ইসরা মোহাম্মেদ জামালের গল্প

গাজার এক গৃহবধূর জীবনের একদিন

[মাটিতে পা রাখুন এবং উড়তে চেষ্টা করবেন না : আপনি ফিলিস্তিনে আছেন]

আমার সন্তানেরা
সময় সকাল ছ’টা। আমি বিছানা ছেড়ে উঠি এবং নামাজ আদায় করি। আমি শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ, আমার স্বামী ও আমাদের পাঁচ সন্তানের সঙ্গে থাকি। আমাদের চার মেয়ে (এগারো বছরের রাওয়া, নয় বছরে রাহাফ, সাত বছরের মারাম ও দুই বছরের আসমা) এবং এক ছেলে (মাহমুদ, তার বয়স পাঁচ বছর)। মাহমুদ ওর ফুপুর সঙ্গে ঘুমায় এবং জেগে ওঠার পর সে প্রাণবন্ত থাকে। এছাড়া সে তার দাদির সঙ্গে একসাথে দুধ পান করতে ভালোবাসে। স্কুলের পোশাক পরার সময় আমি তাকে সাহায্য করি। তারপর সে ভ্যানের কাছে যায়। শুক্রবার ছাড়া সে প্রতিদিন ভ্যানে চড়ে কিন্ডারগার্টেনে যায়।
সকাল সাতটায় আমি বাকি সবার জন্য চা বানাই এবং নাশতা তৈরি করি। নাশতা খাওয়ার সময় আমরা দিনের কর্মসূচি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি। সাধারণত আমরা ফালাফেল*, হুমমুস**, টম্যাটো, আলু এবং অলিভ দিয়ে নাশতা করি। নাশতা খাওয়া শেষ হলে আমি ময়লা বাসনপত্র পরিষ্কার করি। নাশতা খেয়ে আমার স্বামী কাজের জন্য অফিসে চলে যান। তিনি একজন স্থপতি-ইঞ্জিনিয়ার।
আমাদের বড় মেয়েরা, অর্থাৎ রাওয়া, রাহাফ এবং মারাম, প্রতিদিন কোরান পড়া শেখে। তাই ওরা সকালবেলা এক ঘণ্টার জন্য মসজিদে যায়। সেই সময় আমি শাশুড়িকে গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করি এবং ফাঁকে আসমার সঙ্গে খেলি। যখন রাওয়া, রাহাফ এবং মারাম মসজিদ থেকে ফিরে আসে, তখন ওদের জিজ্ঞেস করি ওরা কোরান শরিফের কোন আয়াত মুখস্থ করেছে। এছাড়া সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমি ওদের উৎসাহিত করি।

দুপুর
ভীষণ উৎসাহ নিয়ে মাহমুদ কিন্ডারগার্টেন থেকে ফিরে আসে। দরজা খুলতেই সে কণ্ঠস্বর উপরে তুলে বলে, ‘আস্লামুআলাইইকুম!’ 
মাহমুদের অভিবাদনের ধরন দেখে আমরা সবাই হাসি। তাকে আলিঙ্গন এবং চুম্বন করি। তারপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করি সে ক্লাসে কী করেছে। সে আমাদের একটা সারসংক্ষেপ দেয়, সাধারণত সে একটা নতুন গান বা কিছু নতুন শব্দ শেখে।
শাশুড়িকে আমি দুপুরের খাবার তৈরি করার কাজে সাহায্য করি। একসময় আমরা খাবার খাই এবং গল্পগুজব করে খাওয়া উপভোগ করি। আসমা এবং মাহমুদের মজার এবং দুষ্টু আচরণ, যেমন সোফার চারদিকে দৌড়াদৌড়ি এবং টেবিলের নিচে লুকানো, আমাদের আলাপচারিতায় বিঘ্ন ঘটায়। খাওয়া শেষ হলে আমি টেবিল পরিষ্কার করি এবং ময়লা থালা-বাটি ধুয়েমুছে সাফ করি।

