অমৃতকথা—১৯

কেমন হবে অন্ধ শাসকের রাষ্ট্র? সেই ধৃত রাষ্ট্র?

সেই কথাই জানালেন ব্যাসদেব তাঁর গর্ভধারিণী সত্যবতীকে। সত্যবতী বিমর্ষ হলেন। তাহলে এখন উপায় কী? এমন শাসক তো চলবে না তাঁর! অম্বিকাকে কি পুনরায় কর্ষণ করা সম্ভব? কন্যাকে আদেশ জানিয়ে সত্যবতী আবারও ব্যাসকে সেই ক্ষেত্রে গমন করতে বললেন। ব্যাসদেব অম্বিকার শয্যাগৃহে গিয়ে দেখলেন, সেখানে অম্বিকা অনুপস্থিত। অম্বিকা তাঁর ইচ্ছার বশে সেখানে আসেনি বটে, তবে এক সুন্দরী দাসীকে পাঠিয়েছে তারই শয্যায়। সেই দাসী অলঙ্কৃতা এবং সুসজ্জিতা। ব্যাসদেবকে বিচিত্রবীর্যের দাসী প্রীতিবশত সেবা করলেন।

রাজধর্মপ্রকরণে দাসীর অবস্থান কোথায়, ভাবছেন ঋষি বেদব্যাস। শুধু দাসী কেন, নারীদের কোনও রাজনৈতিক অধিকার নেই চন্দ্রবংশীয় রাষ্ট্রে। ব্যতিক্রম রাজমাতা সত্যবতী—তাঁর স্বামী নেই, দুই পুত্র মৃত। একমাত্র ‘কানীন’ পুত্র ব্যাসদেব বনবাসী। নারী বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন।

পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে।
পুত্রাশ্চ স্থাবিরে ভাবে ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।।

ক্ষত্রিয়-নারী যুদ্ধে অংশ নিতে পারবেন না। কারণ কী? নারী হলেন সর্বদোষের আকর। তাঁদের পাপপুণ্য, ধর্ম-অধর্ম জ্ঞান নেই। মানুষের চরিত্রে যত রকম দোষ থাকা সম্ভব, সে সবই নারীর চরিত্রে আছে। ভগবান বলেছেন, জন্মান্তরীয় পাপের ফলেই জীব স্ত্রীলোক হিসাবে জন্মগ্রহণ করে।

মাং হি পার্থব্যপাশ্রিতা যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ।
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যান্তি পরাং গতিম্।।

অতএব নারীকে রাজনীতিকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যাবে না। এখন যেমন মনে হচ্ছে, নারী সত্যবতী হস্তিনার রাজনীতি, রাজ্যপাট সব কিছু নিজের হাতে সামলাচ্ছেন, সত্যিই কি তাই? নাকি পরাশর ও ব্যাসদেব হস্তিনার রাজনীতির নিয়ামক?

প্রাসাদের যে সমস্ত দাসী তাঁরা একদা বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত, এখনও তাই। যেহেতু বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে ব্যাসদেব সন্তান উৎপাদন করবেন তাই ওই দাসীরা এখন ব্যাসদেবের অধীন—এতে বিচিত্রবীর্য্যস্য ক্ষেত্রে দ্বৈপায়নাদপি।

ব্যাসদেব সেই শূদ্রা দাসীর সঙ্গে সঙ্গম করতে করতে ভাবলেন—ক্ষেত্রত্বং দাস্যা অপি ইত্যনেনৈব গম্যতে কেচিৎ। সেই দাসী প্রীতিবশত কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের সঙ্গে সর্বপ্রকার রমণ করলেন। ব্যাস ভাবলেন, এর গর্ভে উপযুক্ত রাজনীতিজ্ঞ জন্মাবে কিন্তু সে হবে শূদ্রযোনিজ, ফলে তার রাজসিংহাসনে কোনও অধিকার থাকবে না।

রমণের পর অবশ্য ব্যাসদেব চিন্তা করে দেখলেন, এই যে কুরু বংশ যারা আদিতে ছিল পুরু বংশ, সেই বংশের প্রথম রাজা পুরু ছিলেন যযাতির পুত্র। ক্ষত্রিয় যযাতি বিবাহ করেছিলেন ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানীকে যা ছিল গর্হিত কারণ তা প্রতিলোম বিবাহ। দেবযানীর সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর দাসী শর্মিষ্ঠা। শর্মিষ্ঠার গর্ভে পুরু জন্মেছিলেন। শর্মিষ্ঠা অসুরকন্যা। পুরু ছিলেন দাসীপুত্র এবং মায়ের দিক থেকে তাঁর রক্তে মিশে ছিল অসুরশক্তি। দাসীপুত্র হওয়া সত্ত্বেও সে রাজা হতে পেরেছিল। কোন রাজনৈতিক কৌশলে পুরু রাজা হয়েছিলেন?

অম্বালিকাও যে ব্যাসদেবের রূপ সহ্য করতে পারবেন না, তা দিব্য দৃষ্টিতে পূর্বেই বুঝেছিলেন ঋষিপ্রবর। শয্যাগৃহে প্রবেশ করা মাত্র অম্বালিকা ভীতা পাণ্ডুবর্ণা হয়ে গেলেন। সত্যবতী অম্বিকার কথা স্মরণ করে অম্বালিকাকে চোখ বন্ধ করতে বারণ করেছিলেন। অম্বালিকা চোখ মেলে থাকলেও ভয়কে জয় করতে পারেননি। ব্যাসের রূপ দেখে তিনি ভয়ে ফ্যাকাশে রঙের হয়ে গিয়েছিলেন। রমণের শেষে ব্যাসদেব অম্বালিকাকে বললেন,

যস্মাৎ পাণ্ডুত্বমাপন্না বিরূপং প্রেক্ষ্য মামসি।
তস্মাদেষ সুতস্তে বৈ পাণ্ডুরেব ভবিষ্যতি।।

রাজমাতা সত্যবতী ব্যাসদেবের কাছ থেকে জানতে পারলেন, অম্বালিকার পুত্রটিও সুস্থ হয়ে জন্মাবে না, সে হবে পাণ্ডুবর্ণ। পাণ্ডু হল শ্বেতপীতমিশ্র বর্ণ। এই বর্ণ হরিণের হয়—ফ্যাকাশে রঙ। পাণ্ডূস্তু পীতভাগার্দ্ধঃ কেতকীধূলিসন্নিভঃ। পণ্ডিতেরা বলেন, পাণ্ডু হল শ্বেতবর্ণ। আবার পাণ্ডু এক রকমের রোগ—ন্যাবা, যাকে জন্ডিস বলা হয়। বাত, পিত্ত, কফ, সন্নিপাত ও মৃত্তিকাভক্ষণ এই পাঁচটি নিদান আছে ওই রোগের। পাণ্ডু সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হবেন, এমন কথাও বলতে লাগলেন বৈদ্যরা। এমন রুগিকে সিংহাসনে বসানো কতদূর শাস্ত্রসম্মত সে বিষয়ে সকলে সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগলেন।