অমৃতকথা—১৬

মহাভারত বলছে, শাসক বসন্তসূর্যের মতো হবেন। রাজা হবেন আসক্তিবিহীন অর্থাৎ সকল প্রকার ব্যসন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবেন। গর্ভিণী যেমন গর্ভস্থ সন্তানের মঙ্গলের জন্য নিজের প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে কুণ্ঠিত হয় না, রাজাও সে রকম জনগণের হিতসাধনকে নিজের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করবেন। কোনও অবস্থাতে শাসক ধৈর্যহীন হবেন না। প্রজাদের মঙ্গলের জন্য শাসক প্রিয় বস্তুকে বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠা বোধ করবেন না। সগর রাজা জনগণের মঙ্গলের নিমিত্ত জ্যেষ্ঠ পুত্র অসমঞ্জকে পরিত্যাগ করেন। অসমঞ্জ অত্যন্ত দুর্বিনীত ও নিষ্ঠুর ছিলেন। প্রজাদের উপর অত্যাচার করতেন বলে সগর রাজা তাঁকে ত্যাগ করে রাজ্যের বাইরে নির্বাসন দেন। শাসক চাতুর্বর্ণ্যধর্ম রক্ষা করবেন। অর্থাৎ কৃষ্ণ ধন, শুভ্র ধনের তফাত করবেন। ধর্মসঙ্কর ও বর্ণসঙ্কর থেকে প্রজাদের রক্ষা করা তাঁর কর্তব্য। মর্মার্থ, কালো ধন ও সাদা ধন যেন মিশ্রিত না হয়ে যায়। কৃষ্ণ ধনের উপার্জনকারীদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন রাজা। এই শাসক হবেন শিক্ষিত, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন এবং তিনি হবেন প্রজারঞ্জক।
অনন্তর ব্যাসদেব ক্ষত্রধর্মের গুরুত্ব বিষয়ে রাজমাতা সত্যবতী ও ব্রহ্মচারী দেবব্রত-ভীষ্মকে অবহিত করলেন। ক্ষত্রিয় বীরেরা প্রজাদের রক্ষা করবেন। বহির্শত্রুর আক্রমণে তাঁরা যেমন রাজ্যকে প্রতিরক্ষা দেবেন, তেমনই রাজ্যস্থিত জনগণকে রাজ্যের অভ্যন্তরে সুরক্ষা দেবেন। সময়ানুবর্তিতা শাসকের অন্যতম প্রধান গুণ। সাম, দান, ভেদ ও দণ্ডনীতির প্রয়োগে শাসকের কালজ্ঞ থাকা প্রয়োজন। অনার্যকর্মবর্জন, প্রজাপালন তাঁর অবশ্য কর্তব্য। ‘অনার্যকর্ম’ বলতে এখানে হেয়, নীচ কাজকে বোঝায়। রাজা হবেন বিশ্বস্ত, তিনি কথা দিয়ে কথা রাখবেন। প্রিয়বাদিতা, জিতেন্দ্রিয়তা গুণের পাশাপাশি তাঁর শাস্ত্রাভ্যাস থাকবে। ‘শাস্ত্র’ বলতে চার বিদ্যা বুঝতে হবে—ত্রয়ী, বার্তা, দণ্ডনীতি ও আন্বীক্ষিকী। 
সত্যবতী পুত্র কৃষ্ণ দ্বৈপায়নকে বললেন, হস্তিনা রাজ্যের রাজাই নেই। এখন কী উপায়ে শাসক নির্বাচন করা যায়, সে বিষয়ে তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাই।
সত্যবতীর ‘কানীন’ পুত্র ব্যাসদেব উত্তর দিলেন, বিধবা পুত্রবধূদের গর্ভে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ বা উপযুক্ত ক্ষত্রিয়ের দ্বারা, প্রয়োজনে অর্থ দিয়ে, পুত্র উৎপাদন করে তাঁকে শাসক নির্বাচিত করুন। চন্দ্রবংশীয় রাজাদের ক্ষেত্রে এমন সময়ে এই বিধানই প্রচলিত। 
ইতঃপূর্বে সত্যবতী চন্দ্রবংশীয় রাজা শান্তনুর পুত্র, গঙ্গাতনয় ভীষ্মকে বিধবা ভ্রাতাজায়াদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে বললে ভীষ্ম তাঁর ভীষণ প্রতিজ্ঞার কথা উল্লেখ করে সম্মত হননি। সত্যবতী সুর্যবংশের কুলপুরোহিত বশিষ্ঠের বংশধর ব্যাসদেবকে চন্দ্রবংশীয় বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে পুত্র উৎপাদন করতে অনুরোধ জানালেন। ব্যাসদেব বললেন, ক্ষেত্র বা কন্যাদের মন প্রস্তুত করতে সময় দিন, নইলে প্রকৃত শাসক ওই গর্ভসমূহ থেকে উৎপন্ন হবে না।
সত্যবতীর বিলম্ব সইল না। ক্ষেত্রের আবার মন কি! তিনি পুত্র ব্যাসদেবকে শীঘ্রই এই কাজে ব্রতী হতে বললেন। ব্যাসদেব মায়ের আদেশ অমান্য করবেন না বলে নিভৃতে চলে গেলেন। 
ব্যাসদেব একাকী ভাবতে লাগলেন, তিনি ঋষি। তপস্বীর জ্ঞান, তপ, বৈরাগ্য এবং যোগ এই চারটি গুণ থাকে। হস্তিনার সিংহাসনের জন্য তাঁর গর্ভধারিণীর আসক্তি থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর কেন থাকবে! সূর্যবংশের কুলগুরুর বংশজাত ব্যাসদেবের রয়েছে বৈরাগ্য। তবু তাঁকে এমন এক শাসকের জন্ম দিতে হবে, যে শাসকের রয়েছে ষাড়্গুণ্য। সেই ছটি গুণ হল পররাষ্ট্রনীতির প্রয়োগ। সন্ধি, বিগ্রহ, যান, আসন, সংশ্রয় এবং দ্বৈধীভাব। সন্ধি হল সংযোগ, সম্মেলন—কোষভূমিপ্রদানহেতুক প্রণয়বন্ধ। বিগ্রহ হল বিস্তার, প্রসারণ; কখনও তা বিরোধ বা ভেদ—ত্যজত মানমলং বত বিগ্রহৈঃ। যান হল অভিযান। আসন হল স্থিতি বা মঙ্গলময় অবস্থান। শত্রুপীড়িত শাসকের প্রবলতর অন্য শাসকের আশ্রয়গ্রহণ হল সংশ্রয়। স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিজের সৈন্যদলের মধ্যে মেরূকরণ হল দ্বৈধীভাব। একজন ঋষির পক্ষে শাসক হওয়া সম্ভব নয়। রাজনীতির এমন আবর্তে তাঁর মতো জ্ঞানজীবীর থাকা শোভন নয়, কিন্তু হস্তিনার সিংহাসনে একজন রাজা দরকার যিনি আদর্শ শাসক হবেন। চন্দ্রবংশীয় রাজা বিচিত্রবীর্য, যিনি ব্যাসদেবের সহোদর কিন্তু বৈপিতৃক ভ্রাতা, তাঁর বিধবা বধূদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করলে কী হবে আগামী রাজনীতির অঙ্গন!