কর্মফল || খুশবন্ত সিং

খুশবন্ত সিং[খুশবন্ত সিং ভারতের বিখ্যাত রম্যলেখক ও ঔপন্যাসিক। তাঁর লেখা জনপ্রিয় বইগুলোর মধ্যে অন্যতম ট্রেন টু পাকিস্তানআই শ্যাল নট হিয়ার দ্য নাইটিঙ্গেল এবং দিল্লি। এছাড়াও তাঁর ননফিকশন দুইখণ্ডের রচনা, ‘অ্যা হিস্টরি অব দ্য শিখস’ ছাড়াও অনুবাদ, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে লেখা, উর্দু কবিতা সব মিলিয়ে তাঁর লেখার পরিমাণ অনেক। ২০০২ সালে পেঙ্গুইন থেকে তাঁর আত্মজীবনী ‘ট্রুথ, লাভ অ্যান্ড এ লিটল ম্যালিস’ প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত ভারতের পাঞ্চাবের হাদালিতে জন্মগ্রহণ এবং ৯৯ বছরে মৃত্যুবরণ করেন ২০১৪ সালের ২০ মার্চ। খুশবন্ত সিং তাঁর সোজাসাপটা কথাবার্তার জন্য অনেকবার সমালোচিত হয়েছেন। তিনি ১৯৭৪ সালে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ অর্জন করেন, কিন্তু অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানের প্রতিবাদে ১৯৮৪ সালে তা ফিরিয়ে দেন। ২০০৭ সালে খুশবন্ত পদ্মবিভূষণে সম্মানিত হন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানিয়ে কর্মফল গল্পটি প্রকাশ করা হলো।]

তিনি বিড়বিড় করে বলেন, এই দেশের সবকিছুর মতো তুমিও অদক্ষ, নোংরা আর উদাসীন। রেলস্টেশনের ফার্স্টক্লাস ওয়েটিং রুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্যার মোহনলাল নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকালেন। আয়নাটা অবশ্যই ভারতে তৈরি হয়েছে; পেছনের লাল অক্সাইড জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। আলোকপ্রবাহী কাঁচের উপরিভাগে লম্বা লম্বা দাগ পড়ে গেছে। আয়নার দিকে তাকিয়ে স্যার মোহনের হাসি পায়। তার হাসিতে করুণা আর পৃষ্ঠপোষকতার মিশেল।

আয়নাও স্যার মোহনের দিকে হাসি ফেরত দেয়।
আয়না বলে, তুমিও তো ব্যাটা সব সময় পরিপাটি থাকা লোক। সম্মানিত, দক্ষ এমন কী সুদর্শন। পরিপাটি করে ছাট দেয়া গোঁফ, সেভিল রো থেকে বানানো স্যুট, বোতামের ঘাটে সুগন্ধি ফুল, ওডিকলোনের সুগন্ধ, ট্যালকম পাউডার এবং সুগন্ধি সাবান– এগুলো তোমার সব সময়ের সঙ্গী। আরে ধাড়ী ব্যাটা তোমার সব কিছুই বেশ পরিপাটি।
সম্বিত ফিরে এলে স্যার মোহন হঠাৎ করেই ওখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে তার বেলিওল টাই বারবার ঠিক করে নিতে থাকেন এবং আয়নার দিকে বিদায়ী ইশারা ছুড়ে দেন।
এবার তিনি ঘড়ির দিকে তাকান। এখনও যথেষ্ট সময় আছে। দ্রুত একবার হয়ে যেতে পারে।
তিনি হাঁক ছাড়েন, কই হ্যায়!
তারের পর্দাঅলা দরজা ঠেলে সাদা ইউনিফর্ম পরা একজন বেয়ারার আসে।
স্যার মোহন আদেশ দেন, ছোট একটা। একটা বেতের চেয়ারে আরাম করে বসেন তিনি: পান করতে করতে স্মৃতিচারণে যুবে যাবেন। ওয়েটিং রুমের বাইরে স্যার মোহনলালের মালপত্র দেয়ালের গা ঘেঁষে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। তার স্ত্রী লসমি স্টিলের একটা ধূসর রঙের ট্রাঙ্কের ওপরে পান চিবাচ্ছেন আর খবরের কাগজ দিয়ে বাতাস নিচ্ছেন। খাটো চেহারার বেশ মোটাসোটা মহিলা তিনি। বয়স চল্লিশের কোঠার মাঝামাঝিতে।
লাল পাড়ের একটা সাদা শাড়ি পরে আছেন লসমি। শাড়ির চেহারা বেশ ময়লা জীর্ণ। নাকের এক পাশে জ্বলজ্বল করে ঝুলছে আংটার মতো হীরের নাক-ফুল। হাতে তার বেশ কয়েকটা সোনার চুড়ি। তিনি বেয়ারারের সঙ্গে মন খুলে কথা বলে যাচ্ছিলেন। এক সময় স্যার মোহন হাতের ইশারায় বেয়ারারকে ওখান থেকে সরে যেতে বললেন। বেয়ারার চলে যেতেই লসমি রেলের একজন কুলিকে ডাকলেন।
জিজ্ঞেস করলেন, মহিলাদের বসার জায়গা কোথায়?