অপরাহ্ণ
আসমা এবং মাহমুদ দুপুরের খাওয়া শেষ করে টম ও জেরি অনুষ্ঠান দেখতে পছন্দ করে। তখন তাদের ঘুমানোর মোক্ষম সময়। আর তখনই আমি স্বস্তিতে নিশ্বাস নেওয়ার, বিশ্রাম করার এবং আমার জীবন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ পাই। 
আমি ভাবলাম : ‘কী আর করার আছে? আমার বাঁধাধরা নিয়মের পরিবর্তন এবং আমার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য আমি কী করতে পারি? একজন মা হিসেবে আমার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং আমার কাছে পরিবার মূল্যবান, কিন্তু আমার ভেতরে এমন কিছু লুকিয়ে আছে, যা আমাকে আরো বেশি কিছু করার জন্য অনুপ্রাণিত করে।
ফেইসবুকে আমি এক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখি। প্রতিষ্ঠানটি ছোটো প্রকল্পের জন্য অর্থকড়ির যোগান দেয়। আমি আমার বন্ধু ওয়াফাকে বিজ্ঞাপনটি পাঠাই এবং অনলাইনে তার সঙ্গে আলাপ করি।
আমি : ওয়াফা, আমাদের স্বনির্ভর নিজস্ব কাজ থাকা উচিত। চলো, অন্যদের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দেই এবং কোনো নারী প্রকল্প প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করি।
ওয়াফা : তোমার কী কোনো পরিকল্পনা আছে?
আমি : হ্যাঁ, আমি শিশুদের খেলাধুলা করার জন্য একটা জায়গা তৈরি করতে চাই। বাবা-মা অথবা অভিভাবকেরা বাচ্চাদেরকে আমাদের কাছে রেখে যাবে। আমরা যখন ওদের দেখাশোনা করব, তখন তারা যেকোনো জায়গায় যেতে পারবে। বাচ্চাদের পরিবারের লোকজন ফিরে আসা পর্যন্ত আমরা ওদের দেখভাল করব। 
ওয়াফা : তুমি কি ডেকেয়ার বুঝাচ্ছ?
আমি : ঠিক তা না। তবে যদি প্রাপ্তবয়স্ক লোকজন তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে পানীয় পান করতে চায় এবং ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে চায়, তাহলে আমরা তাদের জন্য জায়গার ব্যবস্থা করতে পারি। এছাড়া জায়গাটি আমরা মহিলাদের কাছে ভাড়া দিতে পারি, যদি তারা সেখানে ছেলেমেয়েদের জন্মদিন উদযাপন করতে চায়। তার কারণ আমাদের সমাজে মহিলারা উন্মুক্ত জায়গায় সেই ধরনের অনুষ্ঠান করতে পারে না। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। কেননা অনেক মহিলা আছেন, যারা তাদের পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে অনেক দূরে থাকেন। তাই যখন তারা বাইরে যান, তখন কারোর কাছে তাদের সন্তানদের রেখে যাওয়ার কোনো সহজ জায়গা বা ব্যবস্থা থাকে না। তাদের যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার স্বাধীনতা দেবে আমাদের জায়গা এবং এটা এমন একটা জায়গা হবে, যেখানে তারা বাড়ির বাইরে তাদের সন্তান ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে পারবে।
ওয়াফা : ওহো, তুমি সবকিছুই ভেবে রেখেছ দেখি! এসব ধারণা তুমি কোথায় পেয়েছ?
আমি : আমি যখন মিশরে আমার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, আমার ভাইয়ের স্ত্রী আমাকে এই ধরনের একটা জায়গার কথা বলেছেন। তিনি যখন বান্ধবীদের সঙ্গে গল্পস্বল্প করতে যান, তখন সেখানে তার ছেলেমেয়েদের রাখেন। সেই জায়গাটি শুধু বাচ্চাদের জন্য। তাই আমাদের জায়গাটি আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা দেবে।
ওয়াফা : বলে যাও!
আমি : আমরা বাচ্চাদের বাবা-মা এবং অভিভাবকদের জন্য সপ্তাহে একদিন আলাদা করে রাখতে পারি, যাতে তারা একসাথে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় উপভোগ করতে পারেন।
আমার মনে হয়েছে যে, আমি যেন সমস্ত স্বপ্ন নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছি এবং আমার সঙ্গে ওয়াফাও আছে। আমরা নিজেদেরকে সফল, স্বাধীন, স্বনির্ভর এবং শক্তিশালী নারী হিসেবে কল্পনা করেছি, এমনকি প্রচুর অর্থকড়িও উপার্জন করতে সক্ষম হয়েছি। ওয়াফা আমার এই ধারণাকে সমর্থন করেছে। এছাড়া আমাকে তহবিল সংগ্রহ করার জন্য আবেদন করতে উৎসাহিত করেছে, কিন্তু আমি চেয়েছি এসব বুদ্ধি প্রথমে আমার স্বামীর তরফ থেকে আসুক। তিনি খুব বুদ্ধিমান এবং একজন স্থপতি-ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তার কাজের কারণে তিনি অনেক ধরনের বুদ্ধি দিতে পারেন।

