কুহক

স্বৈরাচার সরকার পতনের আন্দোলন চলছে। সারা দেশজুড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাসেই এক ধরনের চাপা অস্থিরতা, কিন্তু সুনসান নীরবতা। যেকোনো সময় ভার্সিটির হল ভ্যাকান্টের অর্ডার আসতে পারে। বেশ কিছুদিন আগে ভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা করলেও অধিকাংশ ডিপার্টমেন্টই প্রতীকী খোলা রেখেছে এবং ক্লাস নিচ্ছে। ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকের পদচারণা, ঘোরাঘুরি, আড্ডা অনেকটাই কম। মাঝে মাঝে আর্মির টহল টিম দেখা যায়। যে সমস্ত স্টুডেন্ট টিএসসি, মধুর ক্যান্টিন ভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সংশ্লিষ্ট, কেবলমাত্র তাদেরই আনাগোনা। হলগুলোর বেশির ভাগই ফাঁকা হয়ে গেছে।

৯০-এর একেবারে শেষের দিকের সময়, অক্টোবর-নভেম্বর মাস হবে হয়ত। প্রকৃতি কিন্তু এই রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিচলিত নয়, স্বাভাবিক নিয়মেই তার চেহারা পরিবর্তন করে চলেছে। শীতের আমেজ তখনও জেঁকে বসেনি। কার্জন হলের সর্বত্রই শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, দেব কাঞ্চন, হিমঝুরি ফুলের মিষ্টি সুঘ্রাণ। কামরাঙা ও চালতা ফলের এক ধরনের মনমাতানো ‘ঝাঁঝালো টক’ সুঘ্রাণ বাতাসে মৌ মৌ করছে। হালকা শীতের দিনের উদাস দুপুরবেলা। নভেরা ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সামনে খোলা মাঠের মধ্যে রোদে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। রোদটা এমন যে রোদে পিঠ গরম হয়ে যায়, কিন্তু উঠতে মন চায় না। মন চায় আরও বসে থাকি; পারলে শুয়ে পড়ি। রাজনৈতিক অস্থিরতার বিক্ষিপ্ত আলোচনা চলতে থাকে—কথায় কথায় আড্ডার মোড় নেয় পদার্থ, শক্তি, আত্মা, ধর্ম, বিগত জীবনের ভৌতিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে।

নভেরা ভৌতিক বিষয়গুলোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেখে—সে জীবন ও জগৎকে দেখে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সেখানে এইসব ভৌতিক বিষয়-আশয়ের স্থান নেই। আমাদের গল্পে ভূতেরা হঠাৎ বিশাল কালো ষাঁড় থেকে কুকুর কিংবা বিড়াল হয়ে যায়, আবার হঠাৎ নাই হয়ে যায়; এটি পদার্থবিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক। একটি ষাঁড় ও একটি বিড়ালের ভর এক নয়। ভৌতিক আত্মারা যদি এক আকৃতি থেকে অন্য আকৃতিতে রূপান্তর হবার ক্ষমতা পেয়েও থাকে তবে অতিরিক্ত ভর পাবে কোত্থেকে? বা হারালে সেই ভর কোথায় যায়? কেননা মহাবিশ্বের মোট ভর ও শক্তির পরিমাণ নির্দিষ্ট। তাহলে কি ভরগুলো শক্তিতে রূপান্তর হয় কিংবা শক্তি থেকে ভর তৈরি হয়? এদিকে আইনস্টাইনের সূত্রানুযায়ী, ভর যদি শক্তিতে অথবা শক্তি যদি পদার্থে রূপান্তর হয় তবে E=MC2 ফর্মুলা মেনে চলবে। যেখানে ১ গ্রাম ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করলে যে পরিমাণ শক্তি তৈরি হয়, তা দিয়ে একটা ৬ তলা বিল্ডিংকে ৬০ ফিট উচ্চতায় তুলে ধরে রাখা যাবে। ঠিক একইভাবে মাত্র ১ গ্রাম ভর তৈরি করতে ঠিক ওই বিশাল পরিমাণ শক্তিকেই রূপান্তরিত হতে হবে। ভাবা যায়? সে শক্তিটা কত বিশাল! এত বিশাল শক্তি নিয়ে তারা কেবল মানুষকে ভয় দেখানোর দায়িত্ব নিয়েই ব্যস্ত! অন্য কোনো কাজ করে না! আচ্ছা ওরা কি গরু, ছাগল, মুরগি এদেরকে ভয় দেখানোর দায়িত্বটাও নেয়? নাকি শুধু মানুষকেই টার্গেট করে? অদ্ভুত না!