প্ল্যাটফর্মের একদম শেষ মাথায়।
কুলি তার পাগড়ি ঠিক করে নিয়ে গদির মতো বানিয়ে ফেলল এবং স্টিলের ট্রাঙ্কটা মাথায় তুলে নিয়ে প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটা শুরু করল। মিসেস মোহললালও তার পিতলের টিফিন ক্যারিয়ারটা তুলে নিয়ে কুলির পিছে পিছে স্বচ্ছন্দ গতিতে হাঁটা শুরু করলেন। কিছুদূর এগিয়ে এক ফেরিঅলার কাছ থেকে তার পানের রূপোর কৌটোটা ভরে নিলেন। তারপর আবার কুলির নাগাল ধরলেন। কুলি ট্রাঙ্কটা নামিয়ে রাখার পরে তিনি ট্রাঙ্কের ওপরে বসলেন এবং কুলির সঙ্গে আরামে গল্প জুড়ে দিলেন।
এইসব লাইনে কি ট্রেনে খুব ভীড় থাকে?
আজকাল সব ট্রেনেই ভীড় থাকে। তবে আপনি মহিলাদের মধ্যে জায়গা পাবেন।
তাহলে খাওয়ার ঝামেলাটা আগে সেরে ফেলাই ভালো।
তিনি পিতলের টিফিন ক্যারিয়ারটা খুলে এক গোছা কুঁচকে যাওয়া চাপাতি এবং কয়েকটা আমের আচার বের করলেন। তার খাওয়ার সময় কুলি লোকটা মেঝেতে পাছা ঠেকিয়ে বসে সুরকির ওপরে আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি করতে লাগল।
কুলি জিজ্ঞেস করল, আপনি কি একাই যাচ্ছেন, দিদি?
না ভাই। আমার স্বামী আছেন। উনি ওয়েটিং রুমে আছেন। উনি ফার্স্টক্লাসে যাতায়াত করেন। উনি একজন উঁচু পদের কর্মকর্তা, ব্যারিস্টার। ট্রেনে তার সাথে বড় বড় অফিসারদের, ইংরেজদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। আর আমি তো মাত্র এক দেশি মহিলা। আমি ইংরেজি বুঝি না; তাদের কথাবার্তার অতসব মানে টানে বুঝি না। আমি মহিলাদের শ্রেণিতেই যাতায়াত করি।
লসমি তার সাথে বেশ আরমেই গল্পগুজব করতে লাগলেন। বাড়িতে কথা বলার মতো কেউ নেই। তার সঙ্গে কাটানোর মতো সময় তার স্বামীর নেই। বাড়ির ওপরের তলায় থাকেন লসমি আর তার স্বামী থাকেন নিচতলায়। তাদের বাংলোর আশেপাশে লসমির অশিক্ষিত আত্মীয়স্বজনদের ঘুরঘুর করা পছন্দ করেন না মোহনলাল। সুতরাং তেমন কেউ আসেও না তাদের বাড়িতে। রাতের বেলা মাঝে মধ্যে তিনি লসমির ঘরে আসেন। মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। তিনি ইংরেজদের মতো করে হিন্দুস্থানী ভাষায় কী সব বলেন। লসমি শুধু নিষ্ক্রিয় থাকার মতো করে আনুগত্য প্রকাশ করে যান। লসমির ঘরে তার নৈশকালীন সংক্ষিপ্ত অবস্থানে অবশ্য কোনো ফল পয়দা হয়নি।
সিগনাল নামিয়ে দেয়া হয়েছে। বেলের ঢং ঢং শব্দে বোঝা যাচ্ছে ট্রেন চলে আসছে। মিসেস মোহনলাল তার খাওয়া শেষ করে ফেললেন। ট্রাঙ্কের ওপর থেকে তিনি উঠে পড়েছেন। তবে তার মুখের ভেতরে এখনও আচারের ভেতরকার আমের আঁটির খানিকটা রয়ে গেছে। দীর্ঘ এবং সশব্দ একটা ঢেকুর তুলে তৃপ্তি প্রকাশ করে একটা পাবলিক ট্যাপের দিকে চললেন তিনি; হাত মুখ ধোয়া বাদ আছে এখনও। হাত মুখ ধোয়ার পর শাড়ির আঁচলে মুছে ফেললেন। উদরপূর্তি খাবার খাওয়ার ভাগ্য হওয়ার জন্য দেবদেবী আর ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে তার ট্রাঙ্কের কাছে ফিরে এলেন মিসেস মোহনলাল।
ট্রেন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করলে তিনি ট্রেনের একদম পেছনের দিকে গার্ড ভ্যানের পাশে মহিলাদের ইন্টারক্লাস গাড়ির সামনে এসে দেখলেন কম্পার্টমেন্ট একেবারেই খালি। ট্রেনের বাকি অংশ মানুষে বোঝাই হয়ে আছে।দরজা দিয়ে তার মোটাসোটা শরীরখানা প্রবেশ করিয়ে জানালার পাশে একটা সিটে বসলেন।শাড়ির আঁচলের গিট থেকে মাত্র দুঅনা পয়সা বের করে তিনি কুলিকে বিদায় করে দিলেন। এরপর তার পানের কৌটো খুলে লাল সাদা পেস্ট, ছোট ছোট করে কাটা সুপারি আর এলাচ দিয়ে বানিয়ে আস্ত দুটো পান মুখের ভেতর ঠেসে ঠেসে ভরলেন। তার মুখের দুপাশ ফুলে উঠল। তারপর তিনি হাতের ওপরে থুতনি ঠেকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফেলে প্ল্যাটফর্মে লোকজনের গিজগিজ করা ভীড়ের দিকে অলস ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন।
ট্রেন আসার পরও মোহনলালের অবিচল ভাব কাটেনি। তিনি স্কচে চুমুক দিতেই লাগলেন এবং বেয়ারারকে বললেন মালপত্র একটা ফার্স্টক্লাস কম্পার্টমেন্টে তোলার পরে যেন তাকে জানায়। উত্তেজনা, হৈ চৈ আর তাড়াহুড়ো– এসব আসলে ছোটলোকিপনার লক্ষণ।আর স্যার মোহনলালের ব্যক্তিত্ব তো অবশ্যই গড়ে উঠেছে চোখে পড়ার মতো সমাজে। তার চাই সবকিছু পরিপাটি আর সাজানো গোছানো। পাঁচ বছর বিদেশে থেকে তিনি উঁচুতলার মানুষদের আচার আচরণ আর দৃষ্টিভঙ্গি রপ্ত করেছেন। হিন্দুস্থানী ভাষা খুব একটা ব্যবহার করেন না তিনি। যখন করেন তখনও কোনো ইংরেজের মতো করেই করেন। শুধু অপরিহার্য শব্দ ব্যবহার করেন। সে শব্দগুলোও শুনতে অনেকটা ইংরেজি শব্দের মতো। তার ইচ্ছে তার ইংরেজি যেন মানের দিক থেকে খোদ অক্সফোর্ডের চেয়ে নিম্নতর কোনো জায়গার ইংরেজি না হয়। কথা বলতে তার খুব ভালো লাগে। যে কোনো রুচিবান ইংরেজের মতো তিনি যে কোনো বিষয়ে অনর্গল কথা বলতে পারেন। বইপত্র, রাজনীতি, নানা ধরণের মানুষ– যে কোনো বিষয়েই কথা বলতে ভালো লাগে। কতবার ইংরেজদের মুখেই শুনেছেন তার ইংরেজি খোদ ইংরেজদের মতোই।
খুশবন্ত সিং-এর কার্টুনস্যার মোহনের কৌতূহল হয় তাকে কী একাই ভ্রমণ করতে হবে না কি। এই স্টেশনটা তো একটা সেনানিবাস। ট্রেনে নিশ্চয় কিছু ইংরেজ অফিসার উঠতে পারেন। আকষণীয় আলাপ-সালাপের সম্ভাবনায় তার মনটা চনমন করে ওঠে। ইংরেজদের সাথে কথা বলার জন্য বেশিরভাগ ভারতীয় আগ্রহবোধ করে থাকে। তিনি কখনও সে রকম আগ্রহ প্রকাশ করেন না। তাদের মতো তিনি জোর গলায় কথা বলেন না; তাদের মতো তিনি উগ্র নন; কিংবা বেশি মাত্রায় নিজের মত প্রকাশ করতেও যান না। ইংরেজদের সাথে আলাপ থাকলে তিনি মামুলি প্রয়োজনীয় কথার মতো করেই সারেন। জানালার পাশে নিজের জায়গায় চুপচাপ থাকেন এবং দ্য টাইমসের একটা কপি বের করে পড়তে থাকেন। টাইমসের পাতার ক্রসওয়ার্ড পাজ্ল এমনভাবে পড়তে থাকেন যাতে অন্যরা পত্রিকাটার নাম দেখতে পারেন। তিনি জানেন টাইমস সব সময়ই একটা আকর্ষণীয় পত্রিকা। কিছুক্ষণ পর তিনি পত্রিকা এমনভাবে রেখে দেন যেন তার পড়া হয়ে গেছে; কেউ কেউ দেখার জন্য তার কাছ থেকে চেয়ে নেন। কেউ কেউ মাঝে মধ্যে তার বেলিওল টাইও চিনে ফেলেন। ভ্রমণ করার সময় তিনি সব সময় টাই পরেন। তাতে অবশ্য মনে পড়ে যেতে পারে অক্সফোর্ড কলেজগুলোর রূপকথার জগত, সেখানকার শিক্ষক, টিউটর, নৌকো বাইচ কিংবা রাগবি প্রতিযোগিতার কথা। টাইমস পত্রিকা এবং বেলিওল টাইয়ে কারো নজর কাড়তে ব্যর্থ হলে তিনি বেয়ারারকে উদ্দেশ্য করে স্কচের বোতল বের করার জন্য হাঁক ছাড়েন, কই হ্যায়। ইংরেজদের দৃষ্টি আকষর্ণ করার ক্ষেত্রে হুইস্কি কখনও ব্যর্থ হয় না। তারপর আসে তার সুন্দর সোনালি রঙের সিগারেটের প্যাকেট; সেখানে থাকে ইংরেজদের সিগারেট। ভারতে ইংরেজদের সিগারেট? কীভাবে পেলেন তিনি এই জিনিস? তাহলে দু-একটা দিতেও তিনি কিছু মনে করবেন না। স্যার মোহনের হাসি দেখে বোঝা যায় তিনি কিছু মনে করবেন না। তবে তিনি কি ইংরেজ লোকটার মাধ্যমে তার পুরনো ইংল্যান্ডের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করতে পারবেন? সেই পাঁচ বছরের কথা মনে চলে আসতে পারে– ধূসর ব্যাগ ও গাউন, স্পোর্টস ব্লেজার, কোর্টের ডিনার, টেনিসের মিক্সড ডাবলস এবং পিকাডিলির গণিকাদের সাথে কাটানো রাতের কথা। গৌরবভরা পাঁচ বছরের জীবনের কথা। ভারতে কাটানো পয়তাল্লিশ বছরের চেয়েও মূল্যবান ছিল ওই পাঁচ বছর। কেননা ভারতের জীবন মানেই তো নোংরা অমার্জিত লোকজন, সাফলের রাস্তার নীরস বর্ণনা আর স্থুলদেহী লসমির ঘাম আর কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধঅলা শরীরের সাথে স্বল্পস্থায়ী যৌন মিলন।
স্যার মোহনের চিন্তা প্রবাহ বিঘ্নিত হয় বেয়ারারের কথায়; সাহেবের মালপত্র ইঞ্জিনের পাশে একটা ফার্স্টক্লাস কুপেতে তোলার কথা জানায় সে। ধীরস্থির গতিতে স্যার মোহন তার কুপের দিকে যেতে থাকেন। মনে হচ্ছে তিনি বিষণ্ন। কম্পার্টমেন্টে ফাঁকা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি এক কোণায় বসে পড়ে দ্য টাইমস খুলে ধরেন। অবশ্য ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার পড়া হয়ে গেছে।
জানালা দিয়ে তিনি প্ল্যাটফর্মের ভীড়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। দুজন ইংরেজ সৈনিককে ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে আসতে দেখে তার মুখটা ঝলমল করে ওঠে। সৈনিক দুজন বিভিন্ন কম্পার্টমেন্টে ফাঁকা জায়গা খুঁজতে খুঁজতে আসছে। তাদের পিঠে ঝোলানো আছে বড় ব্যাগ, পদক্ষেপ অনেকটা স্খলিত। স্যার মোহন তাদেরকে সাদর আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য তাদের সেকেন্ড ক্লাসে ভ্রমণ করার কথা। তিনি গার্ডের সাথে কথা বলবেন।
সৈনিকদের একজন শেষ কম্পার্টমেন্ট পর্যন্ত এসে জানালা দিয়ে ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে উঁকি দেয়। কম্পার্টমেন্টের ভেতরটা ভালো করে দেখে এবং খালি বার্থ তার নজরে পড়ে যায়।
এহানে, বিল এহানে।
তার সঙ্গী এগিয়ে আসে। ভেতরে উঁকি দিয়ে স্যার মোহনকে দেখতে পায়।
বিড়বিড় করে তার সঙ্গীকে বলে, নিগ্রো হালারে হালায়ে দেই।
তারা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে অর্ধেক হাস্যমুখি, অর্ধেক প্রতিবাদী স্যার মোহনের দিকে এগোয়।
বিল চিৎকার ছাড়ে, রিজার্ভড!
