অমৃতকথা—২০

পাণ্ডু সন্তান উৎপাদনে অক্ষম কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র শারীরিক ও মানসিকভাবে যথেষ্ট সবল, তার আর কোনও ব্যাধি বা আধি নেই। দূরদর্শী ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ।

রাজমাতা পড়লেন মহা ফাঁপরে। দুই পৌত্রের একটিও শারীরিকভাবে সিংহাসনের যোগ্য নয়, তাহলে হস্তিনার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হবে কে? ‘অম্বা’-র মতো ‘অম্বালিকা’-ও জন্মদাত্রী মাতার প্রতিশব্দ। সন্তানের অঙ্গবর্ধন করেন বলে তিনি অম্বালিকা। মজার কথা, ‘অম্বিকা’ শব্দ দিয়ে চক্ষু বোঝায় এবং ‘অম্বালিকা’ বোঝায় অঙ্গবর্ধনকারীকে অথচ তাঁদের সন্তানরা যথাক্রমে চক্ষুহীন এবং রোগগ্রস্থ। অম্বষ্ঠপুত্র ব্যাসদেবের সঙ্গে অম্বিকা-অম্বালিকার এই মিলনও রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু কেন এমন হল?

এই রাজনৈতিক কৌশলের পেছনে আছে প্রাসাদের এক দাসীর সঙ্গে ব্যাসদেবের রমণের কাহিনি। সেই দাসী শূদ্রা। ঠিক যেমন মৎস্যগন্ধা অলৌকিক উপাখ্যানের পূর্বে শূদ্রকন্যা ছিলেন। অম্বিকাকে দ্বিতীয় বার সন্তান উৎপাদনের জন্য আহ্বান করা হল। ব্যাসদেব পুনরায় অম্বিকার শয্যাগৃহে প্রবেশ করলে অম্বিকাকে পান না। তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন একজন দাসীকে। সুসজ্জিতা সেই দাসীর সামীপ্য পেলেন ব্যাস এবং তাঁর সঙ্গে সঙ্গম করলেন। দাসী ঋষিপ্রবরকে সর্বপ্রকার রমণ দান করে তুষ্ট করেন। সেই মিলনের ফলে উৎপন্ন সন্তান হবে সুস্থ ও সবল। সে না হবে অন্ধ না পাণ্ডুবর্ণ। কিন্তু সে রাজত্ব পাবে না। কেন?

তৎকালীন রাজনীতি ও সমাজনীতি বলছে, দাসী হল প্রভুর ক্ষেত্র। দাসীদের নিজস্ব শরীরের অধিকার নেই। তাঁদের শরীর হল প্রভুর সম্পত্তি। গর্ভও প্রভুর। কিন্তু দাসীদের সন্তান বা ক্ষেত্রের ফসল ক্ষেত্রাধিপতির উত্তরাধিকারী নয়, যদিও সেই সন্তান প্রভুর বীর্যসম্ভূত।

দাসীর সর্ব প্রকার পরিচর্যায় তুষ্ট হয়ে ব্যাসদেব বললেন, পুরাণে এমন কাহিনি রয়েছে, যেখানে দাসীপুত্র রাজা হয়েছেন। এই যে কৌরব বংশ, যা পূর্বে ছিল পৌরব বংশ, সেই বংশের আদি পুরুষ ‘পুরু’ ছিলেন দাসীপুত্র এবং পুরুর মাতা দাসী শর্মিষ্ঠা ছিলেন অসুরকন্যা। কিন্তু শর্মিষ্ঠা যেহেতু রাজার কন্যা, ফলে তিনি ক্ষত্রিয়া, শূদ্রা নন। শর্মিষ্ঠার পুত্র পুরু যযাতির সিংহাসন পেয়েছিলেন তার মূলে ছিল অসুর ও দেবতাদের রাজনীতি।

অসুরগুরু শুক্র ছিলেন শিবের পরম অনুরক্ত। শুক্রের পিতা ভৃগু বিষ্ণুর বক্ষে পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন। দেবতা ও অসুরদের যুদ্ধের চলাকালীন শুক্র একবার কৈলাসে গেলেন শিবের অনুগ্রহ পেতে। সেই অবসরে দেবতারা অসুরদের আক্রমণ করে। অসুররা ছিলেন শুক্রাচার্যের মাতা কাব্যমাতার আশ্রয়ে। কাব্যমাতা যোগক্ষমতায় দেবতাদের নিদ্রার দেশে পাঠিয়ে দিলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্রকে করে দিলেন পঙ্গু। বিষ্ণু তখন ক্রুদ্ধ হয়ে সুদর্শন চক্র দিয়ে কাব্যমাতার মস্তক ছিন্ন করে দেন। ভৃগু প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বিষ্ণুকে মর্ত্যে সাত বার জন্মলাভ করার অভিশাপ দেন। নারীঘাতী হিসাবে বিষ্ণুকে তিরস্কার করার পর কমণ্ডলু থেকে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে স্ত্রী কাব্যমাতার প্রাণ ফিরিয়ে দেন ভৃগু মুনি। একদা শুক্রাচার্য দেবতাদের গুরু বৃহস্পতির পিতা অঙ্গিরার কাছে শিক্ষালাভ করতে গিয়ে লক্ষ্য করেন, অঙ্গিরা নিজের পুত্র বৃহস্পতির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। তখন তিনি ন্যায় বা যুক্তিবিদ্যার জনক গৌতমের কাছে গিয়ে শিক্ষালাভ করতে থাকেন। তাছাড়া শুক্রাচার্য শিবের শরীরে দীর্ঘকাল বাস করার ফলে শিবের তেজের অংশীদার হন এবং পার্বতীকে মাতা হিসাবে গ্রহণ করেন। শুক্রের জন্য অসুররা অজেয় হয়ে ওঠে। ওদিকে শুক্রের ব্রহ্মচর্য ও ধ্যান ভাঙার জন্য ইন্দ্র নিজের কন্যা জয়ন্তীকে পাঠিয়ে দেন। জয়ন্তীর গর্ভে দেবযানী জন্মলাভ করেন।

ক্ষত্রিয় যযাতির ঔরসে ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানীর গর্ভে যদু ও তুর্বসু জন্মলাভ করে। যদু ও তুর্বসু আসলে ইন্দ্রের দৌহিত্রীর পুত্রদ্বয় আবার তারা শুক্রাচার্যের দৌহিত্র। দাসী শর্মিষ্ঠার তিন পুত্র—অনু, দ্রুহ্যু ও পুরু। তাঁরা অসুররাজ বৃষপর্বার দৌহিত্র। যযাতির রাজত্ব কে পাবে, সেই নিয়ে দেবাসুরের দ্বন্দ্ব তুঙ্গে ওঠে। দেবতারা চেয়েছিলেন, যদু রাজা হোক—কিন্তু শেষমেশ যযাতি তাঁকে সিংহাসন দিলেন না। তুর্বসুকেও না। অনু, দ্রুহ্যুও বাদ পড়লেন। শুক্রাচার্য যেমন সঞ্জীবনী মন্ত্র জানতেন, তেমনি পুরু জানতেন বৃদ্ধকে যৌবনদান করার মন্ত্র। সেই অর্থে, পুরু ছিলেন শুক্রাচার্যের যথার্থ অনুসারী। আবার তিনি অসুররাজ বৃষপর্বার নাতি। শেষ পর্ব