আরও একটা কথা, ভূত দেখার বিষয়টা—অনেকেই মনে করেন, আমরা চোখ দিয়ে দেখি, আসলে তা তো নয়—চোখের কাজ হলো কোনো বস্তু থেকে যে আলো আসে, তা গ্রহণ করে মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দেওয়া। মস্তিষ্ক জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই আলোর একটা রূপরেখা তৈরি করে আমাদের দেখার অনুভূতি সৃষ্টি করে। ভয়ের চিত্র দেখার মূল বিষয়টা এখানেই; মানুষ যখন রাতের স্বল্প আলোতে অনভ্যস্ত কোনো কিছু দেখে, মানব মস্তিষ্ক সেটা ঠিক ঠাহর করতে পারে না। এক্ষেত্রে চোখ ওই বস্তুর অস্পষ্ট ঝাপসা আলো মস্তিষ্কে প্রেরণ করে। মস্তিষ্ক সেই ইমেজটাকে তার চেনাজানা জিনিসের সাথে মেলাতে চায়। কিন্তু দেখার অনুভূতি তৈরির জন্য যে পরিমাণ আলো প্রয়োজন তা না থাকায়, একটা অস্পষ্ট ইমেজ তৈরি করে নেয়। যেমন, রাতের আধো আলো-আঁধারে কেউ যদি মাথা নিচের দিকে দিয়ে পা উপরে তুলে হাত দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করে এবং কোনো আগন্তুক তা দেখে, সে প্রচণ্ড ভয় পাবে। কারণ এ ধরনের চিত্র সচরাচর কেউ দেখে না। অন্ধকারে আগন্তুকের মস্তিষ্ক অনভ্যস্ত এই বস্তুর দর্শন করে তার চেনাজানা কোনো কিছুর সাথে মেলানোর চেষ্টা করবে—হতে পারে সেটা ছোটবেলার গল্পে শোনা কিংবা গলাকাটা ভূতের সাথে। সেটা ভয়ংকর কিছু হতেও পারে এই মেসেজ দেওয়ার জন্যই মস্তিষ্ক ভয়ের অনুভূতি তৈরি করবে এবং পালিয়ে যেতে প্ররোচিত করবে।

তবে নভেরা বায়োলজিক্যাল ক্রিয়াকলাপকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখে। হ্যালুসিনেশন, মস্তিষ্কে অক্সিজেনের স্বল্পতা, মস্তিষ্কের নিউরনের সিন্যাপসিস তৈরিতে জটিলতা, বিভিন্ন রাসায়নিক-আণবিক রিঅ্যাকশন, বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় রাতের আঁধার, সাপের ভয়, উপর হতে পড়ে যাওয়ার ‘জিনগত ভয়ের তথ্য’ পরিবহন এগুলো সে মোটামুটি ঐশ্বরিক বাণী হিসেবে ধরে নিয়েছে।

নভেরা বলে, তবে একটা কথা হলো কি জানো, ভয় কিন্তু বেশ মজার একটা বিষয়। জিনগত, ভয়ংকর সুন্দর মাঝে মাঝে পেতে মন চায়। এ জন্য একাকী রাতের বেলা রুমে বসে ভূতের মুভি দেখি। বেশ একটা হিমহিম করা অনুভূতি...

নভেরার কথা শেষ হতে না হতেই লাইজু প্রতিউত্তর করে, না রে, জ্বীন ভূতে আমার বেশ ভয়, রাতের বেলা একাকী কোথাও থাকলে তো শরীর ভার হয়ে আসে। তা ছাড়া অত কিছু জেনে লাভ নাই, সকল ধর্মগ্রন্থই কিন্তু এগুলোকে স্বীকৃতি দেয়। তোমরা তো আর ধর্মকে অস্বীকার করতে পারো না। তাই না! 
: যেখানেই মানুষের না জানার বিষয়গুলো আসে সেখানেই ধর্মগুলো সামনে চলে আসে। যেখানে ধর্ম সেখানে তো আর প্রশ্ন চলে না। এভাবেই চলছে। অশরীরী আসলে কোনো স্রষ্টা দ্বারা সৃষ্টি নয়, এগুলোর স্রষ্টা হলো বিভিন্ন ধর্ম, মিথ, গল্প আর রূপকথা। পৃথিবীতে যত প্রাণ আছে এগুলো বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থায় আসছে এবং এ সবই দৃশ্যমান অথবা অবশ্যই প্রমেয়; কিন্তু অশরীরী কিছু কোনোভাবেই প্রমাণ করা যাবে না। আচ্ছা, অশরীরীদের কোনো প্রাণ থাকে? ওরা কি জীব? ওরা বাংলা ভাষাতে কথা বলে? বলেই হেসে ওঠে নভেরা।
: আরে বাদ দাও তোমার বিবর্তন, তোমার কী মনে হয়? ধরো, একটি মেয়ের শারীরিক গঠন; যেখানে যতটুকু যা লাগবে ভালো লাগানোর জন্য, তা রেন্ডম সিলেকশনের মাধ্যমে ওইভাবেই তৈরি হয়েছে? মানে প্রকৃতি বুঝতে পারে বুকের উঁচুটা আর একটু লাগবে, পাছার ভাঁজটা আরও একটু কড়া হতে হবে, লম্বা হলে, গায়ের রংটা ফর্সা হলে ভালো হয়। হাসাইলা মামা! এগুলা স্রষ্টার নিখুঁত পরিকল্পনা ছাড়া হওয়া সম্ভব না। জুলজি ডিপার্টমেন্টের মোমেন কিছুটা আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে হাত পা নেড়ে বলল।

রাহাত এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। দুপুরের রোদে ঝিম মেরে বসে ছিল। সেও অংশ নেয় আলোচনায়— হ, তোমার বিবর্তনতত্ত্ব ভালো লাগবে ক্যান? এতে তো পড়াশুনা লাগে না। বিবর্তনতত্ত্ব আসলেই রেন্ডম সিলেকশন। কালো, ফর্সা, লম্বা, বেঁটে সব ধরনের মানুষ প্রজাতিই প্রকৃতিতে প্রকাশ পায়; কিন্তু যে গুণগুলো অধিকতর উপযুক্ত সে প্রজাতিগুলোই টিকে যায় এবং বংশপরম্পরায় সেই গুণগুলোই প্রকট আকারে প্রকাশ পায়। এগুলো ব্যাপক সময়ের ব্যাপার, লক্ষ লক্ষ বছরে পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান চেহারা আসছে। মহাবিশ্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে তোমার? এইটা কত বড়? মহাবিশ্বের তুলনায় একটি বালুকণার সমতুল্য পৃথিবীর মানুষগুলার জন্য মহাবিশ্বের স্রষ্টা, এই বালুকণার মধ্যে নেমে আসেন, আলোচনা করেন পুরুষদের সাথে, তোমরা কারে কারে বিয়া করতে পারবা?...স্রষ্টারে তোমরা কত ছোট বানায়া রাখছ! পড়াশুনা করো; সূর্য, গ্যালাক্সি, নেবুলা, নিউট্রন তারকা, বিগব্যাং, মাল্টিইউনিভার্স এগুলো আগে জানো। স্রষ্টা অনেক বিশাল ব্যাপার। আমার কী মনে হয় জানো, আমরা আসলে এই প্রকৃতির একটা প্রোডাক্ট। এখানেই উৎপত্তি, এখানেই শেষ পরিণতি। আমার তো মনে হয় কাউকে যদি মানতেই হয় তবে পৃথিবী এবং সূর্যকেই আমাদের ভক্তি করা উচিত। আরও বড় কিছুকে যদি মানতে চাও, তাহলে বলতে পারো আমরা সকলেই নক্ষত্রের সন্তান। এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি অথবা ধরো, একাধিক গ্যালাক্সির বিভিন্ন উপাদান থেকেই এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের ছোট্ট এই গ্রহে আমাদের উৎপত্তি। আরও জানো, দেখবা, অন্য অসংখ্য কোথাও, অসংখ্য এমন জীবের অস্তিত্ব খুঁজে পাবা। বিশাল এক বক্তব্য দিয়ে রাহাত একটু দম নেয়।
: তাইলে কি বলতে চাও প্যারানরমাল অ্যাকটিভিটিস বলতে পৃথিবীতে কিছু নাই? পৃথিবীর অনেক বিষয়ই কিন্তু এখনও অমীমাংসিত। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নাই যেখানকার মানুষ ভৌতিক বিষয়গুলোকে স্বীকার করে না। তা ছাড়া জ্বীন-ভূতে ধরা মানুষগুলোকে আমি চাক্ষুষ দেখেছি। রাতের আঁধারে বিজন রাস্তায়, বিলের ধারে, ফাঁকা ধানক্ষেতের চকে অনেকেই এদের সম্মুখীন হয়েছে। ভয়ংকর! আমার তো এদের কথা শুনলে গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে। কিছুটা ভয় ভয় অভিনয় নিয়ে লাইজু বলল।
: আরে যা যা, তোর ওই সমস্ত অশরীরী, ভূত-আত্মারে সিটিএন। তবে নভেরার মতো একটু হালকা ভারী নিতম্বের কোনো পেত্নী পাইলেও...মাম্মা!! টাইম নাই মানে? অলটাইম রেডি। আসিফ বলে উঠল।
আসিফ দ্যাখো আমিও কিন্তু হলে থাকি! আমিও সিটিএন মানে জানি। সো ব্রেকে পা দাও! ফাউ প্যাঁচাল একটু সাবধানে দিবা। ফার্স্ট ওয়ার্নিং! নভেরা রিপ্লাই দেয়।
এভাবে আড্ডা চলতে থাকে। দুপুর গড়াতে গড়াতে রোদের তেজটা কমতে থাকে। হঠাৎ নভেরার চোখ পড়ে কার্জন হলের মেইন গেটের আলতাফ মামার চায়ের দোকানের দিকে। ওদিকে তাকিয়েই এক ধরনের হিমশীতল ভয়ের অনুভূতি ওর পুরো শরীরে ছেয়ে যায়। সেই লোকটা! একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নভেরার দিকে। চোখের দৃষ্টিতে কেমন নির্লিপ্ত একটা ভাব। মনে হয় চোখের দৃষ্টিতে কোনো মণি নেই। শূন্য দৃষ্টি। চোখগুলো কোটরের ভেতরে ঢোকানো। কিন্তু মুখের দিকে তাকালে মনে হয় কেমন একটা হাসি খেলে যাচ্ছে। ঠোঁট দুটি একটু হাসির ভঙ্গিমায় প্রসারিত। নভেরার শরীর-মন, ভূতভবিষ্যৎ, সদর-গোপন সব যেন পড়তে পারছে লোকটা। ওকে ইগনোর করতে চাইলেও দৃষ্টি ওর দিকে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। ফ্রেন্ডসদের বলে লোকটাকে শাসিয়ে আসার বিষয়টি মাথাতেও আসে না। একটু পরেই আবার লোকটি উধাও হয়ে গেল মনে হয়। নভেরার আর ওইদিকে তাকাতেই মন চাইছে না। ওই লোকটাকে প্রথম দেখেছে সকাল ৯ টার দিকে। জহির ভাইয়ের ক্যান্টিনের সামনে। ক্যান্টিনে বসে শিঙাড়া খাচ্ছিল। দরজা দিয়ে চোখ বাইরে যেতেই দেখে লোকটাকে। মাথাটা ঝিঁঝি করে ওঠে, কেমন যেন আতঙ্ক বোধ হয়। প্রথম দেখাতেই কেমন অদ্ভুত মনে হয় লোকটাকে। নাকের গঠন এবং মুখের আদলটা এমন—সহজেই একটা প্রাণীর চিত্র মাথায় চলে আসে। ঘোড়া!

তোরা আড্ডা দে। আমার আর ভালো লাগছে না। হলের দিকে যাব। বলেই বসা থেকে উঠে ব্যাগটা হাতে নিয়ে হাঁটা শুরু করে নভেরা। কেমন যেন একটা অপার্থিব ভয় ভয় লাগছে নভেরার, শরীরটাও ভালো লাগছে না, জ্বর জ্বর অনুভূত হচ্ছে। আচ্ছা ভয় কেন লাগে? এমন একটা প্রশ্ন মাথায় নিয়ে অনেকটা ঘোর লাগা মানসিক অবস্থায় হাঁটতে থাকে।
ভুতুড়ে ভয়ের ভাবনার ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত! শীতের মতো জেঁকে আসে। প্রথম দিকে ভালোই অনুভূত হয়। পরে ভয়টা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। কিছু সময় আগে দেখা অপরিচিত লোকটিকে হঠাৎ ওর অশরীরী ভাবতে ভালো লাগছে। ভেবে চলেছে—আচ্ছা, এই অশরীরীর সংখ্যা কত? আর এমনকি হয়! দুইটি অশরীরীর একটা খানাখন্দের এপাশে আরেকটা কানাকুঞ্চির চিপায়-চাপায় দাঁড়িয়ে ওইরকম ভাবলেশহীন শূন্য দৃষ্টিতে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে আছে, তাইলে কি একজন অন্যজনকে ভয় পাবে? নাকি প্রেম বা কামভাব উদ্রেক ঘটবে? আচ্ছা ওদের জেন্ডার কী? কোনো প্রেগনেন্ট অশরীরীর কি দেখা পাওয়া যাবে? ওরা কি সম্মানিত কেউ? ‘টা’ ‘টি’ প্রত্যয় ব্যবহার করা কি ঠিক হচ্ছে? ভয়ের অনুভূতি ছাপিয়েও ঠোঁটের কোণে এক চিলতে সলাজ হাসি ফুটে ওঠে নভেরার।

কার্জন হল থেকে সে মাঝে মাঝে হেঁটেই হলে চলে আসে। আজও একটু ঘোর লাগা অবচেতন মনে দোয়েল চত্বর পার হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টিএসসি ক্রস করে। রোকেয়া হলের সামনে মূল গেটে এসে দাঁড়ায়। হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত, ভীতিকর কিছু দেখতে পাবে এ আশঙ্কায় পেছনে ফিরে তাকায়। না কোথাও অস্বাভাবিক কিছু নেই। দ্রুত গতিতে একটা দুটা রিকশা ছুটে যাচ্ছে। যেন তাদের খুব তাড়াহুড়া। দ্রুত ঘরে ফিরতে হবে। এ ছাড়া চারদিকটা বেশ ফাঁকা। রাজনৈতিক অস্থিরতায় সবকিছুতেই কেমন একটা আতঙ্ক। অস্বাভাবিক কিছু দেখতে না পেয়ে চারপাশে একবার ঘুরে দেখে হলের ভেতর ঢুকে পড়ে।

নভেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের ২য় বর্ষের ছাত্রী। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে হালকা জড়িয়েছে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তির পরপরই। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর। শকুনি লেকপাড়। মেধাবী ছাত্রী। ফর্সা। চোখে চশমা। ঘনকালো চুল পিঠ অবধি ছড়ানো। কোমরের নিকট ঢেউ খেলানো। থ্রি পিস সালোয়ার কামিজে বেশ আকর্ষণীয় লাগে। পারিবারিকভাবে সচ্ছল হলেও সন্ধ্যার দিকে ঝিগাতলায় ভিকারুননিসা নুন স্কুলের ক্লাস এইটের একটা মেয়েকে পড়ায়। মাসে ১২ দিন। হাজার তিনেক টাকা পায়। এতে হাত-খরচটা ভালোভাবেই চলে যায়।

নভেরা রোকেয়া হলের ৫ তলা মেইন বিল্ডিং টপফ্লোরের ৫১৪ নং রুমে থাকে। রুমটি একেবারে দক্ষিণ পাশের কর্নারের রুম। পাশেই কমন ওয়াশরুম। সারিবদ্ধভাবে বেশ কয়েকটি আয়না লাগানো। এর পরপরই টয়লেটের সারি। হলের টয়লেটগুলোর একটা কমন বৈশিষ্ট্য হলো টয়লেটের চারপাশের গাঁথুনিগুলো সিলিং পর্যন্ত উঠানো হয় না। ছাদ থেকে প্রায় ২/৩ ফিট ফাঁকা থাকে। এতে সুবিধা হলো, সিলিংয়ে একটি লাইট দিয়েই সবগুলো টয়লেটে আলো দেওয়া যায়। আবার টয়লেটগুলোতে গুমোট বা বদ্ধভাব থাকে না। আর অসুবিধা হলো, বিশেষ করে নভেরার মতো লাজুক প্রকৃতির মেয়েদের জন্য—বলা নেই কওয়া নেই, ওপাশের টয়লেট থেকে গাঁথুনির উপর দিয়ে মাথা বাড়িয়ে দিয়ে বন্ধু অন্য কিছু করছ না তো! এরকম ডায়লগ শুনতে হয়। এত উপরে উঠতে মেয়েগুলোকে বেশ কসরত করতে হয়। বালতি উপুড় করে তার ওপর উঠে দাঁড়াতে হয়। যদিও বিষয়টা বছরে ২/৩ বার ঘটেছে। ভার্সিটি বন্ধের দিনগুলোতে যখন কিছু করার থাকে না তখন এ ঘটনা বেশি ঘটে।

হল থেকে সন্ধ্যার দিকে বের হয়ে সোজা স্টুডেন্টের বাসায় চলে যায় নভেরা। আজ পড়াতে পড়াতে খানিকটা দেরি হয়ে গেল। হাতের ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে রাত ৮:৪৫। হলগেট ৯ টায় বন্ধ হয়ে যায়। বিডিআর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটিই মাত্র রিকশা, ডেকে নিয়ে দ্রুত উঠে বসে। রিকশা চলতে শুরু করে। চারদিকে লোকজনের চলাফেরা নিতান্তই কম। নিউমার্কেট পেরিয়ে কাঁটাবন বইয়ের দোকানগুলোতেও তেমন লোকের আনাগোনা নেই। ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢোকার পর মনে হলো যেন নির্জন বিরাণভূমি।

রিকশা তার গতিতে চলছে। মল-চত্বরের পাশ দিয়ে ভিসির বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে। হঠাৎই ভারী শীতের সাথে হালকা বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করে। প্রচণ্ড শীত অনুভূত হতে থাকে নভেরার। গায়ের চাদর দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে রাখলেও শীত যেন গায়ে হুল ফুটিয়ে দিচ্ছে। টিউশনিতে বের হবার সময় তেমন ঠান্ডা মনে হয়নি। কিন্তু একটু জ্বর জ্বর বোধ করায় কিছুটা ভারী পোশাকের সাথে চাদর জড়িয়ে নিয়েছিল।