জিম চিৎকার করে বলে, জানতা রিজার্ভড আর্মি– ফৌজ। একদম বাইর অও। গেট আউট!
স্যার মোহন অক্সফোর্ড উচ্চারণে বলতে থাকেন, বলছিলাম কী, বলছিলাম, নিশ্চয়...।
সৈনিক দুজন একটুখানি থামে। স্যার মোহনের কথা তাদের কাছে ইংরেজির মতো মনে হয়। কিন্তু নিজেদের শৌণ্ড কানকে বিশ্বাস না করে কী করতে হবে তাদের ভালো করেই জানা আছে। ইঞ্জিনের বাঁশি বেজে ওঠে এবং গার্ড সবুজ পতাকা ওড়ায়।
তারা স্যার মোহনের স্যুটকেস তুলে বাইরে প্ল্যাটফর্মে ছুড়ে মারে। সেটার পিছে পিছে থার্মোফ্লাস্ক, ব্রিফকেস, বিছানাপত্র এবং দ্য টাইমস বাইরে ফেলে দেয় তারা। স্যার মোহন রাগে লাল হয়ে যান। রাগের কারণে ভাঙা গলায় বলতে থাকেন, এটা একেবারেই অযৌক্তিক, সম্পূর্ণ অযৌক্তিক! আমি তোমাদের ধরিয়ে দেব! গার্ড কোথায়, গার্ড!
বিল এবং জিম আবার খানিক থেমে যায়। স্যার মোহনের কথা ইংরেজির মতোই শোনায়। কিন্তু অতি মাত্রায় কিংস কলেজীয় স্টাইলের ইংরেজি তো তাদের বোঝার ক্ষমতার বাইরে।
তোর লাল মুখ বন্ধ কর ব্যাটা, বলেই জিম সরাসরি স্যার মোহনের গালে একটা চড় মারে।
ইঞ্জিন থেকে আরেকবার সংক্ষিপ্ত বাঁশি বাজায়। সাথে সাথে ট্রেন চলা শুরু করে। সৈনিকেরা স্যার মোহনের দুবাহু ধরে তুলে তাকে প্ল্যাটফর্মে ছুড়ে মারে। তিনি পেছনের দিকে পাক খেয়ে তার বিছানাপত্রের স্তুপের সাথে হোঁচট খেয়ে স্যুটকেসের ওপরে পড়ে যান।
বিদায়য়য়!
স্যার মোহনের পা মাটিতে আটকে গেছে। তিনি কথা হারিয়ে বোবা হয়ে গেছেন। দ্রুতগতিতে পার হয়ে যাওয়া ট্রেনের আলোকিত জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। ট্রেনের শেষ গাড়িটায় লাল আলো জ্বলছে; সেখানে খোলা দরজার সামনে পতাকাহাতে দাঁড়িয়ে আছে গার্ড।
ইন্টারক্লাসে মহিলাদের কম্পার্টমেন্টে আছেন স্বাস্থবতী লসমি। স্টেশনের আলো পড়ে তার নাক-ফুলটা চিকচিক করছে। মুখের ভেতরে পানের রস জমা হয়ে ফুলে উঠছে। ট্রেনটা স্টেশন পার হলেই ফেলে দেয়ার চিন্তা করছেন। ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মের আলোকিত অংশ পার হয়ে গেলে তিনি থুথু ফেললেন। এক টুকরো ময়লার মতো তার মুখ থেকে এক ফোটা লাল তরল উড়ে গিয়ে বাইরে পড়ল।