শোকাকুল হয়ে প্রাসাদের অভ্যন্তরে চলে গেলেন। কিন্তু জীবিত পুত্রকেও ‘রক্ষা’ করতে পারলেন না চন্দ্রবংশীয় রাজা শান্তনু। গঙ্গা শিশু দেবব্রতকে নিয়ে চলে গেলেন। খুবই আশ্চর্যের কথা হল, চন্দ্রবংশে জন্ম নেওয়া রাজপুত্র দেবব্রতকে রাজনীতির পাঠ দিলেন সুর্যবংশের কুলপুরোহিত বশিষ্ঠ মুনি। আর ব্রাহ্মণ পরশুরামের কাছে ক্ষত্রিয় দেবব্রত শিখলেন শাস্ত্রজ্ঞান।
রাজকুমারের শিক্ষা শেষ হওয়ার পর তাঁকে পিতার কাছে ফেরত দিচ্ছেন গঙ্গা।
মহেষ্বাসমিমং রাজন্ রাজধর্ম্মার্থকোবিদম্।
ময়া দত্তং নিজং পুত্রং বীরং বীর গৃহং নয়।
হে রাজন, মহাধনুর্ধর ও রাজধর্মার্থজ্ঞানী এই পুত্রটিকে তোমার হাতে দিচ্ছি। হে বীর, তোমার এই বীর পুত্রটিকে নিজ গৃহে নিয়ে যাও।
শান্তনু ফেরত পেলেন পুত্রকে। এরপর গঙ্গাকে আর দেখতে পাওয়া যায় না। সেই শুভ্র প্রবাহের জায়গায় এলেন কৃষ্ণ জলপ্রবাহের বা পণ্যপ্রবাহের খেয়ানি মৎস্যগন্ধা। তার পিছনে ছিল বশিষ্ঠের রাজনীতি। বশিষ্ঠের পৌত্র পরাশরের নিয়মিত যাতায়াত ছিল হস্তিনায়। হস্তিনায় এই সময় বিপত্নীক শান্তনু রাজত্ব করছেন, রয়েছেন যুবরাজ দেবব্রত যিনি গঙ্গাপুত্র। এমন সময় পরাশর বা পরপরিশ্রমজীবী অর্থাৎ মেধাজীবী গাঁটছড়া বাঁধলেন হস্তিনারই এক শূদ্রকন্যা মৎস্যগন্ধার সঙ্গে। তাঁর শূদ্রত্বের ক্ষত্রিয়করণ করা হল, যেমন অম্বষ্ঠ পরাশরের ব্রাহ্মণ্যকরণ হয়েছিল। তাঁকে শোনানো হল অলৌকিক উপাখ্যান।
পুরুবংশজাত উপরিচর বসু চেদি দেশের রাজা ছিলেন। তাঁর পত্নীর নাম গিরিকা। গিরিকা ছিলেন কোলাহল পর্বত ও শুক্তিমতী নদীর কন্যা। স্ত্রীযোনিই শুক্তির উৎপত্তিস্থান। রাজধানীর পাশেই পাশেই ছিল শুক্তিমতীর প্রবাহ বা পল্লী। কোলাহলের ‘হল্’ ধাতুর অর্থ হল কর্ষণ। ‘কোল’ মানে হল সংঘাত বা aggregate। এক কথায়, ‘কোল’ হল সাধারণ জনগণ যারা কর্ষণের জন্য মুখিয়ে থাকে। তারাই যায় শুক্তিমতীর কাছে। এমনই এক মিলনে উৎপন্ন এক পুত্র ও এক কন্যাকে উপরিচর প্রাসাদে আনেন। ছেলেটি হয় সেনাপতি, মেয়েটি ভার্যা। ওই কন্যার নাম গিরিকা। একবার মৃগয়ায় গিয়ে পত্নীকে স্মরণ করে উপরিচর বসুর শুক্র স্খলন হয়। সেই স্খলিত শুক্র এক শ্যেনপক্ষী পত্রপুটে নিয়ে উড়ে যায়। পথে অন্য আর একটি শ্যেনপক্ষীর আক্রমণে শুক্র যমুনার কৃষ্ণবর্ণ জলে পতিত হয়। যমুনার জলে বাস করত এক মৎসী যে ছিল ব্রহ্মশাপগ্রস্থ অপ্সরা অদ্রিকা। অপ্সরা বা স্বর্গবেশ্যা অদ্রিকা গর্ভবতী হয়। দশম মাসে ওই মৎস্যরূপী অপ্সরা ধীবরের জালে ধরা পড়লে তার পেট চিরে একটি পুত্র ও এক কন্যা পাওয়া যায়। পুত্রটিকে উপরিচর বসু গ্রহণ করলেও কন্যাটিকে ধীবরের কাছে রেখে চলে যান। পুত্রের নাম মৎস্য আর কন্যাটি মৎস্যগন্ধা। এই মৎস্যগন্ধা বা ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্গাতাদের সঙ্গে পরাশরের মিলন হল।
পরাশর-মৎস্যগন্ধার মিলন ছিল একেবারেই রাজনৈতিক। মৎস্যগন্ধা ধীবর দাসরাজের কাছে লালিত পালিত হয়। সে পিতার কাজে সাহায্য করত। যমুনায় খেয়া পারাপার করে পারানির কড়ি নিত তখনকার যুগে যা ছিল নিন্দিত। পরাশর বা মেধাজীবী অর্থাৎ আধুনিক পরিভাষায় বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে কুয়াশাঘেরা দ্বীপে মিলন হল তাঁদের। চুক্তিও হল। সেই চুক্তির বলে পরাশর পেলেন একটি পুত্র, মৎস্যগন্ধার কৌমার্য অটুট থাকলো এবং তাঁর গায়ের আঁশটে ও নিন্দিত গন্ধ পালটে গিয়ে হল পদ্মগন্ধ। মৎস্যগন্ধা সমাজে নন্দিত হলেন। ব্যক্তিমালিকানার পক্ষে পরাশরের এই সিলমোহর মৎস্যগন্ধাকে সত্যবতী করে তুলে সোজা হস্তিনার রাজপ্রাসাদে ঢুকিয়ে দিল। বিপত্নীক শান্তনুর পুত্র দেবব্রত এর ফলে ব্রহ্মচারী হলেন, তাঁর কোনও সন্তান হবে না এবং বসু দেবব্রতকে সিংহাসনের দাবি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হল। শান্তনুর বংশ উৎপন্ন হল সত্যবতীর গর্ভে—চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য।