অমৃতকথা—১৪

শান্তনুর দ্বিতীয় পক্ষের দুই পুত্র চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য মহাভারতের যুগসন্ধিক্ষণের দুই পুরুষ। অর্থনৈতিক ধারণা বদলের সঙ্গে সঙ্গে তখন রাজনীতির ধারণা আমূল বদলে যাচ্ছে। রাজনিয়োগে প্রজাসাধারণের অধিকারের কথা মহাভারতে থাকলেও সব সময় তা যে মানা হত, এমন নয়। প্রাসাদের রাজনীতি-মহলে যে আন্দোলন চলত তার ভিত্তিতেই রাজা নিয়োগ হত। প্রাসাদের রাজনীতির সর্বময় কর্ত্রী ছিলেন মৎস্যগন্ধা ওরফে সত্যবতী। শান্তনু গত হয়েছেন। চিত্রাঙ্গদ বালক ও বিচিত্রবীর্য গর্ভে। প্রজাদের একটা বড় অংশ দেবব্রতকে রাজপদে দেখতে চাইলেও সত্যবতীর অনিচ্ছায় এবং দেবব্রতের প্রতিজ্ঞায় তা সম্ভব হয়ে উঠল না। আদর্শ শাসকের যে-সব গুণাবলির কথা মহাভারতের শান্তিপর্বে ভীষ্মের মুখে উচ্চারিত হয়েছে, তা বালক চিত্রাঙ্গদের ছিল না, থাকাটা স্বাভাবিকও ছিল না। আদর্শ শাসকের গুণাবলির কথা পরে আলোচনা করা হবে। চিত্রাঙ্গদের প্রসঙ্গে আসা যাক

সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ চিত্রাঙ্গদকে হস্তিনার সিংহাসনে বসান হল বেশ অল্প বয়সেই। তিনি ছিলেন বলদর্পিত পুরুষ। সেই অহংকার তার কাল হল। তিনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ বীর ভাবতেন। চিত্রাঙ্গ হল শবলদেহ। চিত্রাঙ্গ দান করেন যিনি তিনিই চিত্রাঙ্গদ। শবল হল কর্ব্বুর বা বিচিত্র। আর একটু শক্ত ভাষায় বললে, শবল মানে অনন্তরবৃত্ত্যুপাত্ত—অর্থাৎ ব্রাহ্মণের ক্ষত্রিয়বৃত্তিতে, ক্ষত্রিয়ের বৈশ্যবৃত্তিতে ও বৈশ্যের শূদ্রবৃত্তিতে অর্জিত ধন হল শবল। ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণ্যবৃত্তিতে, ক্ষত্রিয়ের ক্ষত্রিয়বৃত্তিতে, বৈশ্যের বৈশ্যবৃত্তিতে এবং শূদ্রের শূদ্রবৃত্তিতে অর্জিত ধন হল শুভ্র। কিন্তু শূদ্রের অন্য বৃত্তিতে অর্জিত ধন বা বৈশ্যের ক্ষত্রিয়বৃত্তিতে কিংবা ব্রাহ্মণ্যবৃত্তিতে উপার্জিত অর্থ, ক্ষত্রিয়ের ব্রাহ্মণ্যবৃত্তিতে অর্জিত অর্থ হল কৃষ্ণ ধন। ‘শবল’ হল শুভ্র ও কৃষ্ণের মধ্যবর্তী অর্থাৎ ধূসর অর্থ। রাষ্ট্র তাকে মান্যতা দিলে তা শুভ্র হবে নচেৎ কৃষ্ণ ধন হিসাবে নিষিদ্ধ হবে। চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য দুই ভাইয়ের পিতা ক্ষত্রিয় শান্তনু কিন্তু মাতা দাশরাজকন্যা অর্থাৎ শূদ্রকন্যা। উপরিচর বসুর উপাখ্যান পরে সংযোজিত হয়েছে। অনুলোম বিবাহের নিয়মানুযায়ী ক্ষত্রিয়-শূদ্রার মিলনে উৎপন্ন পুত্র হবে উগ্র, যার পেশা হল গর্তের প্রাণি মেরে বেড়ানো। এই হল মনুর রাজনৈতিক-সামাজিক নিয়ম। কিন্তু যেহেতু পরাশরের পূর্বতন স্ত্রী (গান্ধর্বমতে বিবাহ হয়েছিল) সত্যবতী মনুর নিয়মানুযায়ী পুনর্ভু হতে পারেন না, ফলে শান্তনুর সঙ্গে গন্ধকালী বা সত্যবতীর বিবাহকালে মনুর এই নিয়ম পরাশর বদলে ফেলেন। তিনি জানালেন, ‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ/পঞ্চস্বাপৎসু নারীনাং পতিরণ্যে বিধীয়তে।’ তৃতীয় যুক্তির নিরিখে সত্যবতী পরাশরকে বাদ দিয়ে শান্তনুর পাণিগ্রহণ করেছেন। ঠিক একই নিয়মে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের উগ্র থেকে ক্ষত্রিয়করণ করা হল মুখ্যত দুটি উপায়ে। এক, উপরিচর বসু ও স্বর্গবেশ্যা অদ্রিকার অলৌকিক উপাখ্যান এনে এবং দ্বিতীয়ত সংকর জাতি থেকে চতুর্বর্ণে ফিরিয়ে আনা-রূপ পরাশর-সংহিতার বলে।

এতে করে গন্ধর্ব পুরুষরা বেজায় চটে গেলেন। তাদের বার্তা বা অর্থনীতি এবং দণ্ডনীতি বা রাজনীতি কিঞ্চিৎ ভিন্ন। গন্ধর্বরা হলেন দেবযোনিবিশেষ। লিঙ্গ মানে হল জ্ঞানসাধন হেতু, পক্ষান্তরে যোনি হল উৎপত্তিস্থান। আধুনিক পরিভাষায়, যোনি যদি হার্ডওয়্যার হয় তাহলে লিঙ্গ হল সফটওয়্যার। এ প্রসঙ্গে অমৃতলিঙ্গম্ব্রহ্মযোনির কথা ভাবা যেতে পারে। গন্ধর্ব চিত্রাঙ্গদ হত্যা করেন গন্ধকালীপুত্র চিত্রাঙ্গদকে। কী ছিল হত্যার কারণ? গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদ গন্ধকালীজ চিত্রাঙ্গদকে বললেন, তোমার আমার একই নাম; হয় তুমি অন্য নাম নাও অথবা আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো। কুরুক্ষেত্রের হিরণ্মতী নদীর তীরে তাঁদের যুদ্ধ শুরু হল। কেন নদীর নাম হিরণ্মতী? সে স্বর্ণময়ী, তার উপর ভাসে পণ্যের তরণী এবং সে চন্দ্রানুগত—অন্যের শ্রমে ভাস্বর। রাহুর কিরণে হিরণ-কিরণ শেষ হবে ভেবে গন্ধর্বরাজ ও গন্ধকালীজের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে নিহত হন শান্তনুপুত্র। মনে রাখতে হবে, পুঁজির প্রশ্নে শান্তনু ও সত্যবতীর পুত্র গন্ধর্বরাজের প্রতিযোগী হয়ে উঠেছিলেন। গন্ধর্বদের মতো যক্ষরাও দেবযোনিবিশেষ। বিচিত্রবীর্য অগ্রজের প্রদর্শিত পথে হেঁটেছিলেন, তা তার নাম ও কর্ম অনুধাবন করলেই বোঝা যায়।