আবহাওয়ার পরিবর্তন টের পাওয়া যাচ্ছে। আজকে একে তো কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ! তার ওপর আকাশে হঠাৎ করে মেঘ জমায় কালিগোলা অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারদিক। থমথমে বাতাসে ঝড়ের সংকেত। অনাকাঙ্ক্ষিত বেলি ফুলের একটা উগ্র প্রকট ঘ্রাণ মাথায় ভনভন করছে; যদিও এখন বর্ষাকাল নয়। মনে হচ্ছে কেউ যেন ইচ্ছে করে পুরো পৃথিবীটাকেই অন্যরকম করে সাজাচ্ছে। কেবলমাত্র ওকে উদ্দেশ্য করে। কেমন ভয়ার্ত বেদনাময় একটি আবহ ওকে ঘিরে ধরেছে। ক্রমেই নানারকম সন্দেহ আর ভয় বাসা বাঁধতে শুরু করেছে ওর মনে। প্রতিমুহূর্তেই ‘ও’ আশা করতে থাকে এখনই অন্ধকারের বুক চিরে দেখা দেবে আলো; কিন্তু দুর্ভেদ্য অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ছে না। কখন যে আবার মেঘের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসেছে চাঁদ! খেয়াল করেনি। সে আলোয় নভেরার চোখ যায় রিকশা চালকের দিকে। রিকশা চালকের দুটো পায়ের পাতার জায়গায় ঘোড়ার খুর! প্যাডেলের সাথে বীভৎস ভঙ্গিতে আপ-ডাউন করছে।
রিকশা চালক কোনো কথা না বলে হঠাৎই পেছনদিকে ঘুরে তাকাল। ইস্পাত কঠিন একটা মুখাবয়ব। চোখের দৃষ্টি যেন তীর থেকে ছুটে যাওয়া ধারালো ধনুকের ন্যায় যা নভেরার বস্ত্র ভেদ করে পুরো শরীরের উলঙ্গ অবয়ব দেখছে। পৈশাচিক এক আনন্দের হাসি লেগে আছে ঠোঁটের কোণে। নিজেকে এত অসহায় এর আগে কখনো মনে হয়নি নভেরার। হৃৎপিণ্ডটা যেন ধপধপ শব্দ করতে করতে বুকের খাঁচা ভেঙে বের হয়ে যাবে। চোখগুলো কোটর থেকে ঠিকরে বের হয়ে যাবে এমন অনুভূতি হচ্ছে। এই আবহ থেকে মুক্তি পেতে হাঁসফাঁস করছে; কিন্তু অদৃশ্য সুতা যেন তাকে বেদনাক্লিষ্ট এই আবহের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। যুক্তিরা সব একে একে হেরে যাচ্ছে চলমান এই বাস্তবতার কাছে। মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাবে। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল বুঝতে পারে না।

রিকশা রোকেয়া হলের সামনে এসে থামল। এখন রাত ৯:১৫টা। নভেরা কোনোমতে রিকশা থেকে নামল। চালকও তখন রিকশা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম আলোয় তার মুখে সেই রহস্যময় হাসি লেগে আছে। নভেরা ভয়ে ভয়ে রিকশাওয়ালার পায়ের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে। তার ক্ষীণ আশা এতক্ষণ যা দেখেছে তা আসলে মনের ভুল। হ্যালুসিনেশন। সে দেখে, লুঙ্গির নিচে মানুষের পায়ের বদলে দুইটা ঘোড়ার পা। খুরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুত জীবটা। নভেরা আর কিছু ভাবতে পারে না। মনে হয় মাথা ঘুরে মূর্ছা যাবে। যতটুকু সেন্স কাজ করছিল তাতেই সে হল-গেটের দিকে দৌড়াতে শুরু করে। হল-ক্যাম্পাসের রাস্তা পার হয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় ওঠে। হাঁপাতে হাঁপাতে ওর রুমের দিকে এগোতে থাকে। দরজা আলতো করে চাপানো। ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢোকে। রিতা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। রিতার না আজ বাড়িতে চলে যাওয়ার কথা! ‘ও’ বাড়িতে যায়নি তাহলে? রিতা না যাওয়ায় এক ধরনের স্বস্তিবোধ করে। এখন অবশ্য কোনো কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। ক্লান্তি আর অবসাদে শরীর এলিয়ে পড়েছে। হাত-পা না ধুয়েই রিতার পাশে শুয়ে পড়ে। রাজ্যের ঘুম নেমে আসে চোখে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে নভেরা।