সাঁঝবেলা
রাওয়া, রাহাফ এবং মারাম স্কুল থেকে ফিরে আসে এবং তারা রাতের খাবার খায়। আমাদের চারপাশে আসমা এবং মাহমুদ খেলা করে। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ওদের হালকা ধরনের দুষ্টুমি উপভোগ করেন। রাত নয়টায় আমার স্বামী ঘরে ফেরেন। অন্যান্য দিনের তুলনায় সেদিন তাকে দেখে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছি, কেননা আমাদের সম্ভাব্য প্রকল্প নিয়ে আমি তার সঙ্গে আলাপ করতে চাই। আমরা একসঙ্গে রাতের আহার করি। তিনি ছেলেমেয়েদের দিনের কার্যকলাপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন এবং সবাই হাসাহাসির মধ্যদিয়ে নিজেদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা বর্ণনা করে।
সবাই বিছানায় চলে গেলে আমি আমার স্বামীকে বললাম, ‘আমার একটা চমৎকার পরিকল্পনা আছে, যা আমি আমার মনের মধ্যে সারা দেই লালন-পালন করেছি’ তিনি আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকান, যেন তিনি কোনো বিপদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি হাসলাম এবং তাকে পুরো ঘটনা বললাম। তিনি বললেন, তার মনে হয় কাজটা ভালোই হবে, কিন্তু প্রকল্পটি গাজায় সফল হবে না।
‘আমরা অত্যন্ত কঠিন পরিবেশে বাস করি,’ আমার স্বামী বললেন। ‘পরিবারের ভরণপোষণের জন্য মানুষের কাছে খুব কম পরিমাণে অর্থকড়ি আছে। এ ধরনের প্রকল্পের জন্য এটা উপযুক্ত সময় নয়।’ 
আমি কী এক বিষণ্নতা অনুভব করলাম! আমি আমার স্বামীকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু সব চেষ্টাই বৃথা গেছে। তারপর আমি সাবধানে ভাবলাম, আমার স্বামী আসলে কী বলেছে এবং আমি বুঝতে পারলাম যে, তিনি ঠিকই বলেছেন। গাজায় আমাদের দেহকে হত্যা করার আগে ইজরায়েলি অবরোধ আমাদের আত্মা এবং স্বপ্নকে হত্যা করে। এছাড়া অবরোধ আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ এটা আমাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যস্ত রাখে, যেমন আমাদের সন্তানদের খাওয়ানো-পড়ানোর কাজ।
আমি আমার স্বপ্নের ভেতর পালিয়ে বেড়াই এবং ভুলে যাই যে, আমি ফিলিস্তিনে আছি, মুক্ত এবং স্বাধীন রাষ্ট্রে নয়। কিন্তু আমাকে বাস্তববাদী হতে হবে এবং মানতে হবে যে, গাজায় আমাদের জন্য দিনে চার ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকে না। 
এসব হতাশাজনক চিন্তা-ভাবনা আমার মস্তিষ্কে বানভাসি ডেকে আনে। তারপরও আমি এক চিলতে আশা নিয়ে অপেক্ষায় আছি। হয়তো একদিন আমি অর্জন করার মতো একটা স্বপ্নের নাগাল পাব। পরিস্থিতির নায়ক বা শিকার হওয়া আমার নিজের পছন্দ।
এবং তারপর একটা কিছু যটে, যা সবকিছু অদলবদল করে দেয়। 
আশা কোনো সময় জানে না
পরদিন আমি খুব সকালে উঠি এবং ম্যাসেজে চোখ বুলাই। 
‘হেই ইসরা,’ একটা ম্যাসেজ এভাবে শুরু হয়েছে। তারপর ম্যাসেজে লিখেছে : ‘উই আর নট নাম্বার্স’-এ যোগদান করার জন্য আপনার প্রাথমিক অনুমোদন লাভের পরিপ্রেক্ষিতে আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাতে চাই। আমি শুধু প্যামের সঙ্গে কথা বলেছি এবং আপনি যে সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন, তাতে তিনি খুশি হয়েছেন। বৃহস্পতিবার বেলা একটায় ‘উই আর নট নাম্বার্স’ দলের সঙ্গে দেখা করার জন্য আপনার ইন্টারভিউর ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ 
ম্যাসেজটা এসেছে ইসাম আদওয়ানের কাছ থেকে। তিনি আমার অনুবাদ কোর্সের শিক্ষক ছিলেন এবং বর্তমানে ‘উই আর নট নাম্বার্স’-এর সমন্বয়কারী। তার কাছে আমি এক মাস আগে মেন্টরশিপ প্রোগ্রামের অংশগ্রহণ করার জন্য আবেদন হিসেবে আমার লেখার নমুনা পাঠিয়েছিলাম। আমার সেই মুহূর্তের অনুভূতি কোনো কিছুই প্রকাশ করতে পারবে না। তা ছিল অনেকটা ম্যাজিক কার্পেটের মতো, যা আমাকে উচ্চাকাক্সক্ষার আকাশে নিয়ে গেছে। আমার সফল জীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে আমি নিজেকে একজন বড় লেখক হিসেবে দেখেছি। অবশেষে আমি উন্নয়ন এবং অগ্রগতির একটি অসাধারণ উপায় খুঁজে পেয়েছি।
জীবন কখনো পুরোপুরি হতাশাপূর্ণ নয়। কখনো প্রতারিত হবে না। তার পরিবর্তে তুমি তোমার স্বপ্ন রাজ্যের এবং জীবনের নায়ক হও। 

পাদটীকা
* মধ্যপ্রাচ্যের জনপ্রিয় এবং স্বীকৃত নিরামিষভোজী ও ভেগান খাদ্য ফালাফেল। বুট (ছোলা) বা ফাভা শিম এবং মসলা দিয়ে তৈরি করা গোলাকৃতি বল বা প্যাটি, যা ডুবোতেলে ভাজতে হয়। 
** হুমমুস এক ধরনের ডিপ, স্প্রেড বা সুস্বাদু খাবার, যা চটকানো সেদ্ধ বুট, তাহিনি, লেবুর রস এবং রসুন একসঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করা হয়। এটি মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের জনপ্রিয় খাবার।