নভেরার ঘুম ভাঙে গভীর রাতে। হাত ঘড়িতে দেখে তিনটা বাজে। ক্ষুধার্ত, অবসন্ন একটা দেহ। কিন্তু মানসিক চাপ অনেকটাই কম। কিছুটা ঝরঝরা লাগছে। মনে হচ্ছে একটা বাজে স্বপ্ন দেখে উঠেছে। কিন্তু তাও ভালো বিষয়টা বর্তমানে নেই। একবার চিন্তা করে রিতাকে ঘুম থেকে জাগায়। ঘটনাগুলো জানায়। রিতা শান্তভাবে ঘুমিয়ে আছে। কী ভেবে ঘুম ভাঙানোর সিদ্ধান্ত বাদ দেয়।

বিছানা থেকে উঠে এক গ্লাস পানি খেয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায়। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে টয়লেটের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে প্যানের ওপর বসে। খানিক বাদেই ‘ও’ দেখতে পায় ওর সামনেই উপর থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে! নভেরা উপরের দিকে তাকায়। ওই লোকটা বাথরুমের গাঁথুনির দেয়ালের ওপর ঘোড়ার পা সদৃশ পা দুটি নামিয়ে দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বসে আছে। পা-টা ক্ষতবিক্ষত। সেই ক্ষত থেকেই চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে।

দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে নভেরা প্যান থেকে উঠে ছিটকিনি খুলে দৌড়ে রুমের দিকে আসতে থাকে। রুমের দরজা ভেজানোই ছিল। নভেরা রুমে ঢুকে দরজার ছিটকিনি তুলে দেয়। বিছানায় ঘুমন্ত রিতাকে দেখে পরম কাঙ্ক্ষিত মানুষ বলে মনে হয়। এ মুহূর্তে একজন মানুষের সঙ্গ ওর ভীষণ প্রয়োজন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁপাতে থাকে নভেরা—যেন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে এসেছে—বেঁচে থাকার একটা আশা যেন সঞ্চার হয়েছে। কাঁথা গায়ে ঘুমিয়ে থাকা রিতাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তোলে, রিতা, রিতা! এই রিতা! ওঠো! ওঠো! ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠে রিতা। আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করে, কী! কী হইছে তোমার! স্বপ্ন দেখে ভয় পাইছ?  
: না, স্বপ্ন না। ওই লোকটা! বাথরুমের দেয়ালের ওপর বসে আছে। 
: কোন লোকটা? কী বলছ এসব! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। 
: লোকটার রিকশাতে এসেছিলাম। ওর পাগুলো মানুষের পা না। ঘোড়ার পায়ের মতো। বাথরুমের দেয়ালের ওপরে বসে আছে। পা দুটো রক্তমাখা, ক্ষতবিক্ষত! ভয়ংকর! বীভৎস! ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠে রিতার। বলে, কী বলো? তারপর কাঁথাটা শরীর থেকে নামিয়ে নিজের পাজামা হাত দিয়ে টেনে উপরে টানতে টানতে মুখে ক্রূর হাসি নিয়ে বলে, দেখো তো পা দুটো দেখতে এমন কি না?
নভেরা তাকিয়ে দেখে রিতার পাজামার নীচ থেকে এক জোড়া ঘোড়ার খুর বেরিয়ে আছে।